তাওহীদ হৃদয় ক্রিকেটের নতুন আশা

তাওহীদ হৃদয় ক্রিকেটের নতুন আশা

খেলার চমক আবু আবদুল্লাহ মে ২০২৩

২০২০ সালটা দুর্দান্ত একটা অর্জন দিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য। সেবারই প্রথম বাংলাদেশ জিতেছে যুব বিশ্বকাপের শিরোপা। সেই প্রথম বাংলাদেশের ঘরে আসে বিশ্বকাপ নামের কোনো শিরোপা- হোক না সেটা ছোটোদের বিশ^কাপ! দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল জয় করেছিল বিশ্ব।

সেই দলের সদস্য ছিলেন তাওহীদ হৃদয়। এই নামটা এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। কারণ এ বছর বিপিএলে দারুণ ব্যাটিং করে হৃদয় জায়গা করে নিয়েছেন জাতীয় দলে। আর শুরুতেই দেখিয়েছেন নিজের ব্যাটিং সামর্থ্য। যে কারণে তাকে নিয়ে দেশের ক্রিকেট সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধছেন।

২০২০ যুব বিশ^কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে দুটি কার্যকর ইনিংস খেলে নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন হৃদয়। স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল মূলত ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রথম বড়ো পরীক্ষা। সেই ম্যাচে ৫১ রান করে বাংলাদেশের জয়ে অবদান রাখেন হৃদয়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও তার ব্যাট থেকে এসেছে ৪৭ বলে ৪০ রানের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইনিংস। যা বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো ফাইনালে যেতে সাহায্য করে। এরপর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ব্যাটে রান না পেলেও অফস্পিন বোলিং করে ৪ ওভারে মাত্র ১২ রান খরচ করেন।

যুব বিশ^কাপের শিরোপা জয়ী দলটির মধ্যে বেশ কয়েকজনকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাংলাদেশ। যার মধ্যে মিডলঅর্ডার ব্যাটার হৃদয় একজন। ওই দলটার মিডল অর্ডারের মেরুদণ্ড বলা হতো তাকে।

সিনিয়র ক্রিকেটে নিজের যোগ্যতার জানান দিতে তিনি বেছে নেন গত বিপিএলের গত আসরটিকে। সিলেট স্ট্রাইকার্সকে ফাইনালে তোলায় রেখেছেন বড়ো অবদান। ১২ ইনিংসে ৫টি হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৪০৩ রান। স্ট্রাইক রেট ১৪০.৪১ আর গড় ছিল ৩৬.৬৩। টুর্নামেন্টের মাঝখানে ইনজুরিতে না পড়লে রান হয়তো ৫০০ ছাড়িয়ে যেত।

তারপরও হৃদয় জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এখন পুরোপুরি প্রস্তুত সিনিয়র লেভেলের ক্রিকেটের জন্য। নির্বাচকরাও তাই তাকে ডেকেছেন জাতীয় দলে। মার্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন বগুড়ার এই ক্রিকেটার। একই মাসে আয়ারল্যান্ড সিরিজে তার অভিষেক হয় ওয়ানডে ক্রিকেটে। প্রথম ম্যাচেই ইংল্যান্ডের ১৫৬ রান তাড়া করতে তাকে চার নম্বরে নামিয়ে দেওয়া হয়। ১৭ বলে ২৪ রানের একটি সময়োপযোগী ইনিংস খেলেন হৃদয়।

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে আরো পরিণত ক্রিকেট মস্তিষ্কের প্রমাণ দেন এই মিডলঅর্ডার ব্যাটার। আরেকটু হলেই অভিষেক ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটারদের এলিট ক্লাবে ঢুকে যাচ্ছিলেন; কিন্তু সেটা হয়নি ৯২ রানের মাথায় আউট হয়ে যাওয়ায়। তবে তার আগে সাকিব আল হাসানের সাথে ১৩৫ ও মুশফিকুর রহীমের সাথে ৮০ রানের জুটি গড়ে দলের স্কোর তিনশো পেরিয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছেন। তার ৮৫ বলে ৯২ রান ছিল বাংলাদেশের ইনিংসের মেরুদণ্ড। যে কারণে ৮টি চার আর ২টি ছক্কার ওই ইনিংসের জন্য ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার তার হাতেই উঠেছে।

দ্বিতীয় ম্যাচেও রানের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন হৃদয়। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে ৩৪ বলে খেলেন ৪৯ রানের ইনিংস। বৃষ্টির কারণে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচটি পরিত্যক্ত না হলে সিলেটের দর্শকরা হয়তো আরো একবার দেখতে পেত হৃদয়ের হৃদয় জুড়ানো ব্যাটিংশৈলী।

মাত্র দুটি সিরিজ দেখেই কাউকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, কিন্তু হৃদয় তার ব্যাটিংয়ে যে দক্ষতা আর পরিণত ক্রিকেটারের ছাপ রেখেছেন সেটি আশাবাদী করেছে সবাইকে। সাকিব, তামিমদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে জাতীয় দলে তাকে বিবেচনা করতে চান তারা। এর বড়ো কারণ, প্রথম দুই সিরিজে ভালো ব্যাটিং করার পাশাপাশি তার মাঝে ক্রিকেট মেধা ও সাহস দুটোই আছে। পেশাদার ক্রিকেটে ভালো করতে এ দুটি জিনিস খুব জরুরি। যুব বিশ^কাপেও কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনালে রান করে হৃদয় বুঝিয়ে দিয়েছেন বিগ ম্যাচের প্রেসার নিতে জানেন।

২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর বগুড়ায় জন্ম হৃদয়ের। ছোটোবেলা থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার নেশা তাকে পেয়ে বসে। মা ছিলেন তার পাশে। হৃদয়ের বাবাকে না জানিয়ে জমি বন্ধক রাখার টাকা তিনি দিয়েছিলেন হৃদয়কে। সেই টাকায় জীবনের প্রথমবার ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন।

বগুড়ার ছেলে হিসেবে মুশফিকুর রহীমকে আদর্শ মেনেই বড়ো হয়েছেন। তার মতোই মিডল অর্ডার ব্যাটার হতে চেয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত হয়েছেন সেটাই। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, একই এলাকার মুশফিক ভাই জাতীয় দলে খেলছেন- এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে ক্রিকেটার হয়ে উঠতে।

২০১৭ সালে জাতীয় লিগে রাজশাহী বিভাগের হয়ে অভিষেক। এরপর বয়সভিত্তিক দলের কর্মকর্তাদের নজরে আসেন দ্রুত। ফলস্বরূপ ঢাকায় খেলতে আসেন হৃদয়। প্রিমিয়ার ক্রিকেটে নাম লিখিয়েছেন শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। এরপর তো ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ^কাপ যাত্রা এবং বিশ^জয় করে দেশে ফেরা।

বিশ^কাপ জয়ের পর কিছুটা ছন্দপতন ছিল তার ব্যাটিংয়ে। যে কারণে জাতীয় দলে আসতে সময় লেগেছে। তবে এ বছরের বিপিএল তাকে আবার সেই পুরনো ছন্দে এনেছে। ঢাকার বিপক্ষে ৪৬ বলে ৮৪ রান, বরিশালের পক্ষে ৩৪ বলে ৫৫ রান, কুমিল্লার বিপক্ষে ৩৭ বলে ৫৬ রানের ইনিংসগুলো যেমনি দর্শকদের মাতিয়েছে, তেমনি সিলেটকে ফাইনালে নিতে ভূমিকা রেখেছে।

বিপিএলের পর বিবিসি বাংলা তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘বিপিএল শুরুর পর থেকে তাসকিন আহমেদ ও সাব্বির রহমান বাদে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাতাতে সক্ষম এমন তারকা ক্রিকেটার তুলে আনতে পারেনি; কিন্তু এবার তাওহীদ হৃদয়কে নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। তিনি এবারের বিপিএলের সেরা ক্রিকেটারদের একজন।’

এসব কারণে তাওহীদ হৃদয়কে নিয়ে প্রত্যাশাটা বেড়েছে সবার। হৃদয় নিজেও জানেন তাকে নিয়ে প্রত্যাশার এই কথা। যে কারণে তিনি স্বপ্ন দেখছেন দেশের জার্সিতে বড়ো কিছু করার। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার এখন স্বপ্ন বাংলাদেশের হয়ে বিশ^কাপ জেতা।

অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ^কাপের স্পর্শ পেয়েছেন বলেই হয়তো হৃদয়ের সাহসটা অনেক বেশি। আর ভাগ্য যে সাহসীদের পক্ষে থাকে সেটা সবারই জানা।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ