তোমরাই গড়বে বাসযোগ্য পৃথিবী - রবিউল কমল

তোমরাই গড়বে বাসযোগ্য পৃথিবী - রবিউল কমল

প্রচ্ছদ রচনা ডিসেম্বর ২০১৯

তোমরাই গড়বে বাসযোগ্য পৃথিবী - রবিউল কমলতোমরা নিশ্চয়ই জানো বীরের জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশের দিন ১৬ ডিসেম্বর। কারণ পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রকাশের দিন এটি। ৪৮ বছর আগে এই দিনে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিজয়। তাই প্রতি বছর এদিনে স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা অকুতোভয় বীর সন্তানদের গভীর বেদনা ও পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি আমরা। একাত্তর সালের ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পথ বেয়ে আসে বাঙালির বিজয়, পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। লাল-সবুজ পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বিজয়ী বাঙালি। সেই পতাকা উঁচিয়ে বিশ্বের পথে এগিয়ে চলেছে বাঙালির অভিযাত্রা। তবে তোমরা যারা শিশু-কিশোর তাদের শুধু বিজয় দিবস উদযাপন করলে হবে না। তোমাদের শপথ নিতে হবে নিজেকে গড়ে তোলার। একজন ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারলেই তোমরা হবে জীবন বিজয়ী। তাই এখনই প্রতিজ্ঞা করো নিজেকে আদর্শবান ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলার। তোমাদের মনে রাখতে হবে তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তোমার বাবা-মা এবং এই দেশ। তোমাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে আগামীর অসীম সম্ভাবনা। তাই চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করলেই মহান আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন। যারা নিজে চেষ্টা করে আল্লাহ তাদের সবসময় সাহায্য করেন। ভুলে গেলে চলবে না শৈশব ও কৈশোরকাল প্রত্যেকের জীবনের স্বর্ণালি সময়। এ সময়ে শরীর ও মনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটতে থাকে। কাজেই নিজের মেধা বিকাশের ও নিজেকে গড়ার ক্ষেত্রে এ সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় যদি সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সৃজনশীলতা ও মননশীলতার বীজ বপন করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে তুমি একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হবে। এ সময়েই একটি শিশুর স্বভাব, আচার-আচরণের ভিত তৈরি হয়, কাজেই একে কাজে লাগাতে হবে। তোমরাই গড়বে বাসযোগ্য পৃথিবী - রবিউল কমলতোমরা হলে আগামী দিনের নাগরিক; জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। কথাটি একবিন্দুও মিথ্যা নয়। তাই আজ বিশ্বব্যাপী স্লোগান উঠেছে ‘সবার আগে শিশু’। তবে সবাই কিন্তু সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে না! ধর্মীয় নৈতিকতা, ইসলামী মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা, মননশীলতা সর্বোপরি দেশপ্রেমের অভাবে অধিকাংশ শিশু-কিশোর আজ বিপথে হাঁটছে। অধিকারবঞ্চিত শিশু-কিশোররা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অকালে ঝরে যাচ্ছে। তাই তোমাদের সচেতন হতে হবে। তোমাকে অনেক কিছু জানতে হবে। একজন শিশু-কিশোরকে আদর্শ নাগরিক হতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন হবে নিজ সংস্কৃতিকে জানা। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বেথ ম্যাশিনট নামের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক ‘দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব কালচার অন আর্লি চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট’ (শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে সংস্কৃতির ভূমিকা) শীর্ষক এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন গবেষণার সূত্র উল্লেখ করে বলেন, শিশুর ভাষা শেখা, সামাজিক দক্ষতা, ধারণার জগৎ তৈরিসহ আত্মোপলব্ধির জন্য সংস্কৃতিচর্চার বিকল্প নেই। তবে অনেকে শিশুদের দেশীয় সংস্কৃতিচর্চার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। বিশেষ করে বাবা-মা নিজেরাই চান না যে, তাদের সন্তান সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানুক বা বুঝুক। তাদের ধারণা সন্তানরা ইংরেজি মিডিয়ামে লেখাপড়া করছে, তারা তো দেশে থাকবে না। দেশীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চা করে কোনো লাভ নেই। শুধুই সময় নষ্ট করা। তা ছাড়া অনেক অভিভাবক পাশ্চাত্য সংস্কৃতিপ্রীতিকে আভিজাত্যের প্রতীক বলে মনে করেন এবং দেশীয় সংস্কৃতিকে অনেকটা অবহেলা ও অবজ্ঞার চোখে দেখেন। আবার অনেকে তাদের সন্তানকে জিপিএ-৫ পাওয়া বা আরো ভালো ফলাফল তৈরির মেশিনে পরিণত করতে দিন-রাত পরিশ্রম করছেন, সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার বিন্দুমাত্র সময় পাচ্ছেন না। অথচ শিশুবিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং বিশিষ্টজনদের অভিমত হলো শিশু-কিশোরদের আদর্শ নাগরিক ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হলে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিকতা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। তোমাদের বেশি বেশি মাতৃভাষার চর্চা করতে হবে। কারণ মেধা বিকাশ ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশু-কিশোরদের মনে মাতৃভাষা যেভাবে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। দৈহিক বিকাশের ক্ষেত্রে যেমন মাতৃদুগ্ধের বিকল্প নেই, তেমনি মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও বিকল্প নেই। তাই তোমাদের প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত মাতৃভাষা। বিশ্বায়নের এই সময়ে ইংরেজি জানা ও শিক্ষা গ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং আবশ্যক। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তবে মাতৃভাষা শেখার আগেই ইংরেজি শিখতে হবে বা বাংলা শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই এই যুক্তি সঠিক নয়। তোমাদের জন্য মানসিক খাদ্য হলো বই। পুষ্টিকর খাবার যেমন শারীরিক বিকাশে সহায়ক তেমনি দেশীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তোমাদের মন ও কল্পনার জগৎ ব্যাপক এবং বিস্তৃত। এই স্বপ্নময় ও কল্পনার জগৎকে উপলব্ধি করার জন্য এবং সৃজনশীল সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সাহিত্যের বিকল্প নেই। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মননশীল চর্চার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে বই। অবসর সময়ে তোমাদের কাজ হলো ধর্মীয়, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ক বই পাঠ করা। তোমরাই গড়বে বাসযোগ্য পৃথিবী - রবিউল কমলএকজন ভালো মানুষ হতে হলে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অন্যান্য সুকুমারবৃত্তি চর্চার পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জন খুবই জরুরি। ভালো ফলাফল অর্জন করে মহাজ্ঞানী হওয়া এবং বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তোলা, সবই ব্যর্থ ও অর্থহীন হয়ে যাবে যদি নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা না থাকে। নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে পরিবার। পারিবারিক শিক্ষার মধ্যেই নৈতিকতার বীজ প্রোথিত হয়। তোমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে পরিবার হচ্ছে সুশিক্ষা ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের প্রথম পাঠশালা। এই লেখার মাধ্যমে তোমাদের বাবা-মায়ের উদ্দেশে বলছি- আপনার সন্তানের প্রতি গভীর নজর রাখতে হবে, সময় দিতে হবে, নৈতিক, মানবিক শিক্ষা দিতে হবে এবং আনন্দ-বিনোদনের সুযোগসহ সুকুমারবৃত্তি চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গুটিকতক পড়ার বইয়ের মধ্যে আপনার সন্তানের জীবনটাকে বাক্সবন্দি করে ফেলবেন না। পাঠ্য তালিকার বহির্ভূত ভালো ও সুপাঠ্য বই পড়তে দিন, শিশুকে প্রকৃতির কাছে নিয়ে যান, বিজাতীয় সংস্কৃতি এড়িয়ে চলুন, ইসলামী মূল্যবোধের চর্চা করুন। আসলে তোমরা যারা শিশু-কিশোর, তাদের পরিপূর্ণ বিকাশে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, সমাজ ও যৌথ প্রচেষ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই তুমি হয়ে উঠবে আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক। শুধু পরিবার, স্কুল ও শিক্ষকরাই নয়, তোমাদের সার্বিক বিকাশে শিশু সংগঠন, সমাজ ও সরকারের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়। তবে আমরা এ ব্যাপারে কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারছি সেটাই বিবেচ্য বিষয়। ব্যস্ত জীবন ও আধুনিক সভ্যতার জটিলতায় আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি আকাশ সংস্কৃতির বেড়াজালে। এই প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও ধর্মীয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে তোমাদেরকেই গড়ে তুলতে হবে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী। আর এটাই হোক বিজয় দিবসে তোমাদের প্রতিজ্ঞা।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ