ডানপিঠে কিশোরের দল ।আঞ্জুমন আরা

ডানপিঠে কিশোরের দল ।আঞ্জুমন আরা

গল্প নভেম্বর ২০১৯

সন্ধ্যা নদীটা যেখানে বাঁক নিয়ে দূরে চলে গেছে ঠিক সেখানে ছোট্ট সবুজ গাঁয়ে রাজুর মামা বাড়ি। লেখাপড়ার চাপে সব সময় গ্রামে আসা হয় না রাজুর। এ বছর সমাপনী পরীক্ষা শেষ হলে মা তাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাই আসা। সবুজ গাঁয়ের কোমল দূর্বাঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে যে এতো আনন্দ তা আগে বুঝতে পারেনি রাজু। সেই ছোটবেলায় এসেছে। তখন তো মামাদের কোলে কোলেই থাকতো। তবে আর কিছু মনে না থাকলেও তার বড় মামার ছেলে সৈকতের কামড়ের কথা ভোলেনি রাজু। গ্রামের বাচ্চারা এমনই। একে অপরকে কামড় দেয় খাঁমচি দেয়। সবাই মিলে একসাথে খেলে, সাঁতার কাটে। আবার এক সাথে স্কুলে যায়। এতে কেউ কিছু মনে করে না। আর এভাবে একে অপরের সাথে মিলে মিশে খেলতে খেলতে বড় হয়। সৈকতও এবার সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। মামা বাড়ি আসার পর থেকে রাজু ও সৈকত দুইজন একসাথে খায়, ঘুমায়, গোসল করে। রাজু সাঁতার জানে না বলে সবাই হাসাহাসি করে। গাছে গাছে বিভিন্ন পাখির অবাধ বিচরণ দেখে রাজুর গাঁয়ের প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে। জোরে যখন হাওয়া বয় শরীরটা কেমন শীতল হয়। সৈকত তার বাড়ির ও পাড়ার বন্ধুদের সাথে রাজুকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ওরা জোট বেঁধে একসাথে খেলে। ইতোমধ্যে গাঁয়ের সব খেলাধুলা রপ্ত হয়ে গেছে রাজুর। বেশ আনন্দে কাটছে ওদের সময়। গাঁয়ের ছেলেরা খুব ডানপিটে। ওদের মা বাবা সব সময় ওদের শাসন করে না যেমন রাজুর মা ওকে সারাদিন করে। গতকাল বিকেলে কালবৈশাখী ঝড় হলো। ঝড়ে কিছু গাছগাছালি ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বটে, কিন্তু গাছপালা যেন সবুজ ও প্রাণবন্ত হয়ে ধরা দিলো রাজুর কাছে। শহরের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট বাসায় বন্দিজীবন থেকে বেরিয়ে এসে রাজুর মনটা উৎফুল্লতায় কানায় কানায় পূর্ণ হলো। সে দিন বিকেলে সৈকত ও তার বন্ধুরা রাজুকে নিয়ে সন্ধ্যা নদীর তীরে ঘুরতে গেলে। রাজু খেয়াল করলো নদীর চরে কালো কী যেন একটা পড়ে আছে। হয়তো কোনো গাছের গুঁড়ি হবে ভেবে সামনে আগায় ওরা। কিন্তু ভালো করে খেয়াল করলো রাজু ওটার হাত আছে এবং তা নড়ছে। তাই সে দৌড়ে তার কাছ গেলো। এবং অবাক হলো। এটা একটা জলজ প্রাণী। রাজুর চিনতে কষ্ট হলো না যে এটা একটা ডলফিন। দুষ্টু ছেলেগুলো শুশুক শুশুক বলে চিৎকার করে কোথা থেকে লাঠি নিয়ে এসে অসুস্থ ডলফিনটাকে পেটাতে শুরু করলো। রাজু চিৎকার দিয়ে উঠলো। কী করছো তোমরা? এটা একটা ডলফিন। ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠে আবার ওটাকে মারতে শুরু করলো। এবার রাজু দুই হাত সোজা করে ওর সামনে দাঁড়ালো আর বললো- আমি ওকে মারতে দেবো না। শোনো এটা একটা ডলফিন। কাল রাতে ঝড়ের সময় এখানে এসে আটকে গেছে। ও অসুস্থ দেখছো না? ও আমাদের কাছে সাহায্য চাইছে। তোমরা জানো? মানুষ যখন পানিতে ডুবে যায়, বিপদে পড়ে, তখন এই ডলফিন তাদের সাহায্য করে। আর তোমরা ওকে মারছো? ডলফিন একটি বুদ্ধিমান প্রাণী। এই বলে রাজু ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে শুরু করলো। ততক্ষণে ছেলেগুলো চুপ ও শান্ত হয়ে গেছে। চলো আজ ওর এই বিপদে আমরা ওকে সাহায্য করি। সৈকত বললো- কিভাবে সাহায্য করবি রাজু? ও একা আর আমরা অনেক জন। সবাই মিলে টেনে ওকে নদীতে নামিয়ে দেবো। এই বলে রাজু ওর লেজ ধরে টান দিলো। অমনি সবাই তাকে সাহায্য করলো। মারো টান হেইয়ো! জোরছে বলো হেইয়ো! একটা অসম্ভব কাজকে সম্ভব করলো কয়েকজন ডানপিটে কিশোর। তার পর হাঁটুজলে নেমে ডলফিনটার মাথায় একটা চুমু খেলো রাজু। জলে নেমে ডলফিনটা প্রথমে পানি খেলো তার পর ধীরে ধীরে হাত পা নাড়াতে শুরু করলো। ওরা সবাই ওটাকে আর একটু ধাক্কা দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিলো। ডলফিনটি চোখ খুলে ছেলেগুলোর দিকে কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকালো। আর ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে জলের মাঝে ডুবে গেলো। রাজু খেয়াল করলো ডলফিনটা শেষবারের মতো লেজ উঁচিয়ে ওদের বিদায় জানালো। আর নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরের দল হাত নেড়ে ওকে বাই জানালো। এই দিনটি রাজুর জীবনে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রাজুর মায়ায় বেঁচে গেলো একটি প্রাণ। আর বুদ্ধিমত্তায় রক্ষা পেলো একটি জলজ সম্পদ। 

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ