চুমকি লাগানো ঈদের জামা

চুমকি লাগানো ঈদের জামা

গল্প আগস্ট ২০১১

দেলোয়ার হোসেন

পরশু ঈদ।
এখন সব মার্কেটেই মানুষের ঢল। গাউছিয়া শপিংমলে পা ফেলারই জায়গা নেই। মেয়ে পুরুষের ধাক্কাধাক্কিতে সাজিদের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পানি পিপাসাও লেগেছে খুব। সেই যে আজানের পর এক দোকান থেকে দু’গাল ঝালমুড়ি মাখানো খেয়ে ইফতার করেছে তারপর আর কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি। সারা শরীর ঘামে জবজবে। এখন বের হওয়ার পথও খুঁজে পাচ্ছে না। বুকের কাছে দু’তিনটা প্যাকেট চেপে ধরে চলছে সামনে এগোনোর জোর লড়াই। শেষ পর্যন্ত ভিড় ঠেলে রাস্তায় এসে হাঁ করে লম্বা দম টেনে আবার দম ছাড়লো সাজিদ। এখানেও কি স্থির হয়ে এক দণ্ড দাঁড়ানোর জো আছে? বাঁধভাঙা স্রোতের মতো মানুষ যাচ্ছে যতো আসছে তার দ্বিগুণ। তার মধ্যে আবার প্রাইভেটকার, সিএনজি আর রিকশার যন্ত্রণা!
সময় যতো যাচ্ছে ততই অন্য রকম সুন্দর হয়ে উঠছে শহরের দোকানপাট। মার্কেটে এমন উপচে পড়া ভিড় সাজিদ কখনো দেখেনি। চাকরি পাওয়ার পর এই তার প্রথম কোনো বড় শপিংমলে আসা। সেও নিজের জন্য নয়। ছোটবোন মায়ার জন্য। নিজের যা কিছু প্রয়োজন তা সে ফুটপাথ থেকেই সেরে নেয়। একমাত্র আদরের ছোট বোন মোবাইলে বারবার বলেছে, ভাইয়া ঈদের আমার জন্য একটা জামা এনো। চুমকি লাগানো জামা। খাঁ বাড়ির শেলী, মিলি ও বেলীদের মতো।
সাজিদের বোনটা এবার হাইস্কুলে পা দিয়েছে। ওদের বাবা নেই। অভাবের সংসারে সাজিদের একটা চাকরির যে কতো বড় প্রয়োজন ছিলো সে কথা ওর মা ছাড়া আর কে বেশি জানে! মাও বলেছেন, বাবা সাজিদ, ঈদে বাড়ি এসে মুরব্বিদের, দোয়া নিয়ে যাস। বাড়িতে ঈদের জন্য তেমন কিছুই কেনাকাটা হয়নি। তুই সে যা হয় করিস।
মিরপুর দশ নম্বরের একটা মেসে থাকে সাজিদ। বেশ বড় একটা রুমে ওরা তিনজন। সাজিদ ছাড়া অন্য দু’জন ছাত্র। ওরা বিশ রোজার পরই গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। সাজিদ যখন মেসে পৌঁছালো তাখন রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি। ও ভাবলো, দুটো খেয়েই শুয়ে পড়বে। কাল সকাল উঠতে হবে। অগ্রিম টিকেট থাকলে চিন্তা ছিলো না। লোকাল বাস ধরতে হবে, কখন যে বাড়ি পৌঁছাবে তা এক আল্লাহই জানেন।
ঘরে আলো জ্বেলেই শুয়ে পড়লো সাজিদ। শুয়ে শুয়ে ভাবলো বড় লোকদের কেনাকাটার কথা। প্রথম রোজা থেকেই মানুষ ঈদের কেনাকাটা শুরু করেছে, শেষ রোজা পর্যন্ত তারা কিনতেই থাকবে। এতো টাকা পয়সা ওরা পায় কোথায়? অথচ ছোট বোনটার জন্য একটা কাপড় কিনতে গিয়ে আমার সারাটা দিন কেটে গেলো। যা পছন্দ হয় তা কেনার মতো সামর্থ্য আমার নেই। এ মার্কেট, সে মার্কেট, এ দোকান সে দোকান ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত একটা জামা কেনা। মায়ের শাড়িটা বেশ ভালো হয়েছে।
কী ভেবে প্যাকেট দুটো আবার খুললো সাজিদ। ছোট বোনের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। আমার বোনটা কোনো দিন এটা চাই ওটা চাই বলে কান্নাকাটি করেনি। শুধু বলেছে, ভাইয়া তুমি যখন চাকরি করবে তখন আমার জন্য ভালো ভালো জামা কাপড় কিনে এনো। কতো ঘুরাঘুরি করে এই কাপড়টা কিনলাম, ওর কি পছন্দ হবে? হবে না, কেন -এমন একটা কাপড় ও তো কখনো পরেনি। নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। ডানাকাটা পরীর মতো চঞ্চল পায়ে এ-পাড়া সে-পাড়া ঘুরে বেড়াবে।
কাপড় দুটো প্যাকেটে রেখে লাইট অফ করে চোখ বন্ধ করালো সাজিদ। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে না। এ-পাশ ও-পাশ করতে করতে ভাবে এখন যদি মায়ের সাথে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু বাড়িতে তো মোবাইল নেই। অন্যের নাম্বারে কল দিয়ে তবেই মায়ের সাথে একটু কথা বলা। ঈদের পর বাড়ির জন্য একটা সেট কিনতেই হবে। তখন, যখন ইচ্ছা তখনই কথা বলতে পারবো। আবার ভাবে, আরো দু’দিন আগে যদি বেতন আর বোনাসটা পাওয়া যেতো তা হলে এতো চিন্তা থাকতো না। এ-কথা সে-কথা ভাবতে ভাবতে রাত রাত দুইটার বেশি বেজে যায়। ঘুমও আসছে না। হঠাৎ বিছনা থেকে উঠে হাঁড়িতে যে ভাত-তরকারি ছিলো তা খেয়ে নিলো সাজিদ। আগামীকালই শেষ রোজা। হঠাৎ ঘুমিয়ে গেলে যদি সেহেরি না খেতে পারি। এ কথা ভেবেই খেয়ে দেয়ে সত্যি ও ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম ভাঙতেই বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হতে লাগলো। এতক্ষণে কাজের বুয়াটাও এসে হাজির। বুয়া বললো, ভাইজান কবে আসবেন?
-ঈদের পর দু’দিন তো বাড়িতে থাকতেই হবে।
- ঈদের কেনাকাটা করছেন?
- কেনাকাটা আর কী! আমার বোনটার জন্য চুমকি বসানো একটা জামা আর মায়ের জন্য একখানা শাড়ি।
- খুব ভালো করছেন।
সাজিদ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বুয়ার হাতে দিয়ে বললো, তোমার বখশিশ। বলেই পথে নামলো ও। গাবতলী পৌঁছে লোকাল বাসের সন্ধান করলো। ভাড়ার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো সাজিদ। দু’চার বেশি নয়- একেবারে ডাবলেরও বেশি।  তবু কেউ বসে নেই। সে যেখানে পারছে দৌড়ে গিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে সেখানেই। গাড়ির মধ্যে জায়গা না পেলে উঠে যাচ্ছে ছাদে। টাকা-পয়সাও তাদের কাছে বড় কথা নয়, বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই তারা খুশি।
এতটা অনিয়ম ভালো লাগে না সাজিদের।  ছোটাছুটি করেও কোনো লাভ হলো না। শেষে বাধ্য হয়ে টিকেট কেটে লোকাল বাসেই উঠে বসলো। যাত্রীরা মনের ঝাল মেটাতে অযথাই বাস মালিকদের উদ্দেশে বকাঝকা করছে। এসব বাসে মেয়ে ছেলে আর বাচ্চারাও রয়েছে। হেলপার বলছে সামনে গেলেই সিট খালি হবে তখন মেয়েরা বসতে পারবে। গরমে ছোটরা কাঁদছে কিন্তু সিট আর খালি হয় না। অবস্থা দেখে সাজিদের খুব খারাপ লাগতে লাগলো। শেষে নিজের সিট ছেড়ে একজন মহিলা ও তার বাচ্চাকে বসবার জায়গা করে দিলো। ওদের বাসের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই শব্দে আসছে যাচ্ছে কতো বাস কতো ট্রাক! কোনো বাস আবার ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে সামনে। যুবকরা ধমকাচ্ছে ড্রইবারকে।
- পেছনের গাড়ি আগে চলে যায় কেমন করে? আরো জোরে চালাও ড্রাইভার। আবার একটু বয়সীরা বলছেন, ড্রাইভার সাবধানে গাড়ি চালাও। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
আরিচা পৌঁছে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সাজিদ দৌড়ে উঠে গেলো একটা লঞ্চে। লঞ্চের  ভেতরে বাইরে কোথাও আর পা রাখার জায়গা নেই। ভাসমান দলাবাঁধা পিঁপড়ার মতো লঞ্চটিও দূর থেকে ভাসমান মানুষের স্তূপ বলে মনে হয়। কখন ডুবে যায় কে জানে? তবু সেই লঞ্চে না উঠতে পেরে যাত্রীদের আফসোসের সীমা নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। কতো জন বাস বদলের সময় লঞ্চে ওঠার সময় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছে মূল্যবান অনেক কিছুই। তবু ফিরে দেখার সময় নেই। শুধু ঈদের আগে বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই সব কষ্ট, সব দুঃখের অবসান।
সাজিদ ভেবেছিলো একবার পদ্মা পার হতে পারলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু দৌলতদিয়া পৌঁছে ও দেখলো শুধু যাত্রী আর যাত্রী। বাস যা আসছে, সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী বোঝাই করে আবার চলে যাচ্ছে। বাসের ছাদেও চাপাচাপি করে বসেছে মানুষ। অবস্থা দেখে সাজিদ ভাবলো এর চেয়ে ভালো কোনো আশা করা মনে হয় ঠিক হবে না। তখন সেও দৌড়ে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়লো একটা বাসে। সিটেই বসেছে ও। দেখতে দেখতে বাস ভরে গেলো প্যাসেঞ্জারে কিন্তু বাস ছাড়ার কোনো উদ্যোগ নেই ড্রাইভারের। এক সময় বাস স্টার্ট হলো, ইঞ্জিন হু-হু করলো তথাপি জায়গা থেকে একটুও নড়লো না। প্যাসেঞ্জারদের চিৎকারে একবার আগায় এক বার পিছায়। এইটুকু সময়ের মধ্যেই বাসের ছাদও হয়ে গেছে বোঝাই। এবার চলতে শুরু করলো বাস।
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নানাভাবে সময়ের অপচয় হতে হতে ইফতারের সময়ও এগিয়ে এলো। রোজাদারদের মধ্যে ইফতার করা নিয়ে গুঞ্জন উঠলো। অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে সাজিদও বললো, ড্রাইভার ভাই, সামনে কোনো বাজার দেখে গাড়ি থামাবেন। সেখানে আমরা ইফতার করে নেবো। ড্রাইভার দেখলো আর দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই বাজার। পথ এবং সময়ের কথা ভেবেই বাসের গতি বাড়িয়ে দিলো ড্রাইভার। অবস্থা বুঝে অন্যান্য বাসও গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা বাস পাশ কেটে চলে গেলো সামনে। একেবারে সাজিদদের বাসের গা ঘেঁষে। আর একটু হলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতো। তার পর আরেকটা... তারপর আরেকটা। হঠাৎ বাসের পাঁজর বরাবর ধাক্কা।
ড্রাইভার শক্ত হাতে বাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলো। রাস্তার পাশের দুই খেজুর গাছের ফাঁকে ঢুকে পড়লো বাস। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা। তারপর যাত্রীদের চিৎকার আর আর্তনাদে চারদিক থেকে ছুটে এলো মানুষ। ছুটে এলো বাজারের টহলরত পুলিশ।
ভোর রাতের দিকে সাজিদের জ্ঞান ফিরলো। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। একটু নড়াচড়া করতে দেখেই ছুটে এলো নার্স।
- এখন কেমন লাগছে আপনার?
কোনো কথা না বলে শুধু চোখ মেললো সাজিদ। মাথায় এবং শরীরে বেশ ব্যথা অনুভব করলো। এ-পাশ ও-পাশ দেখে বললো, আমি কোথায়?
- আপনি হাসপাতলে।
- হাসপাতালে কেন? আমার কী হয়েছে ?
- কাল সন্ধ্যায় বাস এক্সিসিডেন্ট হয়েছে। আপনি অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। আপনি ঢাকা থেকে আসছিলেন। এখন মনে পড়ছে? সাজিদ ভাবতে চেষ্টা করলো গতকালের কথা। সামনে ঈদ। ঈদে বাড়িতে যাচ্ছিলাম। মায়ার জন্য চুমকি বসানো একটা সুন্দর কাপড় কিনেছিলাম। আমাদের বাসের পাশ দিয়ে অনেকগুলো বাস খুব দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে সব মনে পড়লো সাজিদের। সাজিদ বললো, সিস্টার আমার ব্যাগ, আমার মোবাইল? সিস্টার বললো, উত্তেজিত হবেন না। ওগুলোর চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। দু-তিন দিনর পরই আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো ওর। কিন্তু পারলো না। শুধু চোখের দু’পাশ দিয়ে বয়ে চললো অশ্রুধারা। হঠাৎ সিস্টার বলে চেঁচিয়ে উঠলো সাজিদ। ছুটে এলো নার্স- ডাক্তার।
-ডাক্তার, আমার ব্যাগের মধ্যে চুমকি লাগানো একটা জামা ছিলো। আমার ছোট বোনের অনেক দিনের স্বপ্ন। ...
আপনি আপনার বাড়ির ঠিকানা বলুন। অথবা কারো মোবাইল নাম্বার। তা হলে আপনার বাড়িতে খবরটা পৌঁছোনো যাবে।
সাজিদ মনে মনে ভাবলো কাল ঈদ, অথচ আমার বাড়ি যাওয়া হবে না। কী হবে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে! ইচ্ছে করেই ও বাড়ির ঠিকানা বলতে পারলো না। আর কারো নাম্বার সত্যি ওর মনে নেই। তাই চুপচাপ চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললো, বাস এক্সিডেন্টের কথা কাল-পরশু সবাই জেনে যাবে। গত রাতেও মা আর মায়া আমার জন্য কত রাত পর্যন্ত পথ চেয়ে বসেছিলো কে জানে! চুমকি বসানো কাপড়ের কথা ভুলে যাবে মায়া। শুধু আমার জন্য আমাকে জীবিত ফিরে পাওয়ার জন্য। পাগলের মতো কাঁদবে আমার মা আর আমার বোনটি!
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ