তারাগুলো মিটিমিটি জ্বলে কেন

তারাগুলো মিটিমিটি জ্বলে কেন

বিশেষ রচনা ডা. অপূর্ব চৌধুরী মে ২০২৩

রাতে আকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাই কিছু আলো যেন জ্বলে আছে। তাদের কিছু মিটিমিটি করে জ্বলে। খালি চোখে যা দেখি, আকাশে কি শুধু সেগুলোই জ্বলে? মোটেও না। আকাশে জ্বলা এসব বস্তুর বেশির ভাগই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। তাদের দেখতে হয় টেলিস্কোপ দিয়ে। তখন দেখা যায়, আকাশে বিলিয়ন বিলিয়ন আলোর ফোয়ারা। এই আলোগুলোর সবগুলোই আবার তারা নয়। যেগুলো তারা, বা স্টার বা নক্ষত্র, সেগুলো মিটিমিটি করে জ্বলে। কিন্তু কেন তারাদের খালি চোখে দেখলে এমন মিটিমিটি করে জ্বলতে দেখা যায়?

আকাশে তারাগুলো দেখতে আলোর বিন্দু। এই বিন্দুগুলোর মধ্য ভাগ দেখতে উজ্জ্বল আলো। খালি চোখে এই আলোর বিন্দুর দিকে তাকালে মনে হয় তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। আসলেই কি তারারা মিটমিট করে জ্বলে। না, তারারা কখনো এমন মিটিমিটি করে জ্বলে না। তাহলে এমন দেখি কেন আমরা? 

পৃথিবী থেকে তারাগুলো অনেক দূরে দূরে থাকে। পৃথিবীর পিঠ থেকে যত ওপরে যাই স্পেসে থাকে বাতাস। এই বাতাসের থাকে বিভিন্ন লেয়ার। এই লেয়ারের থাকে বিভিন্ন ধরনের তাপমাত্রা। কোনটা গরম, কোনটা ঠান্ডা। স্টার বা তারাগুলো থেকে যখন আলো বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, সেই আলো আমাদের পৃথিবীতে আসার পথে বিভিন্ন তাপমাত্রার এই বাতাসের লেয়ারের মধ্য দিয়ে আসে। এই লেয়ারগুলোতে থাকে বিভিন্ন উপাদান এবং বিভিন্ন তাপমাত্রা। আলো তখন বাধা পায়। সরাসরি সরল রেখায় চলতে না পেরে আলো বেঁকে যায়, একেক লেয়ারে কখনো কখনো একেক রঙে দেখা দেয়। আলোটি তখন আমাদের পৃথিবীতে এসে আমাদের চোখে পড়লে মনে হয় আলো যেন মিটমিট করছে। আর তাতেই মনে হয় তারারা মিটিমিটি জ্বলে। 

আবার দেখা গেছে- গ্রহরা এমন করে মিটিমিটি জ্বলে না, কেবলমাত্র তারারা জ্বলে। প্রথমত গ্রহের নিজের কোনো আলো নেই, তারাগুলো আলোর উৎস। দ্বিতীয়ত এই তারাগুলো থেকে আলো এসে গ্রহগুলোর বুকে পড়লে তখন গ্রহগুলোকে আলোকিত মনে হয়। তৃতীয়ত গ্রহগুলো অনেক কাছে এবং তারাগুলো অনেক দূরে। কাছের জিনিস থেকে আসা আলোকে বাতাসের লেয়ারগুলোর কম দূরত্ব পার করতে হয় বলে আলোগুলো কম বেঁকে যায়। সর্বোপরি তখন গ্রহগুলো মিটিমিটি জ্বলে না, কেবল দূরের তারাগুলোই মিটি মিটি জ্বলে।

আমাদের সবচেয়ে কাছের তারাটি হলো সূর্য, পৃথিবী থেকে যার দূরত্ব দেড়শ মিলিয়ন কিলোমিটার। অনেক ধরনের তারা আছে, তার মধ্যে সূর্য হলো হলুদ ধরনের তারা, যদিও বেশির ভাগ তারা হয় লাল ধরনের। সূর্য সৃষ্টি হয়েছিল ৫ বিলিয়ন বছরের কম আগে এবং ঠিক তার পরপরই তৈরি হয়েছিল আমাদের পৃথিবী। সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে আমরা তার চারপাশে ঘুরি। পৃথিবী ছাড়াও এমন নয়টি গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে, যা নিয়ে আমাদের সৌরমণ্ডল। সূর্য আমাদের এতো কাছে বলে সূর্যকে আর মিটি মিটি করে জ্বলতে হয় না, সূর্যের আলো এতটাই আমাদের চোখে সরাসরি এসে পড়ে, উল্টো বরং আমাদেরই চোখ জ্বলে।

সব তারাই গ্যাসীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। কিন্তু গ্রহগুলো উল্টো। গ্রহগুলো মৌলিক কিছু উপাদানের সংমিশ্রণে কঠিন পদার্থ দিয়ে বেশির ভাগ অংশ গঠিত। তারাদের মধ্যে বেশির ভাগ অংশ হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি। একসময় তারা মহাকাশে কিছু গ্যাসের বিশাল বিশাল মেঘের কুণ্ডলী ছিল! তখন তারা ঠান্ডা থাকে। এ রকম কিছু গ্যাসের কুণ্ডলী একে অপরের সাথে মিশে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে এতটাই গরম হয়ে যায়, সে গরমের উত্তাপে মনে হয় তারাগুলো আগুনের কুণ্ডলী। এমন কুণ্ডলী পাকিয়ে প্রতিনিয়ত এতো এতো আলো এবং তাপের জন্ম হয়, যা তার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে! আবার কুণ্ডলী, বিক্রিয়া এবং তাপমাত্রার কারণে তার ভেতরে মধ্য ভাগে একটা শক্তির জন্ম হয়, গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ। আর এই গ্র্যাভিটির কারণে একদিকে গ্যাসের কুণ্ডলী একে অপরের কেন্দ্র দিকে জড়িয়ে থাকে, বাইরে ছুঁতে চায় না এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া করে তার বাইরের দিকে তাপ এবং আলোকে ছেড়ে দেয়।

তারাগুলো মিটিমিটি করে এক রঙা হয়ে জ্বললেও তারাগুলোর আলো প্রধানত তিন রঙের হয় বেশি। লাল, সাদা এবং নীল। যেগুলো লাল দেখায় সেগুলো তুলনামূলক ভাবে ঠান্ডা বা তাদের তাপমাত্রা বেশি হয় না। যাদের তাপমাত্রা ৩৫০০ কেলভিনের চেয়ে বেশি তাদের আলোর রঙ হয় হলুদ। যেমন আমাদের সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৬৫০০ কেলভিন। সবচেয়ে বেশি হট তারাদের আলো নীল রঙের হয়। নীল রঙের তারাগুলোর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১২ হাজার কেলভিনের বেশি হয়। এ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড়ো তারাটির নাম VY Canis Majoris. এটি আমাদের সূর্যের চেয়ে এক হাজার আট শ’ গুণ বড়ো।

শুরুতে বলেছিলাম, খালি চোখে আমরা আকাশে অল্প কটি তারাকে মিটিমিটি জ্বলতে দেখি। কিন্তু শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন লক্ষ নয়, কোটি নয়, বিলিয়ন বিলিয়ন তারা বিলিয়ন বিলিয়ন মাইল দূরে মিটিমিটি জ্বলে। শুধু আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়েতে তারা আছে দুই শ’ বিলিয়নের বেশি। এরকম ধরা হয় ৫০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে। তাহলে একটি গ্যালাক্সির ভেতর দুই শ’ বিলিয়ন তারা থাকলে পাঁচ শ’ বিলিয়ন গ্যালাক্সিতে কত ট্রিলিয়ন তারা আছে!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ