টাইটানিক থেকে টাইটান

টাইটানিক থেকে টাইটান

ফিচার লতিফুর রহমান সেপ্টেম্বর ২০২৩

বন্ধুরা, টাইটানিক জাহাজের নাম শুনেছো নিশ্চয়। হ্যাঁ, আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় চার কিলোমিটার গভীরে ডুবে রয়েছে জাহাজটি। টাইটানিক একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো জাহাজ ছিল। সেই জাহাজ কীভাবে ডুবে গিয়েছিল সেই আলাপ পরে করছি। তার আগে বলি টাইটানিককে দেখতে গিয়ে সাগরের মধ্যে সম্প্রতি কী ঘটে গেল। 

টাইটানিক জাহাজ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। জাহাজটিকে কাছ থেকে দেখার জন্য ডুবোজাহাজে চড়ে অনেকেই গিয়েছে সাগরের তলদেশে। তাদের ভিডিও ইউটিউবে নিশ্চয় তোমরাও দেখেছো।

যাইহোক, টাইটানিককে দেখতে গত ১৮ জুন পাঁচ আরোহী উঠে পড়েন ‘টাইটান’ নামের ডুবোজাহাজে। এটি বেশ ছোটো। সাকুল্যে চার যাত্রী ও চালক এটাতে চড়তে পারেন। এর ভেতরে সবাইকে মেঝেতে বসে থাকতে হয়। উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। তবে এতে চড়ে সাগরের গভীরে গিয়ে টাইটানিককে ভালোভাবেই দেখা যায়। জেনে রাখা ভালো, সাগরের নিচে টাইটানিক দেখতে যাওয়ার এই ভ্রমণে অনেক খরচ হয়। একেক জনের প্রায় আড়াই কোটি টাকা। 

এসো সেদিন টাইটানের সেই পাঁচ আরোহী সম্পর্কে জেনে নিই। তাদের মধ্যে ছিলেন, টাইটানের মালিকানা কোম্পানি ওশেনগেটের প্রতিষ্ঠাতা সিইও স্টকটন রাসম, ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ধনী শাহজাদা দাউদ ও তার ছেলে সুলেমান দাউদ, আরেক ব্রিটিশ ধনী হামিস হার্ডিং এবং চালক পল-হেনরি নারগোলেট। 

১৮ জুন সকাল ৮টা। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে তাদের ডুবোযান টাইটান পানির নিচে রওনা হয়। যাত্রীদের প্রত্যেকে ছিলেন টাইটানিক দেখার আনন্দে শিহরিত। ভেতরে থাকা স্ক্রিনে পানির নিচের দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। চালকের হাতে ছিল একটা ভিডিও গেম কন্ট্রোলার। ওইটা দিয়ে তিনি গতি ও দিক ঠিক করছিলেন। ডুবোযান টাইটানকে রওনা করিয়ে পানির ওপরে অপেক্ষা করছিল একটি সহায়তাকারী জাহাজ। সাত ঘণ্টার সফর শেষে টাইটানের ফেরার কথা বিকাল ৩টায়। 

যাত্রা শুরুর ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর ওপরে থাকা জাহাজের সাথে টাইটানের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারিগরি ত্রুটি মনে করে ওপরে থাকা জাহাজের লোকেরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু বেলা ৩টায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাইটান না ফেরায় শুরু হয় টানটান উত্তেজনা। তখন খবর দেওয়া হয় আমেরিকার কোস্টগার্ডকে। তারা খুঁজতে শুরু করে। তবে বিশাল এই আটলান্টিক সাগরে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। সাগরের গভীরতা ওখানে চার কিলোমিটার! যত গভীরে যাওয়া যায় তত পানির চাপ বাড়তে থাকে। এত নিচে সব ডুবোজাহাজ যেতেও পারে না।

উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল যখন জানা গেল এর ভেতরে ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকা যাবে। এরপর অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে ভেতরে থাকা সবাই মারা যাবে। আফসোস কয়েক দিন বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও টাইটানের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। সবার পেরেশানি হতাশায় পরিণত হলো। অবশেষে চারদিন টানা খোঁজাখুঁজির পর টাইটানিকের ১৬০০ ফুট দূরে সাগরের তলদেশে পাওয়া গেল বিধ্বস্ত টাইটানকে।

মূলত অত্যধিক পানির চাপে বিস্ফোরিত হয়েছে টাইটান। যদিও এর অন্তত আগে দশবার সে আটলান্টিকের তলদেশে গিয়েছে। অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এ যাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মারা গেল এর ভেতরে থাকা পাঁচ আরোহীর সবাই। টাইটানের ভাঙাচোরা অংশ অবশ্য সাগর থেকে উঠানো হয়েছে। শুরু হয়েছে বিস্তারিত গবেষণা। 

২০২১ সালে টাইটান প্রথম পর্যটন যাত্রা শুরু করে। এটি ২২ ফিট লম্বা, গতি ঘণ্টায় ৫.৫ কিলোমিটার। এটাকে অবশ্য সাবমেরিন বলা হয় না। কারণ, টাইটানকে সমুদ্র বন্দর থেকে অন্য একটি সাহায্যকারী জাহাজে করে টাইটানিকের ঘটনাস্থলে নেওয়া হতো। অতঃপর সেখান থেকে সমুদ্রের তলদেশে যাত্রা করতো। সফর শেষে পানির ওপরে ভেসে উঠলে আবার সেই জাহাজে করে বন্দরে নেওয়া হতো। এজন্য একে সাবমেরিন না বলে সাবমার্সিবল বলা হয়। তবে গবেষকরা বলছেন, এটিতে ত্রুটি ছিল। খরচ কমাতে কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি। যার ফলে বিস্ফোরিত হয়েছে। 

বন্ধুরা, যেই টাইটানিক দেখতে এত আয়োজন সেটি আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায় ১১১ বছর আগে ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিলে। এর পুরো নাম হচ্ছে আরএমএস টাইটানিক। তৎকালীন বিশ্বে টাইটানিক ছিল সবচেয়ে বড়ো জাহাজ। নির্মাতারা গর্ব করে বলতো, এই জাহাজ কখনো ডুববে না। 

অথচ প্রথম সফরেই ঠান্ডা বরফ খণ্ডে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় টাইটানিক। জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছিল ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে এবং গন্তব্য ছিল আমেরিকার নিউ ইয়র্ক। পথিমধ্যে টাইটানিক ডুবিতে মারা যায় ১৫১৪ যাত্রী। জাহাজ ডুবিতে এত মানুষের মৃত্যু পৃথিবী তার আগে দেখেনি। তবে সে যাত্রায় ৭১০ যাত্রী ও নাবিক ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পান। লাইফ বোটের সহযোগিতায় অন্য একটি জাহাজে তারা উঠতে পেরেছিলেন।

ডুবে যাওয়ার সময় ছাড়াও আরও দুটি সময়ে টাইটানিক সারা বিশ্বে আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যে ১৯৮৫ সালে সাগরের তলদেশে টাইটানিকের সন্ধান পাওয়া যায়। তখন ঘটনাটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই সন্ধান অভিযানে নেতৃত্ব দেন আমেরিকান নেভি অফিসার রবার্ট ব্যালার্ড। পানির চার কিলোমিটার গভীরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে সেই আমলে টাইটানিককে খুঁজে পাওয়া বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল বটে।

অতঃপর ১৯৯৭ সালে টাইটানিক নিয়ে হলিউড সিনেমা তৈরি করে হইচই ফেলে দেন পরিচালক জেমস ক্যামেরুন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছিল। সেই সাথে ছিল রোমান্সকর সব ঘটনা এবং আবেগের ছড়াছড়ি। ফলে বিশ্বব্যাপী দারুণ আলোচিত হয় টাইটানিক সিনেমা। টাইটানিক নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হলেও জেমস ক্যামেরুনের সিনেমা এখনও অবাক করা। সিনেমাতে টাইটানিক ডুবে যাওয়ার দৃশ্য ছিল খুবই নিখুঁত ও হৃদয়স্পর্শী।

যাইহোক, আবিষ্কারের নেশা মানুষের চিরন্তন। আবার এই আবিষ্কার করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় বহু মানুষ প্রাণও দিয়েছে। টাইটানিক ও টাইটানের দুর্ঘটনাতে আমরা সেটাই দেখতে পেলাম। তবে বিশেষ কিছু নির্মাণ করতে পারলে অযথা বড়াই করা ঠিক না। অহঙ্কার পতনের কারণ এটা যেন আমরা ভুলে না যাই। অহঙ্কার শুধুমাত্র আল্লাহ করতে পারেন, আর কেউ নয়। অহঙ্কারের পরিবর্তে আমরা করবো আল্লাহর শুকরিয়া আদায়। মনে থাকবে তো?

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ