জোড়া ঘোড়া

জোড়া ঘোড়া

গল্প আগস্ট ২০১০

মাখরাজ খান জমিদার আর প্রজার ঘোড়া। মাঠে তাদের কথাবার্তা হয়। কথা বলতে বলতে বন্ধুত্ব। একবার কথা বলতে শুরু করলে যেন আর শেষ হতে চায় না। তারা কথা বলতেই থাকে সুখ-দুঃখের কথা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথা। হঠাৎ একদিন জমিদারের ঘোড়ার মনে হয়, কার সাথে কথা বলছি, কার সাথে বন্ধুত্বের জুড় বেঁধেছি। ও কি আমার সমান, ও তো সাধারণ জাতের একটা ঘোড়া, যার না আছে মান ইজ্জত, না আছে ভাল থাকার জায়গা। মাঠে আর কোনো ঘোড়া নেই বলে ওর সাথে কথা বলেছি। তাই বলে কি ও আমার বন্ধু হয়ে গেছে, আমার বন্ধু হতে পারে অন্য কোনো জমিদারের ঘোড়া। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একদিন প্রজার ঘোড়ার কাছে বলেই ফেললো দেখ, তোমার মনিব যেমন সাধারণ মানুষ আর তুমিও তেমনি সাধারণ ঘোড়া। আমার মনিব জমিদার। তিনি আমাকে চিনির শরবত খাওয়ান, ছোলা খাওয়ান। আমার জন্য একজন চাকর রেখে দিয়েছেন, যে আমাকে পুকুরে নামিয়ে গা ঢলে গোছল করাবে, আমার শরীরে কোথাও কোনো আঘাত পেয়েছি কি না দেখার; খাদ্য ঠিকমত খাচ্ছি কি না মনিবকে বলবে। এমনকি আমার থাকার জায়গা যেন নোংরা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখবে। তোমার তো এ সবের বালাই নেই, খাও কুঁড়া, ভুসি খড়। কতকাল পরে দানা চোখে দ্যাখ তার হিসাব নেই। এ জন্যই তো তোমার লোমগুলি রুক্ষ হয়ে গেছে। ঘাড়ের কেশর এলোমেলো হয়ে আছে, তোমার চোখে ক্যাতর আর পায়ে কাদা। দেখ। আমার শরীরে একটুও ময়লা নেই। পায়ে কাদা নেই। সাধারণ ঘোড়াটি বললো, ঠিকই বলেছ। জমিদার যখন তোমার পিঠে সওয়ার হয়, তখন তুমিও তো জমিদার। -গর্বিতভাবে এদিক ওদিক তাকালো জমিদারের ঘোড়া। মনে হলো পারে তো চিৎকার করে জানিয়ে দেয়, হ্যাঁ আমি জমিদার। আমার সাথে অন্য কোনো ঘোড়ার তুলনা চলে না। - কিন্তু বন্ধু বললো সাধারণ ঘোড়া । - বন্ধু বলছো কেন? - সাহেব বল, স্যার বলো। - ঠিক আছে। কিন্তু ঘোড়া সাহেব। আপনি কি আমার মতো দৌড়াতে পারবেন? আমার মতো রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পিঠে বোঝা নিয়ে হাঁটতে পারবেন। - আরে কী যে বল। তা না পারলে জমিদার কি আমাকে এমনি এমনি রেখেছে। জমিদার যখন আমার পিঠে চড়েন তখন আমি দৌড়ালে, জমিন চারপাশের গাছপালা-বাড়িঘর সব আমার পেছেনে পড়ে থাকে- মনে হয় শুধু আমি চলছি আর পৃথিবীর সব কিছু থেমে আছে। তুমি ওসব বুঝবে না। তোমার ওপর তো কেউ সওয়ারই হয় না। আর হলেও ছালা বিছিয়ে সস্তা লাগাম দিয়ে তোমাকে দাবড়ায়। জান, আমাকে যে লাগাম দেয়া হয় তা সোনার। যে রশি দিয়ে লাগাম বাঁধা হয়েছে সেটা নাইলনের আর আমার পিঠে যে গদি চাপান হয় সেটা বিদেশী চামড়ার। যে চাবুক নিয়ে জমিদার সাহেব আমার পিঠে সওয়ার হন, তাতে হিরে লাগানো আছে। সাধারণ ঘোড়াটি মনে মনে বললো, যে চাবুক দিয়ে আঘাত করে তার মধ্যে হীরে আছে বলেও এর গর্ব। শোনা যাক আর কী বলে! জমিদারের ঘোড়াটি আর কিছু বললো না, সে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সাধারণ ঘোড়াটি বললো, শুনুন- - আবার কী বলবে? এতক্ষণ তো আপনার কথা বললেন, এখন আমার কথা শুনুন। - তোমার কথা কি শুনবো, কি-ই বা বলার আছে তোমার? - তেমন কিছু নয়, তবে খড় কুঁড়ো খেয়ে মুক্ত মাঠে ঘুরে ধুলোবালিতে গড়াগড়ি করে এখনো আমার শরীরে যে শক্তি আছে, আপনার কিন্তু রাজকীয় হালে থেকে ও তা নেই। - অসম্ভব। - তাহলে প্রমাণ করুন। - ঠিকই আজ রাতেই তোমার এ কথার প্রমাণ দেবো। জমিদারের ঘোড়াটা আস্তাবলের কাছে চলে গেলো- দানা-পানি খেয়ে শুয়ে পড়লো আস্তাবলের বাইরে। যে লোকটা ঘোড়ার যতœ নিতো সে ঘোড়া বাইরে শুয়ে আছে দেখে মনে করলো আজ গরম দেখে বোধ হয় এখানে শুয়ে আছে- থাক, রাত গভীর হলে একে আস্তাবলের ভেতর ঢুকিয়ে দেবো। ততক্ষণ বিশ্রাম করুক। সে আস্তাবলের পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। যথাসময়ে জমিদারের ঘোড়াটি গিয়ে হাজির হলো সাধারণ ঘোরাটির কাছে, জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলোর যেন বাঁধ ভেঙেছে। - এসেছেন। - হ্যাঁ। - তাহলে দাঁড়ান। - দাঁড়িয়ে কী করবো? - এই যে বিরান ভূমি দেখা যায়, এটাতে আমরা দু’জনে দশটা পাক দেবো। - এটা কোনো ব্যাপার নয়। চল। সবেমাত্র ফসল কাটা হয়েছে, এখানে উঁচু-নিচু জমিতে ছড়িয়ে আছে খাস জঙ্গল, আর মাটির ঢেলা। কোনো কোনো জায়গায় পানিও জমে আছে। - চি হি হি শব্দ করে দৌড়াতে শুরু করলো দুই ঘোড়া। জমিদারের ঘোড়াটি মাঠের মধ্যে এক পাক দিয়েই তার সঙ্গীকে বললো, তুমি তো সারাদিন এ মাঠের মধ্যেই ছিলে, দানা পানিও খাওনি। হয়রান হয়েছ একটু জিরিয়ে নাও। সাধারণ ঘোড়াটি কোনো উত্তর দিলো না। সে পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকলো। দ্বিতীয় রাউন্ডে এসে আবার জমিদারের ঘোড়ার একই কথা, ক্লান্ত হয়েছ রেস্ট নাও। সাধারণ ঘোড়াটি ছোট্ট করে জবাব দিলো- - দরকার নেই। চতুর্থ রাউন্ডে এসে জমিদারের ঘোড়াটি তার প্রতিপক্ষকে ধমক দিয়ে বললো, কী করছ, পড়ে যাবে তো জিরিয়ে নাও। - কোনো ভয় নেই। ঠিকই আছি। এই ভাবে এক রাউন্ড শেষ হয় আর জমিদারের ঘোড়া তার প্রতিপক্ষকে জিরিয়ে নেয়ার কথা বলে, জমিদারের ঘোড়ার পায়ে কাদা, জঙ্গল জড়িয়ে যায় সে দৌড়াতে গিয়ে সামনে বাড়াতে পারে না। শেষে বলে দেখ, তুমি সাধারণ ঘোড়া হলেও আমার বন্ধু। তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই না। জেদের বশে জীবন দেবে? এই বলে সে থেমে যায়। সাধারণ ঘোরাটি দৌড়াতে থাকে, দশটি চক্কর শেষ করে কোনো কথা না বলে। জমিদারের ঘোড়াটি বলে, কী ব্যাপার? - পাগল হলে নাকি? এই কাদা জঙ্গলের মধ্যে সারারাত দৌড়াবে? - আরো দশটা চক্কর মারবো তার পর থামবো। জমিদারের ঘোড়াটি শুয়ে শুয়ে এখনো হাঁপাচ্ছে। তার এখন বোধোদয় হয়েছে। কাউকে ছোট ভাবতে নেই নিজের বুদ্ধি আর শক্তির অহঙ্কার করলে এভাবেই বেইজ্জতি হতে হয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ