ডানাঅলা সাদা ঘোড়া

ডানাঅলা সাদা ঘোড়া

অনুবাদ গল্প মশিউর রহমান অক্টোবর ২০২৩

(পরি মানসুরি : ইরানি লেখক ও অনুবাদক পরি মানসুরির জন্ম ১৯৩৬ সালে তেহরানে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এবং চিত্র ও সমাজ বিজ্ঞানে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০ বছর ইংরেজি ভাষার শিক্ষকতা করার পর ১৯৭৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

পরি মানসুরি বিশ্বের বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যকর্ম অনুবাদ করে খ্যাতি লাভ করেছেন। ১৯৬৩ সালে সেরা অনুবাদ গ্রন্থের জন্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর নিজের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে উপন্যাস ‘এবাভ অ্যান্ড বেয়ন্ড লাভ’ এবং ছোটো গল্প গ্রন্থ ‘এন্টারটেইনমেন্ট ইন একজাইল’ এবং ‘নো, আই ওয়াজ নট ড্রিমিং’। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ‘দি হিডেন উন্ড’। তাঁর ‘এন্টারটেনমেন্ট ইন এগজাইল’ গ্রন্থের দুটি গল্প ‘দি গ্লাস মার্বেল’ ও ‘অ্যাংজাইটিজ ফ্রম অ্যাক্রোস দি ওয়াটার’ পৃথক দু’টি আন্তর্জাতিক গল্প সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘দি গ্লাস মার্বেলস’ নামক গল্পটি পাকিস্তানে একাদশ শ্রেণীর পাঠ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। বর্তমান গল্পটি তাঁর The Winged White Horse গল্পের অনুবাদ।)

এমন একটা সময় যা খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, একটি ছোটো শহরে, সবুজ উপত্যকা এবং সতেজ মাঠ দিয়ে ঘেরা উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে একটি ছোট্ট মেয়ের জন্ম হয়েছিল। বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন ‘শাদি’, যার অর্থ ‘জয়’।

ছোটো মেয়েটির জন্য এই নামটি ছিল একেবারেই সঠিক। কারণ তাকে কখনও কাঁদতে বা মন খারাপ করে থাকতে দেখা যায়নি। তার পরিবার এবং বন্ধুরা তাকে খুব ভালোবাসতো। এমন মিষ্টি এবং হাসিখুশি থাকা একটা মেয়েকে ভালোবাসতে না পারাটা খুবই কঠিন। মেয়েটিও সবাইকে ভালোবাসতো। নিশ্চয়ই সকলের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে যে মেয়েটি দেখতে কেমন ছিল। আমাকে বলতেই হবে যে, সে ছিল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল; নীল আকাশ এবং শান্ত সমুদ্রের মতো; সূর্যালোক এবং চাঁদের আলোর মতো ঝলমলে; সমস্ত তারা এবং প্রতিটি বসন্তে ফোটা ফুলের মতো শুভ্র ও পবিত্র; একটি উজ্জ্বল সকালে পাখিদের আনন্দময় গানের মতো উচ্ছল। সর্বোপরি, সে তার মিষ্টি স্বভাব এবং ভালো আচরণের জন্য সকলের চোখে সুন্দর ছিল।

বাবা-মা ও একমাত্র ভাই জয়কে খুব ভালোবাসতো। সে তাদের আদর-স্নেহ আর ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এভাবেই তার ছোটোবেলা অতিবাহিত হয়েছে। এখন সে এমন একটি বয়সে পৌঁছেছে যখন তার কল্পনায়, সে তার মায়ের মুখে শোনা গল্পের জগতে প্রবেশ করতে পারে এবং পরী এবং ফেরেশতাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে। তার মনের মধ্যে গেঁথে থাকা, তার মায়ের বলা গল্পগুলো ছিল সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘উইংড হোয়াইট হর্স’।

ছোট্ট জয় মায়ের মুখে শোনা এই গল্পের বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠে। অনেকবারই সে তার মাকে তার জন্য ‘ডানাযুক্ত-সাদা-ঘোড়া’টি কিনে দিতে বলেছিল, কিন্তু সবসময় তার মায়ের একই উত্তর ছিল, এটি কেনা যায় না।

এমন একটা সময় ছিল, যখন ছোট্ট জয় গল্পের দৈত্য-দানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ত। তার তিন বা চার বছরের বড়ো ভাই তখন হাসত এবং বলত যে এগুলো কেবল রূপকথা আর রূপকথার দৈত্য-দানোর চরিত্রগুলোর কোনোটাই সত্য নয়। সুতরাং, যদি সে তাদের ভয় পায়, তাহলে তাকে সবাই একটা ভীতু মেয়ে হিসেবে চিনবে এবং ভীতু কাপুরুষকে কেউ ভালোবাসবে না। তখন তুমি নিজেই লজ্জা পাবে এবং তোমার উজ্জ্বল ও ভয়হীন চোখ থেকে তোমার ছোটো হাত দুটো নিজেই সরিয়ে নেবে এবং বলবে, ‘না। আমি ভীতু নই। আমি জানি যে এই পৃথিবীতে দৈত্য-দানোর কোনো অস্তিত্ব নেই। এবং এও বলবে যে আমি নিশ্চিত, ‘উইংড হোয়াইট হর্স’ আছে এবং আমি সমগ্র পৃথিবীটাকে যেমন ভালোবাসি তাকেও তেমনি ভালোবাসি।’


২.

ছোট্ট জয়ের বাবা একজন নাবিক ছিলেন। যখনই তিনি কোনো সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে আসতেন, তখন তাদের প্রত্যেকের জন্য একটি উপহার নিয়ে ফিরতেন। ছেলেমেয়েকে তিনি বিভিন্ন দেশ আর সেখানকার মানুষের গল্প শোনাতেন। যখনই তার বাবা একটি নতুন ভ্রমণের জন্য বের হতেন, ছোট্ট মেয়ে জয় তাকে ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’ আনতে বলত, কারণ এটিই তার একমাত্র আকাক্সিক্ষত উপহার যা সে সবসময় পেতে চাইত। কিন্তু তার মায়ের মতো, তার বাবাও বলতেন যে, এটি এই বিশ্বের অন্যান্য জিনিসের মতো কেনা যায় না। তবে আমি এটুকু বলতে পারি যে, ওই ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’টি মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছায়, একটি ছোটো ছেলে বা মেয়ের সাথে দেখা করতে আসে এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে। তারপর, এটি তাদের পিঠের ওপর উঠিয়ে মেঘের ওপরে উড়বে এবং পাহাড়ের ওপরে ঘুরে বেড়াবে।

সময়ের সাথে সাথে, ছোট্ট মেয়ে জয় বুঝতে পেরেছিল যে ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’টিকে কাছে পাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করে কোনো লাভ নেই। প্রতি রাতে সে তার মাকে গল্প বলতে বলত। গল্প শুনে নিজেকে সান্ত¡না দিতো। আর ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করত, সকাল হলেই যেন সে ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়াটি’ দেখতে পায়।


৩.

ছোটো মেয়ে জয়দের বাড়িটা ছিল ছোট্ট একটি শহরের উপকণ্ঠে এবং একটা পাহাড়ের খুব কাছে। প্রতি বসন্ত এবং গ্রীষ্মে, মেয়েটি তার মায়ের সাথে এই পাহাড়ের ওপরে পায়েচলা পথ যার দুপাশে বুনোফুল ফুটে থাকতো সেই পথ ধরে হাঁটতো। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা পাথরের তৈরি বিশাল সতেজ ঝরনার কাছে পৌঁছে যেত। ঝরনার স্বচ্ছ, ঝকঝকে পানি দিয়ে জয় তার মুখ ও হাত ধুয়ে ফেলত। হাতমুখ ধোওয়ার জন্য মাঝে মাঝে সে সাবান আনত। মজা করার জন্য সাবানযুক্ত আঙুল দিয়ে বুদবুদ তৈরি করে সে বাতাসে উড়িয়ে দিতো। সে তখন খুব আনন্দের সাথে দেখত যে, ছোটো-বড়ো আর স্বচ্ছ চকচকে বুদবুদগুলো বাতাসে কী সুন্দরভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে।


৪.

গ্রীষ্মের এক বিকেল। ছোটো জয়ের মা তার বাবার একটি ভ্রমণের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি জয়কে একা পাহাড়ের ওপরে বসন্তে ফোটা ফুল এবং স্বচ্ছ ঝরনা দেখতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। যদিও তার মা মেয়েটি কোথায় যাচ্ছে তা লক্ষ রাখতেন এবং সতর্ক থাকতেন যাতে সে পড়ে গিয়ে আঘাত না পায়।

ছোট্ট জয় মনের আনন্দে সাবান নিয়ে পাহাড়ের ওপরে বসন্তে ফোটা ফুল দেখার জন্য চলে গেল। প্রতিদিনের মতো আজও সে তার মুখ এবং হাত ধুয়ে নেয় এবং সাবান পানি দিয়ে ছোটো-বড়ো বুদবুদ ফুঁকছিলেন...আর জয়ের চোখে সেটাকেই মনে হচ্ছিল, বিশ্বের সবচেয়ে অদ্ভুত এবং সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটি সে দেখতে পাচ্ছে। সে লক্ষ করেছিল যে, বুদবুদগুলো বড়ো থেকে আরও বড়ো হয়ে ওপরে উঠছে এবং একদিকে উজ্জ্বল ও রহস্যময় আলো ছড়াতে শুরু করেছে। একসময় তার চোখে ভেসে এলো বুদবুদগুলোর মধ্যে ‘ডানাযুক্ত সাদা ঘোড়া’ আবির্ভূত হয়েছে। 

ছোট্ট মেয়ে জয় এতটাই উত্তেজিত হলো যে, সে আনন্দের সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে এবং হাততালি দিয়ে নিজেকে বলছিল, “আমি এটা জানতাম, আমি ঠিক জানতাম, ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’ আছে। আমি চাই, আমার ভাইও এটা দেখতে এখানে আসুক। কারণ সে আমায় বলেছিল, ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’ আসলে মিথ্যে।”

তারপর ঘোড়াটা ছোট্ট মেয়ে জয়ের কাছে এসে বলল, “জয়, আমি চিরকাল তোমার বন্ধু হয়ে থাকব, আর তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করব।”

জয় মনে মনে ভাবল, “আমি নিশ্চিত যে এটিই আমার মায়ের গল্পের সেই ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’, সে আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে এবং আমি তাকে যা করতে বলব তাই সে করতে পারবে।”

ছোট্ট মেয়ে জয়ের মনে পড়ল, সকালে যখন সে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, তখন সে ছোটো এবং সাদা একটা বুনোফুল দেখেছিল। ফুলটিকে দেখে তার মনে হয়েছিল খুবই দুঃখী।

মেয়েটি ঘোড়াটিকে জিজ্ঞেস করলো, “ছোট্ট সাদা ফুলটি এত দুঃখী কেন?”

ঘোড়াটি উত্তরে বলেছিল, “ফুলটির অনেক দুঃখ, কারণ সে একাকী। নিঃসঙ্গ। বুনোফুলটির পাশে একটি বড়ো পাথর রয়েছে বলে সে প্রতিদিন সূর্যকে দেখতে পায় না। যদি তুমি ফুলটিকে খুশি করতে চাও, তবে সাবধানে এটির সমস্ত শিকড়সহ তার জায়গা থেকে তুলে পথের অন্যপাশে বুনোফুলের মধ্যে গাছটিকে লাগিয়ে দাও।”

ছোট্ট মেয়ে জয় ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’র পরামর্শ মতোই তা করেছিল। তারপর ফুলটি দেখল যে, সে তার বন্ধুদের কাছে রয়েছে এবং এখন সে সূর্যকে দেখতে পাচ্ছে। কয়েকদিন পরে বুনোগাছটির সাদা পাপড়িগুলো এত উজ্জ্বলভাবে ফুটতে শুরু করেছে যে, ছোট্ট জয় অনুভব করছিল যে এটি এখন অবশ্যই তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

জয় তখন ঘোড়াকে বললো, “আমাকে এখন বাড়ি যেতে হবে, নইলে আমার মা চিন্তিত হবেন। দয়া করে, তুমি আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দাও যে আমি তোমাকে আবার দেখতে পাব।”

ঘোড়াটি উত্তরে বলল, “চিন্তা করো না। যতবার তুমি এই পাহাড়ে বসন্ত উৎসবে আসবে, ততবারই তোমার সামনে আমি নিজেকে হাজির করব। আর তোমার প্রতিটি ইচ্ছাও আমি পূরণ করব।”

ছোট্ট মেয়ে জয় বলল, “আমি খুব খুশি এবং তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি কি দয়া করে একটু নতজানু হতে পারো, যাতে আমি তোমাকে সঠিকভাবে বিদায় জানাতে পারি?”

‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’ হাঁটু গেড়ে বসল এবং মেয়েটি আলতো করে তার চকচকে সাদা লোমগুলোকে স্পর্শ করল। নরম, উজ্জ্বল লোমগুলোর মধ্যে মেয়েটির মুখ ঢাকা পড়ে গেল।

জয় খুব খুশি হলো। তারপর সে অতি আনন্দিত হয়ে বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়াল।


৫.

পরের দিন, জয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক আগে ঘুম থেকে ওঠে। অধৈর্যভাবে সে নতুন সকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, যাতে সে আবার পাহাড়ের পাদদেশে রাস্তার দু’পাশের বসন্তের সৌন্দর্য দেখতে যেতে পারে। অবশেষে, ঘণ্টা দুয়েক বা তারও কিছু পরে মৃদু রোদসহ সকাল এসে হাজির হলো। সকালের জন্য সেই অপেক্ষাটা তার কাছে এক বছরের মতো মনে হয়েছিল। ছোট্ট মেয়েটি সময় নষ্ট না করে আবার পাহাড়ের পাদদেশে বসন্তের অপার সৌন্দর্য দেখতে চলে যায়। ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’ তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে উপস্থিত হয়ে মেয়েটিকে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছ যে আমি আমার প্রতিশ্রুতি রেখেছি এবং আমি তোমার সামনে হাজির হয়েছি। এখন, আমাকে বলো, আমি আজ তোমার জন্য কী করতে পারি।”

ছোট্ট মেয়ে জয় বলল, “আজ সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠি, তখনও চারপাশে ঘন অন্ধকার ছিল। আমি বাগানের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলাম, সবুজ ঘাস এবং অগণিত সাদা ফুল তারায় ভরা আকাশের মতো দেখাচ্ছে। এই দৃশ্য খুবই সুন্দর ছিল। আমি তোমার জন্য কয়েকটি তারা আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অন্ধকার কেটে গিয়ে যখন সকাল হলো, তখন আমি বাগানে গিয়ে খুবই হতাশ হলাম। কারণ ঘন অন্ধকার আকাশে আমার দেখা তারাগুলো ততক্ষণে কোথায় যেন চলে গেছে। তুমি কি জানো তাদের কী হয়েছে? তারা কোথায় পালিয়ে গেছে?”

ঘোড়াটি উত্তর দিলো, “তুমি যে তারাগুলো দেখেছো সেগুলো রাতের পরীদের উপহার, ভোর হওয়ার জন্য তাদের মাটিতে ফেলে রাখে, কারণ এটি সূর্যের আগমনের জন্য দরজা খুলে দেয়।”

কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে, ছোট্ট মেয়ে জয় বলল, “আচ্ছা, তারাগুলো যদি সূর্যের আগমনের জন্য পরীদের উপহার হয় তবে তাতে আমি খুব খুশি। এ জন্য আমার কোনো অভিযোগ নেই, কারণ আমি সূর্যকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আমি তো তোমাকেও খুব ভালোবাসি। আমি সেই তারাগুলোর থেকে কয়েকটি তারা তোমাকে উপহার দিতে চাই। এখন তাহলে, আমি কী করব?”

ঘোড়াটি উত্তরে বলল, “চিন্তা করো না। এই শীতে, যতবার তুমি একটি কমলা খাবে, তার বিচিগুলো যত্ন করে রেখে দেবে। বসন্ত এলেই সেগুলো এখানে নিয়ে আসবে এবং এই বসন্ত উৎসব এলাকার চারপাশে রোপণ করে দেবে। একদিন বিচিগুলো থেকে চারাগাছ জন্মাবে এবং তুমি গাছগুলো বড়ো হতে দেখবে। মাত্র তিন বছর পর গাছগুলো তোমার, আমার আর এই বসন্ত উৎসব দেখতে আসা প্রত্যেকের জন্য সাদা, সুগন্ধি ফুলে পূর্ণ হবে। ঘন অন্ধকারে আমরা যখন সেই ফুলগুলো দেখব, তখন মনে হবে যেন আকাশ থেকে সমস্ত তারা নেমে এসেছে। আর সেটা হবে আজ ভোর হওয়ার আগে মৃদু অন্ধকারে যেমনটি দেখেছো তার চেয়ে আরো সুন্দর।”

ছোট্ট মেয়ে জয় খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো, “আচ্ছা, এখন আমি তোমার কাছে আরেকটা উপহার পেতে চাই। আমি চাই তুমি আমাকে তোমার পিঠে করে অনেক উঁচুতে, পাহাড়ের ওপরে আকাশের ওই মেঘের দেশে নিয়ে ঘুরবে। ওপর থেকে আমি নিচের সবকিছু দেখতে চাই।”

‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’ অনায়াসে মেনে নিলো ছোট্ট মেয়ে জয়ের প্রস্তাব। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল যাতে মেয়েটি তার পিঠে অনায়াসে উঠে বসতে পারে। তারপর, তারা আকাশে উড়ে গেল।

মেয়েটি কতটা উত্তেজিত এবং রোমাঞ্চিত ছিলো তা সত্যিই কল্পনা করা সম্ভব নয়।

উড়ে যাওয়ার সময়, ছোট্ট মেয়ে জয় একটি সবুজ মাঠের মাঝখানে একটি নদী লক্ষ করে এবং সে ঘোড়াটিকে বলে, “নিচের নদীটি দেখতে পাচ্ছ? নদীটি এত আনন্দে নাচছে কেন? নিশ্চয়ই সেখানে চমৎকার কোনো ঘটনা ঘটেছে?”

ঘোড়াটি বলল, “নদীটি এতো খুশি এবং আনন্দে নাচছে কারণ, তুমি নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছ যে, কৃষকরা এই বছর তার উভয় পাশে কী সুন্দর গমের চাষ করেছে। নদী জানে যে, কয়েকদিনের মধ্যেই গমগুলো সোনারং ধারণ করবে। সোনালি গমগুলো তখন আর একাকী এবং নিস্তেজ থাকবে না।”

আকাশে আরো কিছুদূর উড়ে ছোট্ট জয় দেখতে পেল একটি সবুজ সুন্দর গ্রাম। সবুজ গ্রামের সবুজ গাছগুলো রঙিন ফুলে পরিপূর্ণ। পাখিরা সেখানে আনন্দে গান গাইছে। মেয়েটি ঘোড়াটিকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হয়েছে? সব পাখি এখানে জড়ো হয়েছে কেন?”

ঘোড়াটি উত্তরে বলল, “হ্যাঁ, মনে হচ্ছে যেন দুনিয়ার সব পাখি এই জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। নিশ্চয়ই এর একটি ভালো কারণ আছে। এই গ্রামে একজন বৃদ্ধ মহিলা থাকেন যিনি অনেক দিন ধরে কষ্টে ছিলেন, তার অনেক দুঃখ। গ্রামের সমস্ত লোক মহিলার দুঃখের কারণে তাদের হাসি থামিয়ে রেখেছিল। বৃদ্ধ মহিলার একটি ছোটো ছেলে আছে, যে অনেকদিন ধরে অসুস্থ। আজ সে অসুস্থতা থেকে সেরে উঠেছে। তাই বুড়ির খুব আনন্দ। সে জন্য বুড়ির সাথে গ্রামের সবাই মিলে একসাথে আনন্দ উদ্যাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাখিরাও তাদের বন্ধুদের এখানে আসতে বলেছে, যাতে তারা সবাই মিলে একসাথে গান গাইতে পারে এবং এই আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে।”

মেয়েটি বলল, “খুব ভালো খবর। পাখিদের সাথে আমারও গান গাইতে ইচ্ছে করছে।”


৬.

সেদিন পাহাড় এবং মেঘের ওপরে আরও কিছুক্ষণ উড়ে যাওয়ার পরে, ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’টি সেই বসন্ত উৎসবের জায়গায় ছোট্ট জয়কে আলতো করে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এখন আমাকে বলো, তুমি আর কী করতে চাও? এবার নিজের জন্য তো কিছু পছন্দ করো।”

ছোট্ট জয় বিস্ময়ের সাথে বলল, “আমি? আমার নিজের জন্য? আমার সাথে তো এখন তুমি আছো, তুমি থাকলে আমার আর কী চাই? আমি সবসময় চেয়েছি তুমি আমার হও... আমি যদি এটা ভাবি, তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে এবং আমাকে ছেড়ে যাবে না, তাহলে আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই।”

ঘোড়াটি বলল, “আমিও সেটাই চাই; কিন্তু প্রতি বছর তুমি যত বড়ো হবে, তত আরও জ্ঞানী হয়ে উঠবে এবং নিজেই নিজের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সক্ষম হবে। তারপর তোমাকে আমার আর খুব বেশি দরকার হবে না এবং একদিন তুমি আমাকে ভুলেই যাবে।”

ছোট্ট জয়ের উজ্জ্বল চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে উঠল। সে বলল, “যদি এমনই হয়, তাহলে আমি প্রার্থনা করব, আমি যেন কখনো বড়ো না হই; কারণ আমি কখনোই চাই না যে, তুমি আমার থেকে দূরে কোথাও চলে যাও। আমি সবসময় তোমার দেখা পেতে চাই।”

ঘোড়াটি বলল, “দুঃখ কোরো না। আমি সবসময় তোমার হৃদয়ে থাকব এবং তুমি যদি আমাকে ভুলে না যাও, আমাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করো তাহলে তোমার প্রয়োজনের সময় আমি উপস্থিত হয়ে যাব।”

ছোট্ট জয় বলল, “আমি তোমাকে কখনোই ভুলব না। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তোমাকে মনে রাখব। আমি প্রতিজ্ঞা করছি। আমি এটাও চাই যে একদিন, পৃথিবীর সমস্ত শিশু এবং বড়োরা তোমাকে আমার মতো করে দেখতে পাক। আমার মতো করে তোমাকে অনুভব করুক।”


৭.

সেবারের গ্রীষ্ম এবং তার পরের অনেক গ্রীষ্ম একইভাবে কেটে গেল। অনেক বসন্ত পার হলো।

ছোট্ট জয় এখন বড়ো এবং বুদ্ধিমতী হয়ে উঠেছে। চারপাশে তার অনেক বন্ধু। পৃথিবীতে চলার পথে সে এখন অনেক কিছু শিখেছে। সেদিনের ছোট্ট মেয়ে জয় কয়েক বছরের ব্যবধানে তরুণী হলো তারপর মা হলো এবং তারও অনেক পরে একজন দাদি হলো।

সবসময় সবাইকে সে একইভাবে ভালোবাসতো যেমনটি সে ছোটোবেলায় তার মায়ের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছিল, ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়ার কাছ থেকে সাহায্য ও ভালোবাসা পেয়েছিল।

সেদিনের ছোট্ট জয় আজ বৃদ্ধা হয়েছেন। বিশেষ করে তার নাতি-নাতনিদের কাছে তো তিনি বৃদ্ধাই। তার জন্য এটি খুবই আকর্ষণীয় ছিল যে, নিজে যেমন তার মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনতেন, তেমনি তার সন্তান এবং নাতি-নাতনিরা ‘ডানাযুক্ত হোয়াইট হর্সের’ গল্পটি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছিল এবং প্রায়শই এটি তারা আবারও শোনার আগ্রত দেখাতো।

এখন, যদি এমন হয় যে তুমি উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সেই ছোট্ট শহরটি পেরিয়ে আসছো এবং বৃদ্ধা জয়ের বাড়ি থেকে ঝরনা এবং নিকটবর্তী পাহাড়ের দিকে যাওয়ার পথে হেঁটে চলেছো তাহলে দেখতে পাবে উভয় পাশে বিশাল এবং মনোরম কমলা বাগান যা প্রতি বসন্তে, হাজার হাজার সাদা সুগন্ধি ফুলের সৌন্দর্য ও মনমাতানো গন্ধে সমস্ত মানুষকে মোহনীয় করে তুলছে এবং আলিঙ্গনের জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। 

তোমরা তাড়াহুড়ো করো না। বসন্ত উৎসবে তোমরা রাস্তার ধারে বসে ওপরের আকাশ, মেঘমালা আর উঁচু উঁচু পাহাড়ের দিকে তাকাও এবং ঝরনার স্বচ্ছ পানির প্রবাহ দেখ। তোমার কাছে মনে হবে, উপত্যকাটি তার সমস্ত সতেজতা ও পবিত্রতা নিয়ে সূর্যের দিকে হাসছে। তুমি হয়তো নিজেও জানো না যে, সম্ভবত, তুমিও একদিন ‘ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া’ দেখতে পাবে। আর ওই সাদা ঘোড়াটি ছোট্ট মেয়ে জয়ের মতো তোমারও ইচ্ছে পূরণ করবে!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ