জানা-অজানার কেওড়া গাছ

জানা-অজানার কেওড়া গাছ

ফিচার ফকির আব্দুল্লাহ আল ইসলাম মে ২০২৪

অসংখ্য বৃক্ষরাজির মধ্যে ‘কেওড়া’ একটি অন্যতম নাম। ম্যানগ্রোভ বা লবণাক্ত পরিবেশের উদ্ভিদ কেওড়া মূলত সুন্দরবনের প্রধানতম বৃক্ষ। কেওড়া গাছ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জন্মে সুন্দরবনের নদী মোহনায় এবং এ বনের অন্তরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খালের কর্দমাক্ত কিনারা ও নব জৈব-বর্জ্য সমৃদ্ধ চরাঞ্চলে। কেওড়া গাছের আদি-উৎপত্তি স্থানও সুন্দরবন। সুন্দরবনের বাইরে এর বিস্তৃতি ঘটেছে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার এই তিনটি দেশের সমুদ্র উপকূলের লবণাক্ত পরিবেশের বন-বাদাড়ে। এছাড়া চীনেও কেওড়া গাছ রয়েছে বলে তথ্য মেলে। হাসান মেহেদী নামের একজন ব্লগারের ব্লগ থেকে জানা যায়, চীন সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকে বন সংরক্ষণের একটা চুক্তি করে। সেই চুক্তির আওতায় আমাদের দেশ থেকে কেওড়া ও বাইনের বীজ নিয়ে চীনাদের বনে রোপণ করে।

ফলের গঠনের দিক থেকে কেওড়া গোত্রের অন্য যে সব বুনো প্রজাতির গাছ রয়েছে তাদেরকে একত্রে ইংরেজিতে ম্যানগ্রোভ অ্যাপল বলা হয়। কেওড়া বাদে ম্যানগ্রোভ অ্যাপলের আরো একটি প্রজাতি ওড়া বাংলাদেশের সুন্দরবনের বৃক্ষ। কেওড়া গাছের বৈজ্ঞানিক নাম সোনারটিয়া এপেতলা। কেওড়া ও ওড়া বা ছৈলা দোস্ত-দুশমনের মতো পাশাপাশি গলাগলি-মারামারি করে বেড়ে ওঠে। উভয়েই ফুলের জয়োৎসবের শেষে খাবার উপযোগী রুচি-সমৃদ্ধ অম্ল ফল উৎপন্ন করে। কেওড়া গাছের গোড়া ও এর চারপাশে খাড়া-খাড়া অজস্র শ্বাসমূল দেখা যায়, যা বায়ু সঞ্চালনে সহায়তা করে। যথাযথ পরিবেশে উদ্ভিদটি খুব দ্রুত বড়ো গাছে পরিণত হয়। কেওড়া গাছের উচ্চতা ২০ মিটারের মতো ও প্রায় ২.৫ মিটার চওড়া হয়ে থাকে।

এ গাছের সবুজপত্রসমূহ সরু ও লম্বাটে, যা দেখতে অনেকটা তেজপাতার সদৃশ। মন-মাতানো চিরসবুজের হাতছানি কেওড়া গাছে ঋতুরাজ বসন্তে হলুদ রঙের ছোটো ছোটো কেওড়া ফুল ফোটে। এসব পুষ্পেরা উভয়লিঙ্গের হয়ে থাকে। ফুলগুলো দেখতে নারীর ঝুমকো কানের দুলের ন্যায়। 

দৃষ্টিনন্দন সুবাসিত কেওড়া ফুলের ঘ্রাণ এলোমেলো বাতাসের ভেলায় চড়ে বিমোহিত করে প্রকৃতি-পরিবেশ! সুন্দরবনের মধু জগদ্বিখ্যাত, আর এই মধুর একটি বড়ো সংগ্রহশালা কেওড়া ফুল। ফলে এ সময় মৌমাছির আনাগোনায় মুখর থাকে সুন্দরবন। ফাল্গুনে ফুল ধরার পর ফুল থেকে ধীরে-ধীরে চৈত্র-বৈশাখে কেওড়া ফল তৈরি হয়। পরিপক্ব কেওড়া ফল বৃষ্টিভেজা আষাঢ়-শ্রাবণ পেরিয়ে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাওয়া এবং খাওয়া যায়। গোলগাল ডুমুর আকৃতির সবুজাভ কেওড়া ফলের ব্যাস বড়োজোর ২ থেকে ৩ মিলিমিটার। একটি কেওড়া ফলে বীজের সংখ্যা ২৫ থেকে প্রায় ১২৫টির মতো। ভেতরের বড়ো বিচি বাদে ওপরের সবুজ বর্ণের মাংসল অংশ টক স্বাদে ভরপুর। সুন্দরবনের হরিণ ও বানরের কাছে কেওড়ার পাতা ও ফল ভীষণ রকমের প্রিয় খাবার। তাই কেওড়া গাছকে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্বও বিদ্যমান। কেওড়া ফল শুধু কি এরাই খায়? না, এছাড়া কিছু পশু-পাখি ও পাঙ্গাশ ধরনের মাছের খাবার কেওড়া ফল। এখানেই কি শেষ কেওড়া কাব্য? না মোটেও তা নয়। সুন্দরবন ঘেঁষা উপকূলীয় জনপদ-সমূহের লোকজনের সুদীর্ঘ প্রাচীনকাল হতে কেওড়া ফল কাঁচা খাওয়ার পাশাপাশি সঙ্গে ডিমওয়ালা গোদা চিংড়ি মাছ ও মসুর ডালের খাট্টা রান্না করে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। স্বল্প-পরিসরে গৃহিণীদের কেউ কেউ কেওড়া ফল থেকে আচার ও চাটনি তৈরি করে থাকে।

কেওড়া-কীর্তি এখানেও সমাপ্ত নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সেল কর্তৃক প্রদত্ত গবেষণা অনুদানের অর্থে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. শেখ জুলফিকার হোসেন-এর করা সুন্দরবনের বুনো ফুল-ফল নিয়ে একটি মূল্যবান গবেষণাকর্ম রয়েছে। অধ্যাপক শেখ জুলফিকার হোসেনের গবেষণায় প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, চায়ের মতো এতে উপকারী ক্যাটেকিন এবং বিভিন্ন ধরনের পলিফেনল প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। 

এদেশে প্রাপ্ত ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিফেনল রয়েছে আমলকীতে, তারপরই হলো কেওড়া ফলের অবস্থান। কেওড়া ফলে সমপরিমাণ আপেল ও কমলা ফলের তুলনায় অনেক বেশি পলিফেনল ও পুষ্টি উপাদান রয়েছে। পলিফেনল শরীরে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ, অ্যালার্জি, চোখের ছানি, বিভিন্ন ধরনের প্রদাহসহ রোগ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে। ভিটামিন সি এবং এর ডেরিভেটিভগুলোয় পূর্ণ কেওড়া ফলে আমলকী, আপেল ও কমলা ফলের তুলনায় বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ও জিংকের উৎস। কেওড়া ফল পলিফেনল, ফ্লাভানয়েড, অ্যান্থোসায়ানিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও আনস্যাচুরেটেড ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড বিশেষ করে লিনোলেয়িক অ্যাসিড সমৃদ্ধ। আর এজন্য মনে করা হয়, ফলটি শরীর ও মনকে সতেজ রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী। প্রতিটি কেওড়া ফলে প্রায় ১২% শর্করা, ৪% আমিষ, ১.৫% ফ্যাট দৃশ্যমান। এ ফলের রয়েছে ডায়রিয়া ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধী এবং ব্যথানাশক গুণাবলি। ফলটি ডায়রিয়া, আমাশয় ও পেটের পীড়ার জন্য দায়ী ব্যাক্টেরিয়াকে কার্যকরভাবে দমন করতে পারে। এতসব গুণাগুণ ছাড়াও কেওড়া ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পালমিটিক অ্যাসিড, অ্যাস্করবাইল পালমিটেট ও স্টিয়ারিক অ্যাসিড; যে উপাদানগুলো বর্তমানে বিদেশ থেকে এনে খাদ্যশিল্পে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে এবং তৈরি খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। কেওড়া ফলের বিপুল এই গুণভাণ্ডারের কারণে অধ্যাপক শেখ জুলফিকার হোসেন মনে করেন, উপকূলীয় এলাকার অনাবাদি লবণাক্ত জমিতে ফলটি ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা গেলে অর্থনৈতিক উৎস সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে এবং এসব অঞ্চলের পরিবেশের গুণগত মানের উন্নয়ন ঘটবে। 

কেওড়া সুন্দরবনের বৃক্ষ হওয়ায় কাঠের সঙ্গে এর ফলও ক্রয়-বিক্রয় বাংলাদেশের বন আইনে নিষিদ্ধ। তাই কেওড়া ফলের উপকারী উপাদান দেশময় ছড়িয়ে দিতে যুগান্তকারী উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। সেক্ষেত্রে সুন্দরবনও যাতে হরিলুট না হয়, সে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা-বিশ্লেষণ এবং সচেতনতা প্রয়োজন। লবণাক্ত কাদামাটি ছাড়াও মিষ্টি পানির প্রকৃতিতেও কেওড়া গাছের জীবন প্রবাহ সতেজভাবে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটু বেশি পরিচর্যার দরকার। আইনিভাবে কেওড়া ফল বেচা-কেনায় নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলেও বর্তমানে ফলের মৌসুমে উপকূলীয় হাট-বাজারে ১০-২০ টাকা কেজি দরে সাধারণত কিছু পরিমাণে কেওড়া ফল বিক্রি হতে দেখা যায়। উল্লেখ্য, বাজারের এই ফলগুলোর বেশির ভাগই সুন্দরবনের বিপরীতে স্থানীয় কেওড়া বাগান থেকে সংগৃহীত। আসুন উপকূলীয় এলাকা থেকে শুরু করে দেশব্যাপী মূল্যবান কেওড়া গাছের বাগান সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবেশ ও জীবনমানের আমূল পরিবর্তন ঘটাই।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ