চিরঋণী  - মো: আরিফুল ইসলাম

চিরঋণী - মো: আরিফুল ইসলাম

তোমাদের গল্প জানুয়ারি ২০১৬

ছোট একটি পুকুর। পুকুরের চারপাশে বিভিন্ন রকমের গাছ। গাছগুলো আপনা-আপনি হয়নি, আমি এবং আমার বাবা মিলে গাছগুলো লাগিয়েছি। আয়তাকার পুকুরের দুই ধারে বাবা বিভিন্ন কাঠের গাছ লাগিয়েছেন। তবে আমার পছন্দ ফলগাছের প্রতি। পুকুরের বাকি দুই ধারে আমি বিভিন্ন রকমের ফলগাছ লাগিয়েছি। যেমন- হরেক জাতের লেবু, জাম্বুরা, পেয়ারা, আঙ্গুর, আনারস ইত্যাদি। পুকুরের এক কোনায় বাবা একটি আতাফলের গাছ লাগিয়েছিলেন। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। আমি প্রতিদিন সেই গাছটার যতœ নিতাম। পানি দিতাম গাছের গোড়ায়। কোনো আগাছা থাকলে তা নিড়ানি দিয়ে উপড়ে ফেলতাম। এতে গাছটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আতা গাছের সাথে আমিও বড় হতে থাকি। কয়েক বছর পর আতা গাছটি আমাকে কয়েকটা আতাফল উপহার দিলো। ফল পেয়ে আমি যে কতো খুশি হলাম তা বলে বুঝাতে পারবো না। গাছটি বড়ো হওয়ায় আমি প্রতিদিন বিকালে গাছে চড়ে ডালে বসে বিশ্রাম নিতাম। গাছটি পুকুরের ওপর বাঁকানো ছিলো। ডালগুলো এমনভাবে বিছানো ছিল যেন আতা গাছটি আমায় বলছে, বন্ধু তোমার জন্য পানির ওপর ঝুলন্ত বিছানা তৈরি করে রেখেছি। ক্লান্ত হলে এখানে বসে বিশ্রাম নিতে পার।
এর পর থেকে প্রায়ই আমি এখানে বসে থাকতাম। মন ভালো থাকলে গান, গজলও চর্চা করতাম। বিশেষ করে যখন আমার মন খুব খারাপ থাকতো। তখন গাছে চড়ে মলিন ছায়ায় শীতল বাতাসে গা ভাসিয়ে দিতাম। আর ভাবতাম গাছ আমাদের কতো বড় একটা নেয়ামত। কতো উপকার করে আমাদের। গাছ ছায়া দিলে আমরা বিশ্রাম নিতে পারি, ফল দিলে আমরা পেট ভরতে পারি, কাঠ দিলে চুলায় উনুন জ্বালতে পারি এবং অক্সিজেন দিলেই আমরা বেঁচে থাকতে পারি। আমরা গাছের কাছে কতো ঋণী। অথচ আমরা অকৃতজ্ঞের মত নির্বিচারে গাছ ধ্বংস করে চলেছি। গাছ আমাদের বাঁচতে সহায়তা করলেও আমরা তাদের কেটে ফেলছি। একদিন আমার মনটা খুব খারাপ থাকায় আতা গাছে বসে ঝিমুচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো ছোট্ট একটি ডালে। ছোট কৌটার মতো কি যেনো দেখা যাচ্ছে। বিষয়টা পরিষ্কার হওয়ার জন্য কাছে গেলাম। আরে এটা তো একটা পাখির বাসা। তিনটি ছানাও আছে দেখছি। শুধু মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’ এর মতো করে চেঁচাতে লাগলো। কালো পাখির ঠোঁটগুলো লাল রঙের, কী চমৎকার দৃশ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই মা পাখিটা চলে এলো এবং এ ডাল থেকে ও ডাল ওড়াউড়ি করে চেঁচাতে লাগলো। আমি বুঝতে পারলাম যে, আমাকে দেখেই হয়তো এতো চেঁচামেচি করছে পাখিটি। আমি মা পাখিটিকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, আমি তাদের শত্রু নই, আমি তাদের বন্ধু। কিন্তু না, কিছুতেই সে শান্ত হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। দূর থেকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম মা পাখিটি বাচ্চাদের খাবার খাওয়াচ্ছে। এবং বাচ্চাদের বলতে লাগলো, সাবধান মানুষদের কোনো বিশ্বাস নেই। তারা যে কোনো সময় আমাদের ক্ষতি করতে পারে। বাচ্চারা বলল, মা, ছেলেটি হয়তো খুব ভালো। দেখ না কতো সুন্দর করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে আমাদের বন্ধু হতে চায়। মা বলল, ভালো হলেই ভালো। তাই বলে অতো পিরিতির দরকার নেই। তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাই আমাদের মঙ্গল।
এর পর থেকে প্রতিদিনই আমি নতুন খুদে বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য পুকুরপাড়ে আসি। তাদের গান শোনাই, গজল শোনাই। আমি আসাতে তারা আর আগের মতো চেঁচামেচিও করে না। আমি ভাবলাম হয়তো পাখিগুলো আমাকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাই রোজ বিকেলে এখানে আসতাম সময় কাটাতে।
কয়েকদিন যাবৎ আমার খুব আনন্দের সাথে দিন কাটছে। পাখিগুলোর সাথে খুব গভীর ভাব জমেছে। ইদানীং আমি পাখি নিয়ে একটু বেশিই আগ্রহী। পাঠ্যপুস্তকের মতো পাখি নিয়ে ভাবাও আমার রোজকার রুটিন। একদিন হয়েছে কি- স্কুলে বাংলা ক্লাসে স্যার পাখি বিষয়ে রচনা লিখতে বললেন সবাইকে। যে যার মতো করে রচনা লিখেছে। আর আমি যা লিখেছি স্যারের মনে তা অতুলনীয় লেগেছে। স্যার আমার খুব প্রশংসা করলেন। অন্য সব ছাত্রদের আমার মতো হওয়ার উদাহরণ দিলেন। স্যার আমাকে বললেন, তুমি এতো সুন্দর রচনা কিভাবে লিখলে? আমি বললাম, স্যার, আমি পাখিকে খুব ভালোবাসি, আশপাশের বিভিন্ন রকমের পাখি দেখতে পাই এবং প্রত্যেক পাখি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখার চেষ্টা করি। স্যার আমার কথায় ও কাজে খুব খুশি হলেন। রচনা প্রতিযোগিতায় আমাকেই বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা দিলেন। আমি খুব আনন্দিত হলাম। সেই সঙ্গে হাজার বার আতাফল গাছের পাখিগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। কারণ এই পাখিগুলোর কারণেই আমার মনে পাখি বিষয়ে কৌতূহল জন্মেছিল। আর এ জন্যেই আমি আজ সবার সেরা হিসেবে বিবেচিত হলাম।
স্কুল শেষে বাসায় ফিরে গোসল করলাম। তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো পুকুরপাড়ের আতা গাছের ছোট্ট বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য গেলাম। তবে আজকের উদ্দেশ্য ছিল পাখিদের ধন্যবাদ জানাব। বুকভরা কৃতজ্ঞতা নিয়ে গাছে উঠলাম। কিন্তু একি! পাখির বাসা একদম ফাঁকা। কোথায় গেল ছোট পাখি ও তার তিনটি ছানা। কেউ ওদের চুরি করে নিয়ে যায়নি তো? এটা ভেবে আমার খুব কষ্ট হলো। পরক্ষণে আন্দাজ করলাম পাখিগুলো হয়তো উড়া শিখেছে তাই আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। তবে এবার কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে গেল। পাখিগুলো হয়তো আমাকে ভালো বন্ধু হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তাই কিছু না বলে চোখের আড়াল হলো। তবে আমার থেকে তাদের কৃতজ্ঞতা পাওনা থেকে গেল। পাখিগুলো আমার কতো বড় উপকার করলো অথচ তাদের এই উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ আমি পেলাম না। আমি পাখিগুলোর কাছে চিরঋণী হয়ে থাকলাম।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ