জোসনা রাতের গল্প

জোসনা রাতের গল্প

উপন্যাস মে ২০১৫

সোলায়মান আহসান#

পর্ব ২

পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় ছাদটা আলোকিত। মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। ফাল্গুনের মাঝামাঝি। ঝির ঝির ঠান্ডা বাতাস বইছে। গেল দিনে এক পশলা বৃষ্টি ঝরেছিল। চলে যাওয়া হিম আবার ফিরে এসেছে। শীতবুড়ি ভাবল এতো জলদি চলে যাবো। ফোকলা দাঁতের হাসিতে গুটিসুটি ফিরে এলো। বলল কি গো প্রেমা জিশান, পান দাও। একটু বসি। এটা হচ্ছে রহমান সাহেবের গল্প। শীতবুড়ির গল্প। আজও ছাদে উঠে প্রেমা জিশান রহমান সাহেবের কোল ঘেঁষে বসে। তবে আজ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের কাছে নয়। মোড়াতেও বসেনি। শীতল পাটিতে আসন নিয়েছে। উদ্দেশ্য গল্প শোনা। ‘আব্বু, ভূতের গল্প বলো না। ঐ যে তুমি বলেছিলে ছোটকালে মামার বাড়ি ভূত দেখেছিলে সেইটা বলো।’ প্রেমার আবদার। রহমান সাহেব মাথা চুলকাতে লেগে যান। গল্প খুঁজতে মাথা চুলকাতে হয় না। তার জীবনের এমন বহু মজার মজার গল্প আছে তা বলে শেষ করার আগেই এরা গল্প শোনার বয়স পেরিয়ে যাবে। মাথা চুলকানো মানে রহমান সাহেব ভেবেছিলেন আজকাল কম্পিউটারের যুগে ছেলে-মেয়েরা ভূতের গল্প শুনতে চাইবে? ‘ভূতের গল্প?’ ‘হ্যাঁ আব্বু, তোমার দেখা ভূতের গল্প।’ ‘উনিশ শ’ চুয়াত্তর সালের ঘটনা। দেশে চলছে আকাল। মানে দুর্ভিক্ষ। মানুষ খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। পত্রিকায় কঙ্কালসার মানুষের ছবি ছাপা হচ্ছে। এমন আকালে তোমার দাদু ঠিক করলেন আমাদের নানাবাড়ি নিয়ে যাবেন। তোমাদের দাদু ছিলেন সরকারি চাকুরে। সরকারি চাকরির নিয়ম মতো বেড়াতে যাওয়ার ছুটি ও বোনাস দিয়ে থাকে। যাকে যখন দেবে তাকে সে সময় ছুটি এবং বোনাস ভোগ করতে হবে।’ ‘তার মানে দুর্ভিক্ষের দিনে তোমরা বেড়াতে বেরুলে?’ ‘হ্যাঁ বেড়াতে এলাম। আমার নানাবাড়ি কিন্তু গ্রামে নয়। খুলনা শহরেই। ব্রিটিশ আমলে আমার ফরেস্ট রেঞ্জার নানাজান খুলনা শহরে বিশাল জায়গা কিনে পুকুর কেটে বাড়ি করেছিলেন। সে বাড়ির আয়তন বুঝি বিঘে দুয়েক। গাছ-গাছালি ঘেরা তখন অঞ্চলটা শহুরে হয়ে ওঠেনি। মফস্বলের আমেজ ছিল। নারকেল গাছের পাতার শিরশির আওয়াজ ভূতের নাকি সুরে কথার মত শোনাত।’ ‘বেশি বড়ো ভূমিকা হয়ে যাচ্ছে আব্বু। ভূতের গল্পটা বলো জলদি।’ প্রেমার ধৈর্য কুলাচ্ছে না। ‘বারে! প্রেক্ষাপট না বললে গল্প হয়? তা ছাড়া এ তো শুধু গল্প নয়Ñ সত্যি!’ ‘ঠিক আছে বলো।’ ‘আমার মামা ছিলেন দু’জন। চার খালা খুলনা শহরেই থাকেন। তার মানে মামাত খালাত মিলিয়ে আমরা ছোটদের বাহিনী বেশ বড়সড়। মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছি মানে অবাধ স্বাধীনতা। মামাত-খালাত ভাইবোনদের এক কথাÑ ওরা মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছে সাত খুন মাফ।’ ‘বাহ তোমাদের মামাত-খালাত ভাই-বোনরা কতো ভাল, আমাদেরগুলো ঝগড়াটে আর সুযোগ পেলেই গুড়–ম। ‘যদিও মাঝে মধ্যে খেলা নিয়ে গোল বেঁধে গেলে দু’চারটে বড় থাপ্পড় বিনিময় হতো। বিচার গড়াতো নানীজান পর্যন্ত। নানীজান ছিলেন বিশাল ধনী লোকের মেয়ে। ফর্সা টকটকে গোলাপি রঙের। বুড়ি বয়সেও ছিলেন তিনি বেজায় রসিক। নানীর বিচার সোজা। মেহমানরা অপরাধ যাই করুক, শাসন করা চলবে না। মেহমানদের গালে চুমু দিয়ে বিদেয়। তবে আমাদের মাঝে রাগারাগি মারামারি ছিল খুবই কম, হিংসা-বিদ্বেষও ছিলো না।’ ‘হয়েছে, এবার গল্পটা বলবে তো!’ ‘বলছি, দিনের বেলা কাটতো নানা ধরনের খেলায় মেতে লুকোচুরি। ছিপ দিয়ে পুকুরে মাছ মারা। সাঁতার শেখার কসরত ঝুনো নারকেল দুটো বেঁধে বুকের মাঝামাঝি রেখে ভেসে থাকার চেষ্টা। হাত-পা ছোড়া একদিন নারকেল জোড়া বুকের নিচ থেকে সরে ডুবে যাবার জোগাড়। আমার ডুবে যাওয়া দেখে বড় মামা জলদি পুকুরে ঝাঁপিয়ে উদ্ধার করেন। সেই থেকে কান ধরেছি সাঁতার শিখবো না’। ‘আব্বু তুমি সাঁতার জানো না?’ ‘সেবার শেখা হয়নি, পরে শিখেছি। রাতের বেলা চলতো অন্য খেলা ডবল বিছানায় গোল হয়ে বসে যেসব খেলা যায়। যেমন এন্টি বেন্টি, তালগাছ কাটা, চোর-পুলিশ, লুডু, ওয়ার্ড মেবিং ইত্যাদি। রাতের খাবার গ্রহণের আগ পর্যন্ত চলতো এসব খেলা। খাওয়ার পর রাতটা একটু জমে এলে বসতো গল্পের আসর। প্রথম কয়েকদিন আমরা শ্রোতা। নানী, মামাত-খালাত ভাই-বোনদের মুখে একের পর এক গল্প শুনছি দৈত্য-দানবের গল্প। মানুষের গল্প, পরীর গল্প, ভূতের গল্প। আর গল্প শোনার জন্য ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট স্থান হয়ে গেল। তা হলো। ‘তালপাতার সেপাই’ কামরুল ভাইয়ের ঘর। কামরুল ভাইকে নাম ধরে ডাকতে কমই শোনা যেতো। একমাত্র মামা মামী ডাকতেন কামরুল বলে। তালপাতার সেপাই উপাধি জোটার কারণ জেনেছি অসম্ভব রোগাটে দেহ এবং নারকেল গাছের মতো ছিপছিপে লম্বা বলে। কামরুল ভাইয়ের ঘরটা ছিলো মেইন রোডের লাগোয়া। ঠিক ঘর নয় বারান্দাকে বোর্ড দিয়ে পার্টিশনে ঘর বানানো। আমাদের চেয়ে বছর আষ্টেক বড় বলে কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা দূরবর্তী। তবে ¯েœহের অধিকারে রুমটা আমরা দখল করে রাখতাম বলে কোনোদিন গালমন্দ করতেন না। বরং আমাদের শোরগোল দেখে বলতেন, ঠিক আছে আমি নিচে যাচ্ছি। নিচে একটা বৈঠকখানা ছিলো। মামার বিচার-আচার মজলিসের জন্য। কামরুল ভাই চলে যেতেন। একদিন আমাদের গল্পের মধ্যমণি হয়ে বসলেন সেই তালপাতার সেপাই। আমাদের বলতেন যদি সাহস করে তার সঙ্গে রাতে জেগে থাকতে পারি তবে চাক্ষুষ ভূত দেখাবেন। ভিতুর ডিম হলে চলবে না। বুকে হিম্মৎ থাকতে হবে বীরপুরুষের সাহস। তা ছাড়া সময়টা গভীর রাত। নাক ডেকে ঘুমানোর সময়। বাট, ঘুমকে তাড়িয়ে জেগে থাকতে হবে। পটোলচেরা চোখ বানিয়ে। কখনও মধ্য রাতেও দেখা যায়। মোটকথা গভীর রাতেই দেখা যায়।’ ‘তারপর তোমরা রাজি হলে?’ ‘আমি প্রথমেই রাজি হলাম। আমার রাজি হওয়া দেখে খালাত ভাই সেলিম সাইফুলও রাজি হলো।’ ‘বাট, বেশি লোককে দেখানো যাবে না। কামরুল ভাইয়ের শর্ত। অবশ্য ছোট্ট একজনী খাটে আঁটাআঁটি করে তিনজন শোওয়া যাবে মাত্র। সে ক্ষেত্রে কামরুল ভাইকে বসেই কাটাতে হবে।’ ‘তারপর কী হলো আব্বু?’ গলার স্বর নেমে এসেছে প্রেমার। ‘কী ভয় করছে?’ ‘বেশ ইন্টারেস্টিং বলো তারপর কী হলো।’ জিশানের গলায় সামান্য কম্পন। গা ঘেঁষে বসেছে ওরা। বাতাস একটু জোরে বইতে শুরু করেছে। টবে অনেক জাতের ফুল ফুটেছে। রাতের বাতাস ফুলের সৌরভ ঠেলে নাকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু নানা ফুলের সৌরভ মিলিতভাবে এক অচেনা সুগন্ধি ছাদকে মাতোয়ারা করে তুলেছে। কোন বিল্ডিং থেকে নূপুরের শব্দও কানে আসছিল। টিভিতে নাচের অনুষ্ঠান চলছিল বোধ হয়। বিল্ডিংয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো নারকেল গাছটার পাতার হিস হিস শিরশির শব্দ একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। একটু আগে প্রেমা, জিশান, রহমান সাহেবের বসার মধ্যে যে দূরত্বটুকু ছিল তা নেই। গা ঘেঁষে বসেছে আরো’ ‘আহা কী সুগন্ধ’ ‘তারপর কী হলো বলো, রাত হচ্ছে আম্মু, লেদু দাদুকে ডেকে পাঠাতে কতক্ষণ।’ ‘বলছি। জিশান বাবুর ঘুম পেয়েছে বুঝি? আচ্ছা তাহলে আজ থাক আরেকদিন বলব’। ‘না, আজই শুনব- ঘুম পাচ্ছে না।’ জিশান নড়ে চড়ে বসল। ‘তারপর সেই কামরুল ভাইয়ের একজনী চৌকিতে আমরা তিনজন আঁটাআঁটি করে শুলাম। কামরুল ভাই বই হাতে চেয়ারে বসে। হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ার ভান করতে থাকলেন। চোখে ঘুম নিয়ে কি পড়া হয়?’ ‘ঘুমাস না কিন্তু সেলিম সাইফুল রহমান - তাহলে মিস করবি।’ ‘না, ঘুমাবো না।’ খুব জোর দিয়ে বললাম আমরা। ‘কামরুল ভাই ভূত দেখতে কেমন?’ ‘ভয়ে ভয়ে আমি জানতে চাইলাম।’ ‘ভূত তো অনেক আকার-আকৃতি নিয়ে হাজির হয়। তোরা বোধ হয় জানিস আমাদের পাড়া থেকে খুব কাছে আরেকটা পাড়ায় ভূতের বাড়ি আছে। পুরনো দিনের বাড়ি। এক হিন্দু ধনী লোকের বাড়ি ছিলো।’ ‘ঢাকায় তো একটা ভূতের গলি আছে তাই না আব্বু?’ জিশান বলল। ‘তবে আমাদের নানাবাড়ির ঐ ভূতের বাড়ির বেশ নামডাক ছিলো। কেউ সাহস করে ঐ বাড়ি কিনতে যায়নি। পোড়া বাড়ি হিসেবে ছিলো। বিশাল বাড়ি। একতলা বিল্ডিং, পুকুর গাছ-গাছালি।’ ‘তুমি আবার অন্য দিকে যাচ্ছ।’ ‘হ্যাঁ বলছি, কামরুল ভাই বললেন- তিনি যে ভূতকে প্রায়ই রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেন, সেটার দেহটা ঘোড়ার মত, মাথাটা ঘোড়ার মতো না- ‘কী রকম দেখতে? জানতে চাইলাম ফ্যাঁস ফ্যাঁস স্বরে। ভয়ে জমে গেছে বুক।’ ‘মেয়েলোকের মাথার মত লম্বা সাদা চুল। বাতাসে উড়তে থাকে চুলগুলো। টগবগ করে দ্রুতগতিতে জোড়ায় জোড়ায় রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে যায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দেখা।’ ‘তারপর কী দেখতে পেলে, সেই ভূতগুলো? ‘বলছি, ধীরে ধীরে রাত গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। ছোট্ট জানালার কপাট খুলে তাকিয়ে আছি। তিনজোড়া চোখ। দৃষ্টি যতো দূর যায় ততো দূর। গির্জা থেকে ঢং ঢং ঢং ঢং শব্দে সময়ের ঘণ্টাগুলো একে একে বেজে গেল। দুটো একটা মানুষের পদচারণাও নেই। মাঝে-মধ্যে রাস্তার নেড়ি কুকুরের ডাক। রাস্তা একদম ফাঁকা। ’ ‘আব্বু আমার ঘুম পাচ্ছে’ ‘দেখি সেই কামরুল ভাই আমাদের ভূত দেখাতে নিজের চেয়ারে বসে নাক ডাকতে শুরু করেছেন।’ ‘কামরুল ভাই- কামরুল ভাই-’ আমি ডাকলাম। ‘কী কী, এসেছে?’ ‘না আসেনি। তুমি ঘুমালে দেখাবে কে?’ ‘আমি ঘুমাইনি। পড়তে পড়তে চিন্তা করছিলাম তোরাও একটু ঘুমিয়ে নিতে পারিস। টেবিলঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন এখন রাত সাড়ে বারোটাÑ অন্তত রাত দুটো তিনটের আগে আসবে না। তোরা দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়ে নে আমি ডেকে দেবো। জেগে আছি ততক্ষণ।’ ‘ঠিক আছে আমরা তাহলে এক ঘণ্টা ঘুমাই। বলে ঘুমিয়ে পড়লো।’ ‘তারপর?’ প্রেমার বিরক্তি করা কণ্ঠ। ‘তারপর আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম তো পড়লামই। যখন পাখি ডাকাডাকি করছে। জানালা দিয়ে ভোরের মিষ্টি আলো প্রবেশ করেছে তখন জাগলাম। কামরুল ভাই টেবিলে মাথা রেখে তখনও ঘুমিয়ে। কামরুল ভাইকে ডেকে তুললাম। জানতে চাইলাম আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলে না কেন।’ ‘ভূত এসেছিল?’ জবাবে বললেনÑ ‘আসেনি মানে, আজকে সংখ্যায় অনেক, অন্তত পাঁচজোড়া ভূত চলে গেল টগ বগ টগ বগ করে।’ ‘তাহলে আমাদের ডাকোনি কেন?’ ‘তোরা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছিলি- কতো ডাকাডাকি করলাম। তা ছাড়া আমারও ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছিলরে কাল রাতে দেখাবোÑ’ ‘আমরা বুঝতে পারলাম ঘুমটাই আমাদের ভূত দেখার এমন মোক্ষম সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে।’ ঠিক হলো পরের দিন রাতে অভিযান চলবে। এমন সময় ভূতের মত এসে দাঁড়াল লেদু চাচা। হঠাৎ এসে সামনে দাঁড়াতে পূর্ণিমার আলোয় ভূতের মতই লাগে তাকে। ‘দীনা আম্মায় খাইতে ডাকছুইন- লেদু চাচা সিলেটী ভাষায় কথা বলেন। দীনার ডাক পড়ে যাওয়ায় রহমান সাহেব সটান উঠে দাঁড়ান। প্রেমা জিশানও সেই সঙ্গে। পাটি গুটিয়ে তোলে লেদু চাচা। (চলবে)
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ