জোসনা রাতের গল্প

জোসনা রাতের গল্প

উপন্যাস জুন ২০১৫

সোলায়মান আহসান #

[পর্ব-৩]
বিকেলবেলা একপশলা বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি হলে লেদু চাচার কাজ একটু কমে। গাছে পানি দিতে হয় না। একদিন ভালো বৃষ্টি হলে কয়েক দিন আর গাছে পানি দেয়া লাগে না। তবে গাছের মরে যাওয়া পাতা সাফ করা, ডাল, লতা, পাতা ঠিক ঠাক করা ইত্যাদি কাজে লেদু চাচা থাকে সবসময় মশগুল। লেদু চাচার ভাষায় গাছের মহব্বত করতে অয়, মহব্বত করলে গাছও মানুষরে মহব্বত করে। অভ্যাসবশত লেদু চাচা ছাদে উঠে একটা ছোট আকৃতির দা আর টুকরি নিয়ে গাছ পরিচর্যায় লাগে।
রোজকার মতো দীনাও সন্ধ্যার একটু আগে ছাদে উঠে হাঁটাহাঁটি করছিল।
‘লেদু চাচা, আপনার বুঝি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, ছাদে উঠলেই গাছের পরিচর্যায় লেগে যান।’
‘আয় মাÑ গাছ বড় লক্ষ্মী, যারা গাছের যতন করে তারার রোগবালই কম অয়। একটা হাছা গফ হুনতায়নি মা?’
‘বলেন চাচা, আমি হাঁটতে হাঁটতে শুনব।’
দীনা সময় নষ্ট করতে চায় না। একটু পর মাগরিবের আজান হবে। নিচে চলে যেতে হবে। তাই এ সময়টুকু হাঁটার মধ্যে থাকতে চায়।
‘হুনো, একজন লন্ডনি সিলেটী আমরার গাঁওয়ের পাশের গাঁও হাটের ব্যারাম আইছিল। ডাক্তারে কইছিল অপারেশন করতে। বেটা গেলে লন্ডনো অপারেশন করতো। ডাক্তার কইলো আপনার অপারেশন করলে ছয় মাস বাঁচবো। বেটায় অপারেশন না করিয়া নিজ গাঁড়তে আইলো একটা ঢিল্লা খরিদ করল। নানা জাতের ফল-মূল ঔষধি গাছের বাগান করলো ঢিল্লাতে।’
‘বেটা দীর্ঘজীবী অইছে।’
‘ঠিক বলেছেন চাচা, গাছ-পালা, পশু-পাখির যারা চাষ করে, তাদের যতœ করে, আল্লাহ তাদের শারীরিক সুস্থতা দেন, হায়াত বাড়িয়ে দেন।’
এমন সময় মসজিদ থেকে আজান শুরু হয়। দীনা মাথায় ঘোমটা ভালভাবে জড়িয়ে ছাদ থেকে নেমে আসে।
লেদু চাচা গাছের এক পাশে জরুরি প্রয়োজনে বসানো কল ছেড়ে হাত মুখ ধোয়। চিলে-কোঠায় একটা তক্তপোষ রাখা। জায়নামাজও সেখানে...। লেদু চাচা কখনও এখানে নামাজ আদায় করেন। আজও সে রকম করলেন।
নামাজ শেষে তসবিহ হাতে দোয়া দরুদ পাঠ করলেন মিনিট দশেক। তারপর মুনাজাত ধরলেন। দীর্ঘ মুনাজাত। চোখের পানিতে তার দুই গন্ড ভিজে একাকার।
‘দাদাজান কী করেন?’
প্রেমার কণ্ঠ শুনে লেদু চাচা সম্বিৎ ফিরে পান। দু’হাত দিয়ে মুখ মুছে দেখেন প্রেমা দাঁড়িয়ে।
‘দাদাজান, আজ আমরা আপনার কাছ থেকে গল্প শুনব।’
জিশানও হাজির পরপর।
লেদু চাচা দু’হাতে জায়নামাজ উঠিয়ে নিতে ওদের দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসতে থাকেন।
‘দাদাজান আপনি হাসছেন না কাঁদছেন?
‘এখন আমি হাসি, তখন আমি আল্লাহর দরবারে কানছিÑ’
‘কেন দাদাজান, কান্না করলেন কেন?’
‘ভাইরে দাদুমনি, জীবনে কতো গুনাহ করছি, হিসাব আছে? আল্লাহর কাছে মাফ চাইছি। আল্লাহ যেইন আমারে মাফ দেইন-’
এমন সময় ধুপ ধাপ, ধুপ ধাপ সিঁড়ি ঘর থেকে আওয়াজ এলো। আওয়াজ ক্রমে জোরে হতে লাগলো। এক সময় থেমে গেল চিলেকোঠার দরোজায় রহমান দাঁড়িয়ে। লেদু চাচা থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াতে যায়।
‘চাচা, আপনি উঠবেন না, ওদের গল্প শোনাচ্ছেন, শোনান আমি একটু আকাশ দেখি- রহমান চক্রাকারে মাথা ঘুরিয়ে আকাশের দিকে মুখ করলো। তারপর চলে এলো টেলিস্কোপ ঘরে। উঁচু একটু টেবিলের ওপর যন্ত্রটা। একটা উঁচু পা-ওয়ালা হাই চেয়ার। যার ওপর রহমান বসে। মাথার ওপর টিনের শেড।
ইচ্ছে মতো ঘুরিয়ে নেয়া যায়।
রহমান এখানে এসে বসলে পৃথিবীটা মিথ্যে হয়ে যায়। তার কাছে।
আকাশ বেশ পরিষ্কার একের একে সৌর জগতের বাসিন্দাদের সনাক্ত করতে থাকে রহমান। এমন সময় দৃষ্টিতে ধরা পড়ে প্লুটো। বেচারা প্লুটো। এতদিন যাকে নবগ্রহের অন্যতম সদস্য বলে মনে করা হতো। কিন্তু ২০০৬ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ভোট দিয়ে ঠিক করলেন প্লুটোকে সৌর জগতের সদস্যপদ দেয়া যাবে না। একটা নতুন শ্রেণীতে বসানো হলো তাকে। বামন গ্রহ। সরকারি খাতায় তার কোনও বিশেষ নামও রইল না। একেবারে নবরতœ সভা থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে অন্যান্য সাধারণ সভাসদদের সঙ্গে বসতে বলা? রহমান সেই আগের প্লুটো গ্রহকে ভালোভাবে দেখছিল। আজ থেকে সত্তর বছর আগে প্লুটো আবিষ্কারে আট বছরের মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথও তাঁর বিশ্বপরিচয়ে এ প্লুটো সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন।
এমন সময় প্রেমা ও জিশান এসে উপস্থিত হলো।
‘আব্বু, কী দেখছো?’
প্রেমা খুব নিচু স্বরে জানতে চায়। ওরা জানে এ সময় ওদের আব্বু গভীর মনোযোগ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেন। জোরে শব্দ করা নিষেধ। প্রেমা ও জিশান ছাদের নিয়ম কানুন মেনে চলে। যেমন গাছের ফুল ফল ছিঁড়ে না। টেলিস্কোপ ঘরে ঢুকে না। দৌড়ঝাঁপ করে না।
‘দেখছি প্লূটোকে, জানি সেতো প্লুটো আর আমাদের সৌর বাসিন্দা না।’
‘হ্যাঁ ভেবেছিলো সেদিন।’ জিশান বলল।
‘প্লুটোকে এখন কী বলা হবে?’
প্লুটোর আর কোন নাম থাকল না। একটা নতুন শ্রেণীতে বসানো হলো তাকেÑ বামন গ্রহ। একটা সংখ্যা দিয়ে তার পরিচয় ১৩৪৩৪০। ‘জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্লুটের ওপর অবিচার করেছেন।-
‘আবিচার বৈকি! এ নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে দলাদলি কম হয়নি। অবশেষে ভোটাভুটিতে বেচারা হেরে গেল প্লুটো।
প্লুটো একটা ব্যতিক্রমী গ্রহ, এটা সবাই অনেক দিন ধরে জানত, গ্রহের চেয়ে গ্রহানুদের সঙ্গেই বেশি মিল। তাই তাকে এক শ্রেণী থেকে সরিয়ে অন্য শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। এই যা, ‘কিন্তু, আব্বু এমনটা প্রাণিজগতে কখনও শুনি না।Ñ’
জিশান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল।
‘যেমন-’ রহমান টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে।
‘যেমন বাদুড় পাখির মতো উড়তে পারে, কিন্তু ডিম পাড়ে না। তাই বলে বাদুড়কে পাখি বলা হবে কি না এই নিয়ে কি প্রাণিবিজ্ঞানীরা কখনও ভোটাভুটি করেছেন?’
হা: হা: হা: রহমান সাথে থাকেন।
‘দেখি তোমরা নম্বরযুক্ত বামন গ্রহকে।’ জিশান এগিয়ে আছে টেলিস্কোপের কাছে। রহমান সরে যান চেয়ার থেকে। জিশান চোখ রাখে যন্ত্রটায়। বিন্দু বিন্দু আলো শুধু দেখা যায়। কোনটা প্লুটো কোনটা ইউরেনাস সনাক্ত করা জিশানের কাজ নয়। কবে আকশরাজ্যের আলোকমালা দেখতে বেশ লাগে।
‘বেচারা প্লুটোর গোড়ার ইতিহাসটাও দুঃখের।’
‘কি রকম-’
‘সম্ভবত ১৯৩০ সালে জানুয়ারি মাসের কন কনে এক শীতের রঙিয়ে টসবাই তাঁর অধ্যবসায়ের ফল পেলেন। দেখতে পেলেন ক্ষীণ আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে। আকাশের গায়ে সরে যাচ্ছে। এতদিন যা ছিল মানুষের অগোচরে সেই দিন দৃশ্যমান হলো। নাম নিয়েও চলে নানা মতভেদ।
রওয়ান নামে একজন যিনি এই গ্রহের ধারণা করেছিলেন তার বিধবা স্ত্রীর দাবি ছিল নাম দেয়া হোক তার স্বামীর নাম ‘পার্সিভাল’। শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের এক স্কুলের ছাত্রী ভেনেশিয়া বার্ণি এর নামকরণ করল গ্রিক পুরাণের পাতালে দেবতা প্লটোর নাম।’
‘হায় হতভাগা প্লুটো। প্রেমা মুখ খুলল।
‘এবার আমি দেখবো। এবার আমার পালা।’
ছাদে আকাশ পর্যবেক্ষণে রহমান যখনই আসেন তার দুই ছেলেমেয়ে সঙ্গে থাকে। আর এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রেখে রহস্যময় আকাশটাকে দেখার সুযোগ পান।
জিসান যথরীতি চেয়ার থেকে নামে। প্রেমা সেই চেয়ারে উঠতে যায়। উঁচু বেশি। রহমান প্রেমাকে কোলে করে চেয়ারে বসিয়ে দেন। যন্ত্রে চোখ রেখে প্রেমা তারা বাতির মতো জ্বলা নক্ষত্র দেখতে দেখতে ভাবে পরীদের দেশটাকে যদি দেখা যেতো।
আচ্ছা, আব্বু পরীস্থানটা কি দেখা যায়?
‘তাইতো, পরীস্থানটা খুঁজতে হবে।’
রহমান হাসেতে হাসতে বলেন।
‘আব্বু, তুমি না বলেছিলে ছোটকালে পরী দেখেছÑ সেই গল্পটা বলবে?
‘পরী দেখার গল্পটা? আজ না মামণি। অনেক রাত হলো বুঝি। ওই দিকে ম্যাডাম দীনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। এমন সময় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল। কৃত্রিম আলোয় আসমানের চাঁদের আলো যেন হারিয়ে গেল মুহূর্তে। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে।
চলো ঘরে ফেরা যাক, পরীর গল্প আরেকদিন শোনা হবে।
রহমান, প্রেমা-জিশান টেলিস্কোপ- ঘর থেকে নিচে নামার জন্য পা বাড়ান। এমন সময় শোনা যায় লেদু চাচার কণ্ঠ। লেদু চাচা ভালো গান জানেন। একদিন আমার জমাতে হবে। রহমান মনে মনে ভাবে।    (চলবে)
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ