জোসনা রাতের গল্প

জোসনা রাতের গল্প

উপন্যাস এপ্রিল ২০১৫

সোলায়মান আহসান#

এক. সেই বিদ্যুৎ চলে যাওয়া রোগ থেকে ছাদের সঙ্গে সম্পর্কটা গড়ে ওঠে। আজকাল বিদ্যুৎ চলে যাওয়া রোগের দাওয়াই সবার ঘরে ঘরে। আইপিএস জেনারেটর ইত্যাদি ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। তা ছাড়া বিদ্যুৎটাও আগের মতো যায় না। কিন্তু বিদ্যুৎ চলে গেলেই রহমান সাহেব এবং তার ছেলেমেয়েদের ছাদে ঠেলে ওঠার অভ্যাসটা রয়েই গেছে। রহমান সাহেবের ছাদের আকর্ষণ নানা কারণে। পেশায় আর্কিটেক্ট হলেও আকাশ-রাজ্য নিয়ে তার দারুণ কৌতূহল। গাছ-গাছড়া নিয়েও কম মাতামাতি করেন না। ছেলেমেয়ে এসব পাগলামোর কিছুটা অংশীদার তো হবেই। ঐ যে বললাম রহমান সাহেবের এসবকে পাগলামো বলে আখ্যা দিয়েছেন তার স্ত্রী দীনা রহমান। তিনিও কম যান না, একটা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা হয়েও নানা সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে বেড়ান। মোটামুটি এই হলো রহমান পরিবারের গঠন-গাঠন। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে একটু দূরে মিরপুরে তাদের বসবাস। একসময় মিরপুরকে ঢাকার বাইরের অঞ্চল হিসেবে ধরা হতো। মিরপুরে পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরে বাস করা লোকেরা এমনটাই বলেন। যাতায়াতের জন্য রাস্তাঘাট তেমন সহজ ছিলো না। ছিলো না তেমন ঘরবাড়ি। পরিবেশটা ছিলো শহর-পল্লীর মতো। সেই নিরিবিলি প্রকৃতির নিবিড় ¯েœহ পরিবেশে বসবাসের আশায় রহমান সাহেব মিরপুরে জমি কিনে বাড়ি করেন। তখন চারদিকে পতিত জমি ডোবা ঝোপ-ঝাড় ছিলো বেশি। ফাঁকা ফাঁকা দু-চারটে বাড়ির মধ্যে রহমান সাহেব তিনতলা বাড়িটা তোলেন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নন-কোঅপারেশন মুভমেন্ট করেও রহমানকে বাধা দিতে পারল না। এখন সেই মিরপুরের দিকে তাকিয়ে অনেকের ঈর্ষা ও লজ্জা হয়। রহমান সাহেব মুচকি হেসে নিজের দূরদর্শিতার বাহবা নেন। বাড়ির নাম শান্তির নীড়। মূলত গাছ-গাছড়া আর আকাশের নক্ষত্র নিয়ে যার কাজ-কারবার। তার জন্য এই নিরিবিলি আশ্রয় পছন্দ হবার কথা। দীনাও খানিকটা গাছপ্রেমিক বটে! তা না হলে ওষধি ফুল, ফল মিলিয়ে বিশাল গাছের বাগান ছাদে বেড়ে উঠতে পারতো না। গাছ পরিচর্চা চায়। তাই দীনা বান্ধবীদের পরচর্চায় কান না দিয়ে রহমানের গাছের যতেœ শেষ বিকেলে ঘণ্টাখানেক ব্যয় করেন। সহযোগিতায় থাকেন লেদু চাচা। লেদু চাচা সম্পর্কে একটু বলতেই হয়। লেদু চাচা রহমান সাহেবের বাবার বৈমাত্রেয় ভাই। অনেক শখ করে গিয়েছিলেন লন্ডন। যেভাবে সিলেটীরা লন্ডনমুখী হয়ে থাকেন। বিয়ে-থাও করেছিলেন এক ব্রিটিশ নারীকেই। কিন্তু তার ভাগ্য মন্দ। পরিবার জীবন সুখের হয়নি। অবশেষে দুঃখভারাক্রান্ত মনে দেশে ফিরে আসেন। বাড়িতে ছিলেন একা। গ্রামীণ জীবন তার ভালো লাগে না। তাই ভাতিজা রহমানের কথায় এলেন ঢাকা। আর এখানে মূলত রহমানের দুই ছেলেমেয়ে আর গাছ-গাছড়া নিয়ে ভালোই সময় কাটে। তবে লেদু চাচাকে পরগাছা গোছের লোক বলা যাবে না। গুণের বহর ম্যালা। যাক লেদু চাচা সম্পর্কে পরে আরও বলা যাবে। বিদ্যুৎ চলে যাবার নিয়ম মেনে আজও রহমান সাহেব মেয়ে প্রেমা ও ছেলে জিশানকে নিয়ে ছাদে উঠেছেন। কান টানলে মাথা আসে। সেভাবে দীনাও ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। রহমান সাহেব অভ্যাস মতো ছাদে উঠেই আকাশের দিকে দৃষ্টি ছুড়ে দেন, টেলিস্কোপ যন্ত্র দিয়ে। মাত্র গতকাল পঞ্জিকা থেকে মাঘ বিদায় নিয়েছে। গেল দু’বছর আগে লন্ডন থেকে নিয়ে এসেছে যন্ত্রটা। শীতকাল শেষে ফাল্গুন প্রবেশ করেছে। নিয়মমাফিক প্রকৃতি মানে বসন্তকাল। রাতের বেলা হিম জড়িয়ে ধরে। ভোর রাতের দিকে গায়ে কাঁথা না জড়ালে কর্ম সারা! ঠান্ডা লেগে সর্দি জ্বরে কয়েকদিন ভুগো। তাই মাঘ গেলেও আকাশটা সেজে আছে মাঘের মতোই। ঝকঝকে নীল আকাশের দক্ষিণ পূর্বকোণ থেকে পশ্চিম কোণে ছায়াপথের অবস্থান আগের মতো। উত্তর-পূর্ব আকাশে দেখা দিয়েছে সপ্তর্ষিমন্ডল। শনি রাশি পশ্চিম আকাশ থেকে চলে যাচ্ছে। সিংহ রাশিকে পুরোপুরি দেখা যায়। রহমান সাহেব ছাদে ওঠার জন্য বিদ্যুৎ চলে যাওয়া সময়কে বেছে নেন কেন? আকাশ দেখার জন্য অন্ধকার প্রয়োজন আছে কি? এমন প্রশ্ন করেছিল প্রেমা। আব্বু তুমি বিদ্যুৎ চলে গেলেই ছাদে ওঠো কেন? হাসতে হাসতে বলেছিলেনÑ ভৌতিক পরিবেশে আকাশ দেখতে। খুলে বলি, শহরে হাইরাইজড বিল্ডিংগুলো যেভাবে আলো ছড়িয়ে চারপাশ আলোকজ্জ্বল পরিবেশ তৈরি করে, তাতে আকাশের মিটি মিটি জ্বলা নক্ষত্র আর চাঁদের মায়াবী আলো লজ্জায় চুপসে যায়। প্রেমা মুচকি হেসে বলল বুঝেছি। ছাদে ছোট ছোট মোড়া রাখা আছে। ওগুলো হয়েছে এখন প্রেমা আর জিশানের আসন। ছাদে এলে ওরা দুষ্টুমি করে না। কয়েক শত টবে গড়ে তোলা বাগানের সুন্দর পরিবেশ ওদের মুগ্ধ করে। এসব গাছের অনেকগুলোর পরিচয় ওদের জানা। ফুল গাছের পরিচয় তো ফুল ফোটার মাধ্যমে জানা যায় তেমনি ফলের পরিচয় ফল ধরার মাধ্যমে। কিন্তু ওষধি গাছের পরিচয় জানতে সাহায্য নিতে হয় আব্বুর। অবশ্য ওদের আব্বু গাছ পরিচর্যার সময় কিংবা ছাদে বেড়াতে এলে গাছ চিনিয়ে দেন। কোন গাছের ওষধি গুণ কী তাও বলেন। এভাবে শুনতে শুনতে ওদের অনেক গাছই চেনা হয়ে গেছে। দিব্যি মুখস্থ বলতে পারে কোনটার ওষধি গুণ কী। বিশেষ করে বন্ধু-বান্ধব, মেহমান কেউ এলে ওরা গড় গড় করে গাছের পরিচয় বলে জ্ঞানের বহর মেলে ধরে। এতে রহমান সাহেব এবং দীনা মনে মনে তৃপ্তি পান। কারণ প্রকৃতির সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পরিচয় ঘটুক এটা ওরা চেয়েছিলেন। আজকাল শহরে যেসব ছেলেমেয়ে বাস করে তাদের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক বা পরিচয় ঘটার সুযোগ হয় না। এটা রহমান সাহেব মোটেই পছন্দ করেন না। তিনি দীনাকে প্রায়ই বলেনÑ যেসব ছেলেমেয়ের নিজের আশপাশের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় বা সম্পর্ক নেই, এদের দেশের প্রতিও গভীর মমতা নেই। দীনাও তাই বিশ্বাস করেন। মাঝে মধ্যে দীনা তার স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানে সেখানে বেড়াতে যান। প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় বা এমন একটা প্রোগ্রাম তারা হাতে নিয়েছেন। সেভাবে রহমান সাহেবের ছাদ দেখাতে নিয়ে আসেন দীনা। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়া প্রেমা আর ফাইভের জিশান হয়ে যায় জীববিদ্যার শিক্ষক। পটাপট বলে যায় এটা তুলসী সর্দি হাঁপানি ডায়াবেটিসে কাজে লাগে। এটা ঘৃত কুমারী বাত-ব্যথায় কাজে লাগে। এটা বাসক, নিশিদা, এটা ঝুমকোলতা ইত্যাদি। রহমান সাহেব এবং দীনা বাজার থেকে আস্ত মাছ কিনে ঘরে আনেন। প্রেমা ও জিশান যাতে মাছ চিনতে পারে। এতে প্রথম প্রথম দীনাকে বিপাকে পড়তে হতো মাছ কুটা নিয়ে। কিন্তু বাড়ি থেকে মনুর মাকে আনার পর সেই সমস্যা আর হয় না। তাছাড়া দীনা নিজেও মাছ কুটা শিখে নিয়েছেন। তবে শিং, কৈ, টেংরা এ জাতীয় ছোট মাছ কুটতে ভয় পান। বাজার থেকে আস্ত মাছ, তাজা মুরগি ঘরে এনে নিজেরা কেটে কুটে রান্না করে খাওয়ার মধ্যে তৃপ্তি আলাদা। যা আজকাল শহরের ছেলেমেয়েরা পায় না। রহমান সাহেব বলেন, ঢাকা শহরের ছেলেমেয়েরা ফার্মের মুুরগি, ওদের জগৎ বড়ই ছোট। এসব ফার্মের মুরগি দিয়ে জাতির তেমন উপকারে আসবে না। দীনা প্রতিবাদে বলেছেন, তাহলে করবেটা কী? বাবা মার হাতেও সময় নেই ছেলে-মেয়েদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার। কেন আমরা পারছি না? ইচ্ছে থাকলে কিছু না কিছু করা যায়। অন্তত মাঝে-মধ্যে বেড়ানোর প্রোগ্রাম যদি উদ্দেশ্যমূলক রাখা যায়। যেমন ধরো বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, নিজ গ্রামে নিয়ে যায় যদি। ‘সেরকম তো অনেকেই নেয়।’ দীনা কথার পিঠে কথা সাজান। ‘তোমাদের আকাশ-রাজ্যে বিচরণ শেষ হলো?’ অনতিদূর থেকে দীনা গলা চড়িয়ে বললেন। ‘না, আম্মু। আমরা আকাশ রাজ্যে আরও কিছু সময় থাকবো।’ প্রেমা বলল। ‘আচ্ছা আব্বু, চন্দ্র বিজয়ের পরও আজও মানুষ চাঁদকে নিয়ে কতো কিছু কল্পনা করেÑ ‘চাঁদের বুড়িটা কী জানিস?’ ‘কী আব্বু?’ প্রেমা প্রশ্ন করে। ‘শোন, চাঁদটা মহাকাশে অন্যান্য বাসিন্দাদের তুলনায় নিকটতম প্রতিবেশী। রাতের বেলা পৃথিবীবাসীকে যে মায়াবী আলো বিতরণ করে তাতে চাঁদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা গভীর। বাহ্যিকভাবে চাঁদকে যতোটা সুন্দর দেখায় বাস্তবে আহামরি কোন সৌন্দর্য নেই। নেই কোন আবহাওয়া, পানি বা বৃষ্টি, নেই বাতাস, নেই গাছপালা, জীবজšুÍ বা কীটপতঙ্গ, আছে শুধু রাশি রাশি পাথর আর পাহাড়। ‘বুড়িটা কী আব্বু?’ প্রেমা ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না। ‘পৃথিবী থেকে চাঁদের গায়ে আমরা যে কালো দাগ দেখি, তাকে চাঁদের কলঙ্ক বলা হয়। বাস্তবে তা হচ্ছে উঁচু-নিচু খাদ। সমুদ্র পাহাড়। দূর থেকে মনে হয় যেন কোন বুড়ি বসে তার চড়কায় সুতো কাটছে। চাদের বুড়ি তো দূরে থাক চাঁদে কোন প্রাণীর অস্তিত্বই নেই। বাস্তব নয় কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া।’ ‘কেন আব্বু?’ জিশানের প্রশ্ন। ‘কেন আগেই বললাম না পানি নেই বাতাস নেই’। ‘তাহলে মানুষ চাঁদে যাচ্ছে কেন? আবার বলছে পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত দ্রুত যাতায়াতের জন্য লিফট তৈরি করবে। ‘ধনী ও উন্নত দেশগুলোর ইচ্ছের তো কোনো শেষ নেই। তাছাড়া শক্তির লড়াইয়ে চাঁদকে একটা মহাশূন্যের ঘাঁটি পেতেও চায়। ‘আচ্ছা আব্বু চাঁদকে তো পৃথিবীর উপগ্রহ বলা হয়Ñ পৃথিবী যেভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চাঁদ কি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে? জিশান গালে হাত দিয়ে প্রশ্ন করে। ‘ভালো প্রশ্ন করছো, চাঁদকে আমরা পৃথিবীর বাচ্চা হিসেবে ভাবি তাই, পৃথিবীকে যেভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে হয়, তেমনি চাঁদের সূর্যকে প্রদক্ষিণ না করে উপায় নেই। চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে ২৮ দিন। ‘আচ্ছা আব্বু, চাঁদে কি মাধ্যাকর্ষণ আছে? জিশানের আবার প্রশ্ন। ‘ভালো প্রশ্ন করেছো, মাধ্যাকর্র্ষণের কথা তোমরা নিশ্চয়ই জানো পৃথিবীতে এই শক্তির জন্য সকল কিছু মাটির সঙ্গে সম্পর্কিত আছে। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ আছে কিন্তু যেহেতু চাঁদ পৃথিবীর তুলনায় খুব ছোট তাই এর আকর্ষণ ক্ষমতাও কম। পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ মাত্র। তার মানে পৃথিবীর একটা লোকের ওজন ৯০ কেজি হলে চাঁদে হবে মাত্র ১৫ কেজি। হা: হা: হা: আরেকটা মজার বিষয়, পৃথিবীতে হাইজাম্প দিয়ে তুমি যদি ৪ ফুট উঠতে পারো চাঁদে ঐ সমান লাফ দিয়ে ২৪ ফুট উপরে উঠতে পারবে। ‘বাহ্ বেশ মজার তো।’ প্রেমা বলল। রহমান সাহেব দূরবীক্ষণযন্ত্রে মাঝে মাঝে চোখ রেখে আকাশ-রাজ্যে কী যেন খুঁজছেন। ‘কী খোঁজো আব্বু, তুমি আর্কিটেক্ট না হয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলে ভালো করতে। খুঁজছি নুতন কোনো অতিথিকে। বলা তো যায় না হঠাৎ এমন কোনো নক্ষত্রের সন্ধান পেয়ে গেলাম ব্যাস, কেল্লা ফতেহ। এমন সময় চারপাশ এক সঙ্গে আলোকিত হয়ে উঠলো। বিদ্যুৎ চলে এসেছে। বিদ্যুৎ চলে এলে আকশটা কৃত্রিম আলোয় হারিয়ে যায়। অন্ধকারের আকাশে যে মায়া থাকে তা আর থাকে না। ‘জিশান, প্রেমা চলো এবার ঘরে ফেরা যাক, তোমার আম্মু এর চেয়ে দেরি করলে রেগে লাল মরিচ হবেন, খাবার নিশ্চয়ই টেবিলে হাজির।’ ‘চলো, গুটিয়ে ফেলো সব’। জিশান একটু হাত-পা ছুড়লো আকাশের দিকে। হা.. হা...হা ... হাউই। প্রেমা হাই তুললো। মানে ঘুম নেমে এসেছে চোখে। উঠে পড়লো সবাই। (চলবে)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ