জাকাত    -আহসান হাবীব খান

জাকাত -আহসান হাবীব খান

নাটিকা নভেম্বর ২০১৫

গ্রাম্য বাজারে একটি শাড়ির দোকান। দোকান মালিক আর তার কর্মচারী এটা সেটা দেখছে আর গোছাচ্ছে। এমন সময় দেখা যাবে এলাকার চেয়ারম্যান সাহেব আসছেন। আসতে আসতে এর সঙ্গে তার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। যারা দূর থেকে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন তাদেরকে দূর থেকেই সালাম শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। এর মধ্যে দৃষ্টি যাবে শাড়ির দোকানে বসে থাকা রহমত মিয়ার দিকে, এগিয়ে গেলেন দোকানের দিকে।
রহমত মিয়া : (কর্মচারীর উদ্দেশে) এই পোলা জাকাতের শাড়িগুলো একটু সামনের দিকে রাখ, যাতে সহজে নজরে পড়ে। চেয়ারম্যান সাব আসতাছে।

(ছেলে উঠে গিয়ে শাড়ি গোছাবে, রহমত মিয়া ক্যাশে বসে বসে নির্দেশনা দেবে, এর মধ্য দিয়ে চেয়ারম্যানের আগমন)
চেয়ারম্যান : (হেসে) কী রহমত মিয়া, তোমারে খুব ব্যস্ত মনে হইতাছে।
রহমত : (খুব ব্যস্ত হয়ে) সালামালাইকুম চেয়ারম্যান সাব। কেমন আছেন?
চেয়ারম্যান : ওলাইকুম সালাম। আর থাকার কথা জিগাইতেছ? কেমন আছি বুঝবার পারতাছ না? বড় ঝুট ঝামেলার মধ্যে আছি।
রহমত : কেন চেয়ারম্যান সাব, এই ঝুট-ঝামেলা কী নিয়া?
চেয়ারম্যান : আরে জাকাতের সময় হইয়া আসতাছে না? ওহ! আল্লাহ সম্পদ না দিলেও সমস্যা, আর দিলেও আরেক সমস্যা। কি যে করবো কিছু বুঝবার পারতাছি না। তা তোমরা কেমন আছ?
রহমত : আর আমাদের থাকা...! আপনাদের হাতের দিকে চাইয়া কোন রকমে দিন গুজার করতাছি।
চেয়ারম্যান : (তৃপ্তির হাসি হেসে) তোমার মিয়া এই তেড়া কথার অভ্যাসটা আর গেল না। যাউগ্যা, শোন জাকাতের মাল কী আনছ আমারে দেখাও দেখি।
রহমত : (তৎপরতার সাথে) ১ নম্বর মাল আছে, কোন ফাঁকি-জুঁকি নাই। আপনের কথা ভাইব্যাই কাইলকা মাত্র মালডা তুললাম। এই পুলা দেখা দেখি।

(কর্মচারীকে নির্দেশ দেবে। কর্মচারী গাঁট-গাঁট শাড়ি চেয়ারম্যানের সামনে মেলে ধরবে। চেয়ারম্যান পরখ করে দেখতে থাকবেন। এমন সময় এলাকার মসজিদের ইমাম প্রবেশ করবেন। তাঁকে দেখে চেয়ারম্যান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানাবেন।)
ইমাম : আপনার কাজ চালান, আমি একটু অপেক্ষা করি।
চেয়ারম্যান : (কাপড় দেখতে দেখতে) তোমার মালডা কত করে পিস?
রহমত : এইডার দাম পড়ব আপনার ১০০ টাকা পিস আর ঐডা ৯০ টাকা কইরা ।
চেয়ারম্যান : দুর মিয়া এইডা কী দাম চাইলা তুমি আমার কাছে? বুইঝা শুইনা চাও।
রহমত : একটা টেকাও বেশি চাই নাই আপনের কাছে।
চেয়ারম্যান : শোন, ৭০ টাকা কইরা নেও, দশ হাজার পিস নেবো। জাকাতের শাড়ি, বেশি বাড়াবাড়ি কইরো না।
রহমত : মাফ করেন চেয়ারম্যান সাব। অত কম দামে পারি না যে।
চেয়ারম্যান : কী কও পার না...।
ইমাম : (চেয়ারম্যানের কথার ওপর দিয়ে) মাশা আল্লাহ চেয়ারম্যান সাব! দশ হাজার পিস শাড়ি কিনবেন! আল্লাহ আপনারে আরো তৌফিক দান করুন।
চেয়ারম্যান : অ্যা..! ...হা .....হা .....হা .... সেই দোয়াই কইরেন হুজুর, সেই দোয়াই কইরেন।
ইমাম : তবে আমার একটা কথা আছিল।
চেয়ারম্যান : একটা কেন, দশটা কন না।
ইমাম : দশ হাজার পিস শাড়ি দিয়া আপনি কী করবেন? অত জাকাত নেনেওয়ালা তো পুরা ইউনিয়নেও নাই।
চেয়ারম্যান : তাতে কী অইছে? একজনেরে দুইডা তিনডা কইরা দেবো। যাদের দরকার নাই তাদেরকেও দেবো। এই ঈদের পর বকরা ঈদের পরের মাসেই তো নির্বাচন। সেই সময় লোকজন যাতে আমারে মনে রাখে তার একটা ব্যবস্থা আর কি.. হে.... হে.... হে..... (হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে) কিন্তু তুমি তো মিয়া নাছোড় বান্দা বেশি মুনাফাখোর। (আবার প্রসঙ্গ বদলে ) এ.. এ.. এই ইমাম সাব, আপনে এরে একটু বোঝানতো।
ইমাম : (হেসে) আমি আপনাকে একটা জিনিস বুঝাতে চাই।
চেয়ারম্যান : (অবাক হয়ে) আমারে বুঝাইতে চান!
ইমাম : জি চেয়ারম্যান সাহেব, আপনাকেই। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি জাকাত দিতে আছেন ভালো কথা, আলহামদুলিল্লাহ। যেভাবে দিতাছেন ইসলামের বিধান সেইটা নয়।
চেয়ারম্যান : (বিরক্ত হয়ে) আপনি দেখি আরেক গীত শুরু করছেন। বিধান এইডা নাতো ... আল্লাহ কি না করছেন শাড়ি দেয়া যাবে না লুঙ্গি দেয়া যাবে না ... তোমরা কি কুরআন-হাদিসে এই রকম কিছু পাইছো?
রহমত : ইমাম সাব আপনি এইখান থাইক্যা চইলা যান। এই কুরআনের বিধান যদি আপনে এই খানে চালান, তাইলে আমার কাস্টমার কুমব, বিক্রি বাটা নষ্ট হইবো।
ইমাম : রহমত মিয়া, কুরআনের বিধান কারো অনিষ্ট করার জন্য নয়। চেয়ারম্যান সাব, দয়া কইরা আপনি আমার ওপর রাগ কইরেন না। আপনে সমাজের মাথা, তাই সঠিক জিনিসটা আপনের জানতেই হইবো। (এবার চেয়ারম্যান কিছুটা শান্ত হবে)
আপনি শাড়ি দিবার চান দেন। কিন্তু আপনি নিজেই যেটা বললেন যে যার দরকার নেই তারেও দেবেন। কেন তারে দেবেন কেন? সেতো জাকাতের হকদার না। আবার এর সঙ্গে ইলেকশনের ব্যাপারটাও যোগ কইরা দিলেন। ফলে আপনের পুরা জাকাতটাই ব্যর্থ হবে। অত টাকার জাকাত দেবেন, অথচ জাকাত দেয়া ব্যর্থ অইবো শুধু সঠিকভাবে না দেয়ার কারণে।
চেয়ারম্যান : (নরম হয়ে) তো আপনে কী করতে কন?
ইমাম : স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা করেন। রিকশা কিনে দেন, ভ্যান কিনে দেন, সেলাই মেশিন কিনে দেন, পোলট্রি খামার কইরা দেন।
চেয়ারম্যান : এইভাবে কয়জনরে জাকাত দেয়া যাইবো?
ইমাম : যদি পাঁচজনরে পারেন তাইলে পাঁচজনরে দেন। দশ জন পারলে দশজনরে। তারপর আবার আগামী বছরে আরো দশজনরে। এর ফলে তাদের একটা কাজের ব্যবস্থা হইবো ইনশাআল্লাহ। পরের বছর তারা আর জাকাত নেয়ার আইবো না। শোনেন, জাকাতের সিস্টেম আল্লাহ দিছেন মানুষরে স্বাবলম্বী করার জন্য, সারা জীবন অন্যের কাছে হাত পাতার জন্য না। তবে এতে অবশ্য আপনার ইলেকশনের চিন্তাটা মাথা থেকে বাদ দেয়া লাগবো।
চেয়ারম্যান : (অবোধ লোকের মত) তা-হইলে ব্যাপারটা কেমন হইয়া গেল না ইমাম সাব? আমিতো চাইছিলাম এক ঢিলে দুই পাখি মারতে?
ইমাম : (বুঝিয়ে) না, তা হয় না। জাকাতের টাকার মালিক তো আপনি নন। ঐ টাকার মালিক গরিবরা। তাই ওদের টাকা দিয়ে আপনি নির্বাচন করবেন কেন? আপনে নির্বাচন করবেন আপনের টাকা দিয়ে। ইনশাআল্লাহ সেই সামর্থ্য আপনার হবে।

(চেয়ারম্যন সাব চিন্তিত মনে কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর হাসিমুখে উঠে ইমাম সাহেবের সাথে মুসাফা এবং কোলাকুলি করলেন। রহমত মিয়া মুখ বেজার করে ইমাম সাহেবের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন।)
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ