ডাইনি-মা আর রাজকন্যার গল্প

ডাইনি-মা আর রাজকন্যার গল্প

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নাজিব ওয়াদুদ #

অনেক দিন আগের কথা। তখন দেশগুলো ছিল ছোট ছোট। সেই রকম এক ছোট্ট দেশে এক জমিদার ছিল। লোকে তাকে রাজাই বলত। তার ছিল এক রানী। আর ছিল তাদের হীরের টুকরো দু’টি সন্তান। বড়টি মেয়ে, তার নাম সুলতানা। ছোটটি ছেলে, তার নাম শুভ। দুই ভাইবোন যেন মানিকজোড়। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না। পরস্পরকে খুব ভালোবাসে ওরা। দেখে পিতামাতার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তারা সন্তানদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন- ‘হে পরওয়ারদিগার, তুমি আমাদের সন্তানদের হেফাজত কোরো। ওদের তুমি সুখে-শান্তিতে রেখো।’ দিনকাল ভালোই চলছিল ওদের। হঠাৎ একদিন জমিদার-গিন্নির জ্বর হলো। কয়েকদিনের জ্বরেই তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। রাজ্যের সব কবিরাজ-হেকিম মিলেও কিছু করতে পারল না। সবাইকে শোক-সাগরে ভাসিয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেন। মাকে হারিয়ে খুব কাঁদল দুই ভাইবোন। ধীরে ধীরে সে শোকও তারা সামলে নিলো। সুলতানা ও শুভ আবার খেলতে লাগল, ওস্তাদের কাছে পড়তে বসল। একদিন জমিদার শিকারে গেলেন। ফেরার সময় একটা সুন্দরী মেয়েকে সঙ্গে করে আনলেন। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে সুলতানা বলল, ‘আব্বু, উনার চোখগুলো কেমন জ্বলজ্বল করে। মনে হয় ডাইনি।’ আব্বু বললেন, ‘ছিঃ মা। ওভাবে বলতে নেই। উনি তোমাদের মা হবেন।’ মেয়েটির সঙ্গে সুলতানার বয়সী একটি মেয়েও ছিল। সে নাকি ডাইনিটার কন্যা। দেখতে ভারি কুৎসিত। শুভ বলল, ‘এই মেয়েটা এত কুৎসিত কেন আব্বু?’ আব্বু বললেন, ‘না বাবা, মানুষকে কুৎসিত বলতে নেই। আল্লাহর সৃষ্টি সবই সুন্দর। ও তোমাদের বোন হবে। ওর সঙ্গে খেলবে তোমরা।’ মেয়েটাকে জমিদার বিয়ে করলেন। পিতার কথা শুনে সব কিছু মেনে নিল সুলতানা ও শুভ। না মেনেই বা করবে কী? ওরা যে ছোট, অনেক ছোট। কিন্তু তাদের খুব খারাপ লাগল। তারপর কী যে হলো, তাদের সংসারে নেমে এলো একের পর এক দুর্গতি। নিলামে উঠতে লাগল জমিদারের জমি। এদিকে নতুন স্ত্রী-কন্যার বায়নার শেষ নেই। অসুস্থ হয়ে পড়লেন জমিদার। সুলতানা ও শুভ মিলে পিতার সেবা-শুশ্রƒষা করতে লাগল। তাদের সৎ-মা তার মেয়েকে নিয়ে আমোদ-ফুর্তি করে বেড়াতে লাগল। জমিদার সুলতানা ও শুভকে ডেকে বললেন, ‘আমি ভুল করেছি বাবারা। তোমরা আমাকে মাফ করে দিও।’ আর বেশি দিন বাঁচলেন না তিনি। বাপ-মাকে হারিয়ে পুরোপুরি এতিম হয়ে গেল সুলতানা ও শুভ। সৎ-মা ও তার মেয়ে বাড়ির মোড়ল হয়ে গেল। তারা যখন যা খুশি তখন তাই করে। আর শুধু হম্বি-তম্বি তাদের দু’জনের ওপর। এটা কর, ওটা কর, শুধু হুকুমের ওপর হুকুম। চাকর-চাকরানির চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে শুধু কাঁদে তারা। তাদের অত্যাচার-নির্যাতন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। একদিন সইতে না পেরে ছোট্ট ভাইটি বোনটির হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘আম্মা-আব্বা মারা যাবার পর থেকে আমাদের সুখ হারিয়ে গেছে। সৎ-মা ও তার মেয়েটা প্রত্যেকদিন আমাদের মারধর করে। তাদের কাছে গেলে তারা আমাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দেয়। আমাদের খেতে দেয় শুকনো বাসি রুটি। উঠোনে শুয়ে থাকা কুকুরটা বরং আছে বেশ, কারণ সে মাছ-মাংসের ঝোলমাখা ভাত খেতে পায়। চলো, আমরা এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। খোদার এই বিশাল পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আমাদের নিশ্চয় একটা ঠাঁই মিলবে।’ সুলতানাও বেশ কিছুদিন থেকে এই কথা ভাবছিল। ছোট্ট প্রিয় ভাইটার দুঃখে তার প্রাণ কেঁদে উঠল। সেদিনই তারা চুপিচুপি বাড়ি ছেড়ে বের হলো। Ñ‘খোদা, আমাদের ওপর রহম করো!’ সারাটা দিন হাঁটল তারাÑ শস্যক্ষেত, মাঠ, এবং পাথুরে পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল অনির্দেশের পথে। একটা মাঠ পাড়ি দেবার সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। ছোট্ট ভাইটি বলল, ‘আকাশ আমাদের দুঃখে কাঁদছে।’ দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামল। বড্ড ক্লান্ত তারা। সারাদিন এতটুকু দানা-পানি পড়েনি পেটে। পা আর চলতে চায় না। সন্ধ্যায় একটা বড় বনের কাছে পেঁৗঁছল। দুঃখ, ক্ষুধা এবং দীর্ঘ ভ্রমণে তারা এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। একটা বিশাল বটগাছের গোড়ায় ওরা বসল, এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন যখন জাগল, সূর্য ততক্ষণে আকাশের ওপরে উঠেছে, গাছের নিচে গরম রোদ ঢালছে। ভাইটি বলল, ‘আমার পিপাসা পেয়েছে। কোনো নদী-টদী পেলে সেখানে যেতাম এবং তার পানি পান করতাম।’ হঠাৎ কিসের শব্দে কান খাড়া করল সে, বলল, ‘কেমন কলকল শব্দ! মনে হচ্ছে পাহাড়ি নদী। বা ঝর্ণা।’ শুভ উঠল এবং বোনের হাত ধরে বলল, ‘চলো দেখি গিয়ে।’ তারা নদীর খোঁজে ছুটল। ওদিকে তাদের সৎ-মা তাদেরকে ডেকে ডেকে না পেয়ে তার যাদুর আয়না বের করল। মেয়েটি আসলেই একটা ডাইনি, যাদুকরী। সে আয়নায় দেখতে পেল শুভ ও সুলতানা হাত ধরাধরি করে বনের পথে হেঁটে চলেছে। রাগে তার শরীর কামড়াতে লাগল। তার কুৎসিত মেয়েটি বলল, ‘আমাদের কাজ করে দেবে কে? ধরে আনো ওদের।’ সৎ-মা তার আসল রূপ ধারণ করল, এবং গোপনে তাদের পিছু নিলো। সেই বড় বনে ছিল ঝর্ণার মত অনেকগুলো ছোট ছোট নদী। ডাইনিটা বনের সব ক’টা নদীকে যাদুর বলে খারাপ করে দিল। শুভ দেখল একটা নদী পাথরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। সে ছুটে গেল তার কাছে। নদীর স্বচ্ছ পানি দেখে তার পিপাসা আরো বেড়ে গেল। কিন্তু বোনটি হঠাৎ চমকে উঠল। নদীটা কথা বলছে! স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে, নদীটা বলছেÑ ‘করবে যে পান আমার পানি বাঘ হবে সে নিশ্চয় জানি।’ সুলতানা চিৎকার করে উঠল, ‘থামো, শুভ, ভাইটি আমার! ঐ পানি পান কোরো না, করলে তুমি হিংস্র বাঘ হয়ে যাবে, এবং আমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলবে।’ বোনের কথায় থমকে দাঁড়াল শুভ। উঠে এল নদী থেকে। বলল, ‘খুবই তৃষ্ণার্ত আমি। তবু ক্ষান্ত হলাম। পরে আর বারন কোরো না।’ আবার হাঁটতে শুরু করল ওরা। সামনে আর একটা নদী পড়ল। তার কাছে ছুটে গেল শুভ। কান খাড়া করল সুলতানা। এবং অবাক হয়ে শুনল নদীটা বলছেÑ ‘করবে যে পান আমার পানি নেকড়ে হবে সে নিশ্চয় জানি।’ তখন বোনটি চিৎকার করে বলল, ‘শুভ! খবরদার না, ঐ পানি পান কোরো না, করলে তুমি নেকড়ে হয়ে যাবে। তখন আমাকে কামড়ে খেয়ে ফেলবে তুমি!’ দারুণ পিপাসায় কাতর ভাইটি, তবু বোনের কথায় থমকে দাঁড়াল। ‘তোমার কথা আমি না শুনে পারি না। কিন্তু পিপাসায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। এরপর আমি আর শুনব না।’ তারপর যখন তারা তৃতীয় ঝরনার কাছে পৌঁছল তখন বোনটি শুনতে পেল, নদীটা বলছেÑ ‘করবে যে পান আমার পানি হরিণ হবে সে নিশ্চয় জানি।’ বোনটি করুণ কণ্ঠে বলল, ‘ওহ, আমি অনুরোধ করছি প্রিয় ভাইটি আমার, আর একবার অন্তত আমার কথা রাখো। এই পানি পান কোরো না, করলে তুমি হরিণ হয়ে যাবে এবং আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তোমাকে বাঘ-নেকড়েরা ধরে খাবে। না হয় শিকারিরা বন্দুক ছুঁড়ে মারবে তোমাকে।’ কিন্তু ভাইটি শুনল না, পিপাসায় তার প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। সে হাঁটু গেড়ে নদীতে নামল, এবং সামান্য পানি পান করল। যেই না ঠোঁটে পানি ছোঁয়ানো, অমনি সে একটা হরিণছানায় পরিণত হল। দুঃখে-শোকে হরিণ-ভাইটিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল সুলতানা। ছোট্ট হরিণরূপী শুভও তাদের করুণ পরিণতি দেখে চোখ ভাসিয়ে কাঁদল। শেষে সামলে নিয়ে বোনটি বলল, ‘শান্ত হও, প্রিয় ছোট্ট হরিণছানা ভাইটি আমার! আমি কক্ষণো তোমাকে ছেড়ে যাব না। তুমিও আমাকে ছেড়ে যেও না।’ হরিণছানা তার গায়ে মুখ ঘষতে লাগল। সুলতানা তার মাথার সোনালি ফিতা খুলে সেটা হরিণের গলায় পেঁচিয়ে পাক দিয়ে দড়ি বানাল। এইভাবে সে ছোট্ট প্রাণিটাকে বাঁধল এবং টেনে নিয়ে চলল বনের গভীরে। দীর্ঘপথ অতিক্রম করার পর তারা গিয়ে পৌঁছল একটা কুঁড়েঘরের কাছে। একটু ঠেলা দিতেই ঘরের দরজা খুলে গেল। ভেতরে চোখ বুলিয়ে সুলতানা দেখল ঘরটি একেবারেই ফাঁকা, অনেকদিন কেউ এখানে বাস করে না। সে মনে মনে বলল, ‘আমরা এখানে থাকতে পারি।’ বন থেকে পাতা ও হোগলা খুঁজে এনে বিছানা পাতল সুলতানা। এখন প্রত্যেক দিন সকালে সে বাইরে যায় এবং নিজের জন্যে ফল-মূল, আর হরিণের জন্য নরম ঘাস সংগ্রহ করে আনে। ভাইটিকে হাতে ধরে আদর করে খাওয়ায়। তখন হরিণছানাটি খুশিতে তার চারপাশে ঘোরে, আর খেলে। সন্ধ্যার পর রাত ঘনিয়ে আসে। ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যায় গোটা বন। তখন ক্লান্ত সুলতানা হরিণকে পাশে নিয়ে তার পিঠের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। ভাইটিকে গল্প শোনায় আর ভাবে, ইস! একমাত্র ভাইটা যদি আবার মানুষ হয়ে উঠত! তাহলে কতই না আনন্দের ব্যাপার হত! কবে যে সে সৌভাগ্য হবে! দোয়া করে সেÑ ‘আল্লাহ, রহম করো মালিক। তুমি আমার ভাইকে আবার মানুষ করে দাও। আমাদের দুর্ভোগ থেকে উদ্ধার করো।’ এই ভাবে তাদের দিন যাচ্ছিল। ভালই চলছিল। এই বনের ওপাশে যে দেশ তার রাজা তরুণ বয়সী। অকালে পিতার মৃত্যুর কারণে তাকে সিংহাসনে বসতে হয়েছে। তা না হলে এই বয়সে তার খেলে বেড়ানোর কথা। খুবই শিকারপ্রিয় মানুষ সে। যখন-তখন শিকারে বেরিয়ে পড়া তার সখ। একদিন সে মন্ত্রীকে ডেকে বলল, ‘শিকারে যাব আমি। ব্যবস্থা করুন।’ বৃদ্ধ মন্ত্রী একদল পেশাদার শিকারি ও নিরাপত্তারক্ষীসহ এক বিশাল বাহিনী ঠিক করে রাজাকে বলল, ‘এবার দিন-ক্ষণ ঠিক করে বেরিয়ে পড়–ন হুজুর।’ পরদিনই আল্লাহর নাম নিয়ে রাজা বিশাল বাহিনী নিয়ে শিকারে বের হলেন। বনে যেন সাড়া পড়ে গেল। এই বনে এত বড় শিকারি বাহিনী এর আগে কখনো শিকারে আসেনি। হাতির ডাক, কুকুরের চিৎকার, শিঙাধ্বনি এবং শিকারিদের চেঁচামেচিতে গোটা বন সরগরম হয়ে উঠল। ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল সুলতানা। তার আসল ভয় হরিণ ভাইটিকে নিয়ে। সত্যিকার হরিণ মনে করে শিকারিরা যদি তাকে মেরে ফেলে! কিন্তু খোদ হরিণরূপী শুভই চঞ্চল হয়ে উঠল। এমন জমজমাট শিকার-অভিযান রেখে ঘরে বন্দী হয়ে থাকা তার কাছে কষ্টকর হয়ে উঠল। ‘ওহ,’ সে বোনকে বলল, ‘আমাকে ওদের কাছে যেতে দাও, আমি আর তিষ্ঠাতে পারছি না।’ সে এমনই কাকুতি-মিনতি করতে লাগল যে, শেষ পর্যন্ত ভাই-অন্তপ্রাণ বোনটির মন গলে গেল। ‘কিন্তু,’ সে তাকে বলল, ‘সন্ধ্যায় ফিরে আসবে। বর্বর শিকারিদের ভয়ে আমাকে ঘর বন্ধ করে রাখতে হবে, সুতরাং দরজায় কড়া নাড়বে, আর বলবে, ‘প্রিয় বোন আমার, আমাকে ভেতরে আসতে দাও।’ এটা তোমার পাসওয়ার্ড। এটা শুনে আমি বুঝব তুমি এসেছ, অন্য কেউ নয়। আর যদি তা না বলো তাহলে আমি দরজা খুলব না।’ ঘাড় নেড়ে তরুণ হরিণছানাটি লাফাতে লাফাতে চলে গেল। খুব খুশি সে, মুক্ত বাতাসে তার আনন্দের শেষ নেই। রাজা এবং তার শিকারিদের আশপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল হরিণরূপী শুভ। রাজার বিশাল বাহিনী, শিকারিদের বন্দুক, হাতি আর কুকুর দেখে ভয় পেয়েছে সে। তাই কাছে ঘেঁষতে সাহস পেল না। কিন্তু বিকেলের দিকে সুন্দর প্রাণিটার ওপর নজর পড়ল তাদের। তার পিছু নিল কয়েকজন শিকারি, কিন্তু ধরতে পারল না। এই ভাবে পাওয়া গেছে নাগালের মধ্যে, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে হরিণটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড় লাগায়, তাকে আর দেখা যায় না। এক সময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনাল, এবং বন ছাপিয়ে রাত নামল। তখন সে কুটিরের কাছে গিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বলল, ‘প্রিয় বোন আমার, আমাকে ভেতরে আসতে দাও।’ তখন দরজা খুলে গেল এবং সে লাফ দিয়ে ভেতরে ঢুকল। বোনকে তার সারা দিনের হৈচৈ আর আনন্দের কথা শোনাতে শোনাতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে সুলতানা ভাবতে লাগল, হরিণ না হয়ে যদি ভাইটি আমার মানুষ হয়েই থাকত, তাহলে শিকারিদের সঙ্গে শিকারে যোগ দিতে পারত। তখন তারও এত ভয় করত না। হায় আল্লাহ, কবে যে আবার সেই সৌভাগ্য হবে! পরদিন নতুন করে শিকার শুরু হল, এবং যখন হরিণছানা বিউগলের আওয়াজ এবং শিকারিদের হইহই চিৎকার শুনতে পেল তখন তার মনের শান্তি উবে গেল। সে ছটফট করতে লাগল। তারপর তিষ্ঠাতে না পেরে বোনকে বলল, ‘আমাকে যেতে দাও। তা না হলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।’ নানান ভয়-ভীতি ও আশঙ্কার কথা বলেও ভাইটিকে বশ করতে না পেরে অগত্যা বোনটি দরজা খুলে দিল, এবং বলল, ‘ওদের কাছে ঘেঁষবে না। আর অবশ্যই সন্ধ্যায় এখানে ফিরে আসবে এবং পাসওয়ার্ডটি বলবে।’ গলায় সোনালী ফিতাওয়ালা বাচ্চা হরিণটা আবার রাজা এবং তার শিকারিদের নজরে পড়ল। এবার তারা সবাই মিলে তাকে তাড়া করল। কিন্তু সে দ্রুত, ক্ষিপ্র গতিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। সারাদিন ধরে চলল এই রকম, যেন লুকোচুরি খেলা। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে শিকারিরা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল, এবং একজনের একটা গুলি তার ছোট্ট পা ছুঁয়ে চলে গেল। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়াল। সেই শিকারি তার পিছু নিয়ে কুটির পর্যন্ত এল, এবং দেখল হরিণটা কথা বলছে। সে অবাক হয়ে শুনল তার কথাÑ ‘প্রিয় বোন আমার, আমাকে ভেতরে আসতে দাও।’ তারপর আরো অবাক হয়ে দেখল, কুঁড়েঘরের দরজা খুলে গেল। সে দ্রুত ভেতরে ঢুকল এবং তৎক্ষণাৎ দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অবাক শিকারি রাজার কাছে গিয়ে সব খুলে বলল। ছোট্ট ভাইটিকে আহত দেখে বোনটি খুব ভয় পেয়ে গেল। সে তার পায়ের রক্ত ধুয়ে দিল, এবং লতাপাতা দিয়ে ক্ষতটা বেঁধে দিয়ে বলল, ‘এখন শুয়ে পড়, প্রিয় হরিণছানা ভাইটি আমার! আল্লাহর রহমতে তুমি আবার সুস্থ হয়ে উঠবে।’ আঘাতটা ছিল সত্যিই সামান্য, পরদিন ভোরে শুভর অনুভব হলো সে ভাল হয়ে গেছে। একটু পরেই আবার শিকারিদের শোরগোল শুরু হলো। শুভ বলল, ‘আমি আর বসে থাকতে পারছি না, আমাকে অবশ্যই সেখানে যেতে হবে। তুমি ভেব না, ওরা সহজে আমাকে ধরতে পারবে না।’ বোনটি চিৎকার করে বলল, ‘এবার ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। এই বনে আমি একা হয়ে যাবো। দুনিয়ায় আমার আর আপন বলতে কেউ থাকবে না। আমি তোমাকে বাইরে যেতে দেব না।’ ভাইটিও জেদ ধরল, ‘তাহলে আমি দুঃখে মরে যাব।’ সে বলল, ‘যখন আমি বিউগলের শব্দ শুনি তখন মনে হয় আমার হৃৎপিন্ডটা ছুটে বেরিয়ে যাবে শরীর থেকে। দোহাই তোমার, আমাকে যেতে দাও।’ দরজা খুলে দেয়া ছাড়া দুঃখ ও উদ্বেগে কাতর বোনটির গত্যন্তর রইল না। হরিণছানা আনন্দে লাফাতে লাফাতে বনের মধ্যে হারিয়ে গেল। রাজা আজ হরিণটাকেই খুঁজছিলেন। দুপুরের দিকে তার দেখা মিলল। রাজা তার শিকারিদের বললেন, ‘ওকে সারাদিন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াও যতক্ষণ না রাত নামে। কিন্তু সাবধান, তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।’ শিকারিরা হরিণ নিয়ে মেতে উঠল। এক সময় সূর্য অস্ত গেল। তখন রাজা শিকারিকে বললেন, ‘এবার চলো, আমাকে কুটিরের কাছে নিয়ে চলো।’ কুটিরের দরজায় করাঘাত করে রাজা বললেন, ‘প্রিয় বোন আমার, আমাকে ভেতরে আসতে দাও।’ দরজা খুলে গেল। রাজা ভেতরে ঢুকলেন, এবং দেখলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে, এমন সুন্দরী মেয়ে এর আগে কখনো দেখেননি তিনি। সুলতানা যখন দেখল হরিণ নয়, তার বদলে ঢুকেছে মাথায় সোনার মুকুট পরা একটা মানুষ, তখন সে ভয় পেল। রাজা তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন, বললেন, ‘ভয় নেই, আমি এই দেশের রাজা।’ তাকে সালাম জানাল সুলতানা। তার আচরণে খুব খুশি হলেন রাজা। তক্ষুনি মনস্থির করে ফেললেন তিনি। হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে আমার রাজপ্রাসাদে যাবে? আমি তোমাকে আমার রানী বানাতে চাই।’ ‘তার জন্যে এর চেয়ে সৌভাগ্যের আর কী হতে পারে?’ মনে মনে ভাবল সুলতানা। কিন্তু ভাইটির কী হবে? সে বলল, ‘জাহাঁপনা চাইলে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু...!’ রাজা বললেন, ‘তোমার কোনো শর্ত আছে? থাকলে বলে ফেলো। আমি তা পূরণ করব।’ ‘না, তেমন কিছু নয়,’ মেয়েটি উত্তর করল, ‘ছোট্ট হরিণটা আমার সাথে যাবে, আমি তাকে ছেড়ে থাকতে পারব না।’ ‘ও! বেশ,’ রাজা বললেন, ‘তুমি যতদিন বাঁচবে ততদিন সে তোমার সঙ্গে থাকবে। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’ ঠিক সেই মুহূর্তে হরিণটা দৌড়ে এসে বোনের কোলে লাফিয়ে পড়ল। তারপর শিকারিদের নেতাকে দেখে ভারি অবাক হলো সে। আরো অবাক হলো যখন জানতে পারল লোকটা পার্শবর্তী দেশের রাজা এবং তার বোনকে রানী বানাতে চায়। সে আনন্দে পেছনের পা তুলে ঘরের মধ্যেই তাদেরকে ঘিরে কয়েকটা পাক খেল। কিন্তু তাতে না মজে অভিজ্ঞ গৃহিনীর মত সুলতানা লতায় পাকানো দড়ি দিয়ে বাঁধল তাকে। তারপর তাকে নিয়ে রাজার সঙ্গে কুটির ছেড়ে গেল। রাজা সুন্দরী মেয়েটিকে ঘোড়ায় তুলে তার রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন এবং মহা ধুমধামে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন। হতভাগ্য সুলতানা এখন রানী, এবং তারা সুখে বসবাস করতে লাগল। হরিণটিও যতœ পেতে থাকল, সে সারাদিন রাজপ্রাসাদের বাগানে দৌড়ে বেড়ায়। ডাইনি সৎ-মা ভেবেছিল মেয়েটাকে বনের পশুরা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে, আর হরিণরূপী ছেলেটা মরবে শিকারিদের গুলিতে। কিন্তু যখন দেখল তা না হয়ে তারা পেয়ে গেল আনন্দময় রাজকীয় জীবন, তখন হিংসা ও ঘৃণায় তার অন্তর জ্বলে উঠল। তার মনের শান্তি উধাও হয়ে গেল, এবং সে একটা কথাই শুধু ভাবতে লাগল কী করে তাদেরকে আবার বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলা যায়। আর তার হিংসুটে মেয়েটাও তার কানের কাছে অনবরত ঘ্যানর ঘ্যানর করতে লাগলÑ ‘রানী! সেটা তো আমার হওয়ার কথা।’ ‘শান্ত হ’ বাছা,’ বৃদ্ধা ডাইনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘শুধু সময়ের জন্যে অপেক্ষা। আমি প্রস্তুত হয়েই আছি।’ সময় এগিয়ে চলল এবং রানীর একটা ফুটফুটে সুন্দর ছেলে হলো। তখন রাজা বাইরে শিকারে ছিলেন। বৃদ্ধা ডাইনি চাকরানীর রূপ নিয়ে রানীর ঘরে ঢুকে বলল, ‘আসুন, গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গোসল করলে ভাল লাগবে, এবং শরীরে শক্তি ফিরে পাবেন। চলুন, পানি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’ তার কন্যাটিও কাছেই ছিল, তারা দু’জনে মিলে দুর্বল রানীকে গোসল-ঘরে নিয়ে গেল, এবং সেখানে তাকে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। গোসল-ঘরে তারা আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল, তার এতটাই তাপ যে খুব দ্রুত তরুণী রানীর দম বন্ধ হয়ে এল। এদিকে বৃদ্ধা ডাইনি তার কন্যাকে রানী সাজিয়ে রানীর বিছানায় শুইয়ে দিল। তার আকার-আকৃতি ও চেহারাও রানীর মত করে দিল। কেবল তার নষ্ট চোখটা ঠিক করতে পারল না। তাতে অসুবিধা নেই, কারণ যেদিকের চোখ নষ্ট সেদিকে কাত হয়ে শুবে সে, রাজা সেটা দেখতে পাবে না। সন্ধ্যায় প্রাসাদে ফিরে রাজা শুনলেন যে তার একটা ছেলে হয়েছে। তিনি ভীষণ খুশি হলেন, এবং ছুটে গেলেন স্ত্রীকে দেখতে। কিন্তু বৃদ্ধা মেয়েটি দ্রুত তাকে ডাকল, ‘থামুন, জাহাঁপনা, তাকে বাঁচাতে চাইলে পর্দা টেনে দিন, রানীর এখনো আলো দেখা উচিত হবে না। তাকে বিশ্রামে থাকতে দিন।’ হতাশ হয়ে রাজা চলে গেলেন। তিনি হতাশ হলেন, কিন্তু রানীর কল্যাণ চিন্তা করে মেনে নিলেন। সেদিন মাঝ রাতে রাজপ্রাসাদের নিচে প্রহরীরা ছাড়া আর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওপরে দোলনার পাশে একমাত্র জেগে রয়েছে একজন নার্স। তার প্রায় তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। হঠাৎ সে দেখল ঘরের দরজা খুলে গেল। ভারি অবাক কান্ড! সে-ও যে রানী! অথচ বিছানায় শুয়ে আছে আরেক রানী। সে কৌতুহল চাপতে না পেরে চুপিচুপি তার পিছু নিল। আগন্তুক মেয়েটি ভেতরে ঢুকল। সে দোলনা থেকে বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল এবং বুকের দুধ খাওয়াল। তারপর শিশুটার বালিশটা ঝেড়ে গুছিয়ে পুনরায় তাকে শুইয়ে তার গায়ে কম্বল টেনে দিল। সে হরিণের কথাও ভুলল না, তার কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। তারপর নীরবে আবার দরজা ঠেলে চলে গেল। পরদিন সকালে উঠে নার্স দারোয়ানদের জিজ্ঞেস করল, রাতে রাজপ্রাসাদে কেউ ঢুকেছে কি-না। তারা বলল, ‘না, কাউকে ঢুকতে বা বেরতে দেখা যায়নি।’ এভাবে সে প্রত্যেক রাতে আসতে লাগল, কিন্তু একটি শব্দও কখনো উচ্চারণ করে না। নার্স সব সময় তাকে দেখে, কিন্তু কাউকে বলার সাহস হয় না তার। এভাবে বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পর একদিন রাতে রানী কথা বলা শুরু করল। সে বলেÑ ‘বিদায় আমার সোনার ছেলে, বিদায় সোনার হরিণ, আর কখনো আসব না গো, আর মাত্র দু’দিন।’ নার্স কোনো সাড়া-শব্দ করল না। আগন্তুক মেয়েটি চলে গেল। এবার রাজার কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলল নার্স। ‘হায় খোদা! কী ঘটছে এসব? কী শুনছি আমি!’ তারপর তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আগামীকাল রাতে আমি নিজে ছেলের পাশে থেকে দেখব।’ সন্ধ্যায় তিনি ছেলের ঘরে গিয়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকলেন। মাঝরাতে যথারীতি রানী হাজির হলো এবং বলতে লাগলÑ ‘বিদায় আমার সোনার ছেলে, বিদায় সোনার হরিণ, আর কখনো আসব না গো, মাত্র আর এক দিন।’ তারপর সে ছেলেকে কোলে নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াল, আদর করল। রাজা দম বন্ধ করে ঠোঁট চেপে বসে রইলেন, একটি কথাও বললেন না, একটু টুঁ শব্দও করলেন না। পরদিন রাতে আবার একই ঘটনা। রানী বলল ‘বিদায় আমার সোনার ছেলে, বিদায় সোনার হরিণ, আর কখনো আসব না গো, আজকেই শেষ দিন।’ তখন রাজা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না, লাফ দিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং বললেন, ‘আমার প্রিয় স্ত্রী ছাড়া তুমি আর কেউ নও।’ সুলতানা বলল, ‘হ্যাঁ জাহাঁপনা, আমিই আপনার প্রিয় স্ত্রী।’ রাজা তার কাঁধে হাত রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে আসল রানী আবার জীবন ফিরে পেল, এবং খোদার রহমতে তরতাজা, টগবগে, সুন্দরী, এবং পূর্ণ স্বাস্থ্যবতী তরুণী হয়ে উঠল। তখন সে বদমাশ ডাইনি ও তার মেয়ের সব অত্যাচার-নির্যাতন ও দু®কৃতির কথা রাজাকে খুলে বলল। রাজা ক্রোধে কাঁপতে লাগলেন। মনে হলো, এখনই তরবারির কোপে টুকরো টুকরো করে ফেলবেন ডাইনি ও তার মেয়েকে। কিন্তু রাজা হিসেবে দায়িত্ব আছে তার। ক্ষমতা আছে বলেই যখন-তখন যা-ইচ্ছা-তাই করতে পারেন না। দেশে আইন বলে একটা ব্যাপার আছে। তিনি নিজেই তার রক্ষাকর্তা। সে আইন নিজেই ভাঙেন কী করে! তিনি ডাইনি ও তার মেয়েকে আদালতে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। সব কিছু শুনে বিচারক ডাইনির কন্যাকে বনবাসে পাঠালেন, সেখানে বন্য পশুরা তাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল। আর ডাইনিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার হুকুম দিলেন। যে মুহূর্ত থেকে ডাইনি পুড়তে শুরু করল সেই মুহূর্ত থেকে হরিণটার রূপবদল ঘটতে লাগল, এবং পুনরায় সে পুরোপুরি মানুষের চেহারা ফিরে পেল। পরস্পরকে আবার ফিরে পেয়ে সুলতানা ও শুভ, দুই ভাইবোন, জড়াজড়ি করে কাঁদল। আনন্দের কান্না। রাজপুত্রের মত সুন্দর ও সুঠামদেহী এক কিশোর শ্যালক পেয়ে রাজাও খুব খুশি। তাদেরকে ফিরে পেয়ে রাজ্যের সমস্ত প্রজাকে দাওয়াত করে খাওয়ালেন তিনি। সারা দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বইতে লাগল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ