চোর ও বুড়ি

চোর ও বুড়ি

গল্প আগস্ট ২০১২

তমসুর হোসেন..
এক ছিল বুড়ি। তার ছেলে সন্তান কেউ ছিল না। জনহীন বাড়িতে সে একা একা থাকতো। এক রাতে বুড়ি দেখলো তার ঘরে চোর ঢুকেছে। বুড়ি বড় চিন্তায় পড়ে গেল। প্রতিবেশীদের বাড়ি তার বাড়ি থেকে বেশ দূরে দূরে। চিৎকার করে তাদের ডাকলে চোর যদি তাকে আঘাত করে দৌড়ে চলে যায়। চোরটা সিন্দুকের পেছনে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বুড়ি চোরকে কিছুই বুঝতে দিলো না।
সে বিছানায় আরাম করে বসে ডিব্বা থেকে পান জর্দা বের করে খাওয়া শুরু করলো। তারপর বাহানা করে বাতির সাথে কথা বলা শুরু করলো। বুড়ি বললো, ‘শোন হে বাতি, তুমি আমার পিতলের আয়না জ্বলা সাথী। তোমাকে দিয়ে আমি আন্ধার ঘরে সলক করি। তোমার গায়ে আমি আমার ভাঙা দাঁতের ছবি দেখি। তুমি ছাড়া আমার আর আপন কে আছে বলো! মন লাগিয়ে শোন, আজ তোমাকে আমার দুঃখের কথা বলবো।’
তখন আমি একেবারে ছোট। একদিন হঠাৎ আমার মায়ের কলেরা হলো। সেদিন বাবা গিয়েছিলো দূরের হাটে খরচ করতে। বাড়িতে শুধুমাত্র একজন কাজের মানুষ ছিলো। আমরা তাকে বদুমামা বলে ডাকতাম। আমার নানাবাড়ি ছিলো অনেক দূরে। বলা চলে দেড় দিনের পথ। মায়ের ঔষধের ব্যবস্থা কে করবে। কে ডেকে নিয়ে আসবে ডাক্তার! বদুমামার বুদ্ধিসুদ্ধি কম ছিলো। সে আবার ডাক্তারের বাড়িও চিনতো না। একটা পা খাটো থাকার জন্য বদুমামা ভালো করে হাঁটতেও পারতো না। সে মাকে খুব শ্রদ্ধা করতো।
মায়ের অবস্থা খারাপ দেখে সে ডাক্তারের খোঁজে ছুটলো। বদুমামা যেয়ে দেখে ডাক্তার অন্যখানে রোগী দেখতে গেছে। এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে অন্যখানে বদুমামা হন্যে হয়ে খুঁজলো ডাক্তারকে। কিন্তু কোথাও তার দেখা পেলো না। সন্ধ্যায় যখন অবসন্ন চেহারায় মামা বাড়ি ফিরলো তখন মা আর বেঁচে নেই।
হাটের খরচ শেষে বাবা বাড়ি ফিরে এলো অনেক রাতে। ঘরের দাওয়ায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে দা নিয়ে বাবা বাঁশঝাড়ে গেলো দাফনের জন্য বাঁশ কাটতে। বাবার নির্দেশ পেয়ে বদুমামা গেলো পাড়ার লোকজন এবং মৌলভী ডাকতে। বাবার কাছে টাকা নিয়ে বাদল চাচা কাপড় কিনতে গেলো বাজারে। রাতেই গোসল সেরে সাদা কাপড় পরিয়ে মাকে মাটির নিচে দাফন করা হলো।
আমরা এতিম তিন ভাইবোন গলা জড়াজড়ি করে মাটিতে লুটিয়ে কাঁদতে লাগলাম। পড়শিরা এসে আমাদেরকে সান্ত্বনা দিলো। বাবা আমাদেরকে তেমন কিছুই বললেন না। আসলে তিনি আমাদেরকে তত একটা ভালোবাসতেন না। মায়ের সাথে বাবা প্রায়ই ঝগড়া করতেন। সামান্য অজুহাতে মাকে খুব নির্যাতন করতেন তিনি। মাকে হারিয়ে আমরা এখন কার কাছে থাকবো? কে আমাদেরকে পেট পুরে খেতে দেবে? মা মারা যাবার খবর শুনে দু’দিন পর নানা এসে চোখের পানি ফেলে আমাদেরকে নিয়ে গেলেন তার সাথে। একমাত্র কন্যার মা হারা সন্তানদের পেয়ে নানী কেঁদে কেঁদে আকুল হলেন।
নানীর সোহাগমাখা আদর-যতেœ আমরা ধীরে ধীরে মাকে ভুলে যেতে লাগলাম।
চোরটা বুড়ির দুঃখের গল্প শুনে মুগ্ধ হয়ে চুরির কথা একদম ভুলে গেল। সে একটু একটু করে সরে এসে বুড়ির সিথানের কাছে বাতির ছায়ায় বসলো।
বুড়ি বলতে লাগলো, বাতি, শুনেছো তার পর কী হলো? তিন মাস পর নানাবাড়ি থেকে ফিরে এসে আমরা দেখলাম বাবা নতুন বউ বিয়ে করে মনের আনন্দে সংসার করছে। আমাদের সৎমা দেখতে থানার খাকি পোশাক পরা বেতের ছড়ি ঘোরানো দারোগার মতো। সে নানাভাইকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেয়ে বড় ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে হাসিমুখে খাবার খেতে দিলো। খুব সম্মান এবং সমাদর করলো সে নানাভাইকে। কয়েকদিন থাকার পর নানাভাই খুশিতে গদগদ হয়ে আমাদের দিকে নিজের সন্তানের মতো নজর দিতে বলে সৎমাকে বারবার দোয়া করে চলে গেলো।
সৎমায়ের ব্যবহার ছিলো বড় কপট। বাবার সামনে সে আমাদের সাথে খুবই ভালো আচরণ করতো।
ঘরের কাজকর্ম শেষ হলে সে আমার ছোটভাই টিপুকে নিয়ে হৈ হৈ করে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতো।
টিপুর বয়স তখন তিন বছর।
আমার ছোট বোন বানুর বয়স তখন পাঁচ আমার বয়স সাত। সৎমা সব সময় টিপুকে নিজ হাতে খাওয়াতো। দীঘিতে নিয়ে যেয়ে অনেকক্ষণ ধরে সুন্দর করে গোসল করাতো।
এমন কাণ্ড দেখে পড়শিরা তো অবাক।!সতীনের বাচ্চাকে এমন আদর তো কেউ কোনদিন করে না।
একদিন হঠাৎ করে টিপুর পাতলা দাস্ত শুরু হলো। ডাক্তার দেখে বললো, ওর কলেরা হয়েছে। এ কথা শুনে সৎমা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সারাক্ষণ সে টিপুর কাছে বসে থাকলো। সে এতটা বিষণœ হয়ে গেলো যে তাকে দেখে যে কেউ ভাববে টিপু ছাড়া তার জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে। আমি কাছে যেতেই সে এমন করে আমার কান টেনে ধরলো যে তা ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হলো। আমি টিপুর নিকট যাবার সাহস হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু দূর থেকে টিপুর দিকে নজর রাখতে লাগলাম। সৎমায়ের কাজকর্ম দেখে আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। টিপুকে ঔষধ না খাইয়ে সে অতি সাবধানে বাইরে মাটিতে ঢেলে ফেলে দিতো। টিপুকে মেরে ফেলার সব ব্যবস্থা ভালোবাসার আড়ালে করে ফেললো আমার ডাইনী সৎমা। তার অবহেলা এবং হীন ষড়যন্ত্রে করুণ মৃত্যু হলে সে দিনের আলোয় গলা চড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলো। ধুলায় গড়াগড়ি দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সে।
টিপু মারা যাবার পর সৎমা বানুর দিকে মনোযোগ দিলো। সারাদিন তার মুখে শুধু বানু বানু আর বানু।
বানুকে সাথে নিয়ে সে বাপের বাড়িতে নায়র খেতে যায়। বানুর দ্বারা আবদার করিয়ে বাবার সম্মতি নিয়ে গাড়ি সাজিয়ে মেলা দেখতে যায়। আমি স্পষ্ট বুঝলাম এবার সৎমা বানুকে মেরে ফেলার ফন্দি করছে। আমি বারবার বানুকে সতর্ক করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মা হারা বানু তার মেকি স্নেহে বশীভূত হয়ে গেলো। রাতের বেলা সৎমা বানুকে নিজের কাছে রাখতো। গোসল করার সময় বানু তার সাথে নির্জন পুকুরে যায়। সৎমায়ের আস্কারা পেয়ে বানু মনের আনন্দে সাঁতার কাটে।
শোন বাতি, আমার একলা ঘরে কথা বলার সাথী। আমি কষ্ট করে রাত জেগে তোমাকে গল্প শোনাচ্ছি আর তুমি একটা কথাও বলছো না। তার পর কী হলো শোন! একদিন বানুকে পাওয়া যাচ্ছিলো না।
চারদিকে লোক পাঠানো হলো বানুর খোঁজে। কোথাও বানুকে পাওয়া গেলো না। তিনদিন পর বানুর লাশ বাড়ি হতে কিছুটা দূরে একটা পোড়ো পুকুরের পানিতে ভেসে উঠলো। বানুর শোকে সৎমা বোবা হয়ে গেলো। তিনদিন সে কোন দানাপানি স্পর্শ করলো না। সে সবাইকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগলো, পর কখনো আপন হয় না। এত আদর যতœ করে যাকে আপন করার চেষ্টা করলাম সে আমাকে পর করে চলে গেলো।
বানুর পর সৎমা আমার দিকে তার শয়তানী দৃষ্টি ফেললো। নির্ঘাত মৃত্যুর আশঙ্কায় আমার বুক দুরু দুরু করে কেঁপে উঠলো। বাবাকে বললাম নানাবাড়িতে আমাকে রেখে আসতে। আমি ইশারায় বাবাকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাবা আমার কথা বুঝতে পারলো না। আমার নানাবাড়ি যাবার কথা শুনে সৎমা গলা ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি ভাবলাম এবার আমার পালা। রাক্ষসী এবার আমার ঘাড় মটকাবে। আমি সবসময় বাবার চোখে চোখে থাকার চেষ্টা করতাম। একদিন বাবা মাঠে কাজ করতে গেলে সৎমা আমাকে বাড়ির পেছনের গভীর কুয়া থেকে পানি তুলে আনতে বললো। আমি যখন দড়ি দিয়ে পানি তোলার কাজে ব্যস্ত তখন সৎমা হঠাৎ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কুয়ায় ফেলে দিতে উদ্যত হলো।
আমি ধপ করে শানের ওপর বসে পড়লাম। তারপর তার ঊরুতে এমন করে কামড় বসালাম যে সে দু’চোখে অন্ধকার দেখলো। সৎমায়ের গায়ে ছিলো অসুরের শক্তি। সে রেগে রক্তের মতো লাল হয়ে এক ঝটকায় আমাকে মাথার ওপর তুলে নিয়ে কুয়ার মধ্যে সজোরে নিক্ষেপ করলো। আমি জীবন বাঁচার তাগিদে দু’হাতে তার মাথার চুল খামচে ধরলাম। সৎমা আমার টুঁটি চেপে ধরে চিরতরে দুনিয়া হতে বিদায় করে দিতে চেষ্টা করতে লাগলো। আমার মরণ যেন বীভৎস রূপ নিয়ে সামনে এসে
দাঁড়ালো। আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম, ওরে বাবারে, কে কোথায় আছোরে! মানুষ খাওয়া ডাইনী আমাকে মেরে ফেললো। ও বাবা, ও নানা, নানী আম্মা, ময়না খালা তাড়াতাড়ি এসে দেখো---।
চোরটা আসলে দাগি চোর ছিলো না। সে বুড়ির দুঃখের কাহিনী শুনে চুরি করার কথা ভুলে গিয়েছিলো।
বুড়ির বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে সে তার সৎমাকে মারার জন্য ঘরের ভেতর খুঁজে একখানা বাঁশের লাঠি পেয়ে হতভম্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বুড়ির চিৎকারে পড়শিরা এসে দেখে একটা লোক লাঠি নিয়ে বুড়ির ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ির কাছে সব ঘটনা শুনে লোকজন তাকে ধরে ফেললো। পরদিন সকালে গ্রাম্য মাতবরের বাড়িতে চোরের বিচার শুরু হলো। বুড়ি ও চোরের মুখজবানী শুনে প্রবীণ মাতবর রায় দিলো, যেহেতু বুড়ির পৃথিবীতে আপন বলে কেউ নেই সে জন্য এই চোরের শাস্তি হলো এখন থেকে সে পাঁচশো টাকা মাশোয়ারার চুক্তিতে বুড়ির বাড়ি পাহারা দেবে। আর বুড়ি এখন থেকে বাতির সাথে গল্প না বলে চোরকে গল্প শোনাবে।


                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ