ত্যাগ
তোমাদের গল্প ডিসেম্বর ২০১৪
মো: হাসবিতুল হাসান নিঝুম #
স্কুলের সামনের বটগাছের নিচে বসে বসে রাতুল আইসক্রিম খাচ্ছে। এ সময় আহসান এসে বলল, ভাই রাতুল, কয়েকদিন পর আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা। কিন্তু আমি পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে পারিনি। তুমি কি আমাকে পরীক্ষার ফি দিয়ে সহযোগিতা করতে পার? রাতুল বলল, তোকে আমি পরীক্ষার ফি দেবো কেন? যা, তুই এখান থেকে। এ কথা শোনার পর আহসান বিষণœ মুখে চলে গেল। আহসান ও রাতুল একই ক্লাসে পড়ে। রাতুল কখনো লেখাপড়া করে আহসানকে টপকাতে পারেনি। ক্লাসে সবসময় আহসানের রোল ১ আর রাতুলের ২। এ জন্য মাঝে মাঝে রাতুলের মা রাতুলকে বকা দেন, ‘রাতুল, তোমার বাবার টাকা পয়সার অভাব নেই। তুমি যা চাও তাই পাও। তুমি তবু কেন লেখাপড়া করে আহসানকে টপকাতে পারো না? তার তো তোমার মতো সুযোগ সুবিধা নেই। সত্যিই, আহসানের মা ছাড়া আর কেউ নেই। তার বাবা সে ছোট থাকার সময় মারা যায়। তারপর থেকে তার মা তাকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করাচ্ছেন। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে সে এত ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু এবারের পরীক্ষার জন্য তার মা পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে পারেননি। রাতুল জানে, পরীক্ষার ফি জমা দিতে না পারলে আহসান পরীক্ষা দিতে পারবে না। এ সুযোগে রাতুল তার রোল ১ করতে পারবে। তাই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে আহসানকে পরীক্ষার ফি দিয়ে সাহায্য করেনি। ফলে আহসান পরীক্ষা দিতে পারল না। পরীক্ষা দিতে না পারায় আহসান পরবর্তী ক্লাসে উঠতে পারল না। তাই সে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়ে ভালোভাবে লেখাপড়া করতে লাগল। তার স্বপ্ন বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে, দেশবাসীর সেবা করবে। সে জানে, তার মাও চায় সে বড় হয়ে ডাক্তার হোক। কিছুদিন পরের কথা। রাতুলের বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। রাতুলের মা সংসারের হাল ধরেন। রাতুল স্বাধীনতা পেয়ে যায়। সে বেহিসাবির মতো টাকা খরচ করতে থাকে। কথায় আছে, বসে বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। রাতুলদের অবস্থাও হতে থাকলো সে রকমই। যখন রাতুলদের অবস্থা একেবারে শোচনীয়, তখন রাতুলের হুঁশ হলো। সে সামলে উঠতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। তার মা এখন অনেক কষ্টে সংসার চালায়। এ রকম জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় রাতুল এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার হলে আহসানের সাথে তার দেখা হয়। সে আহসানের সামনে নিজের অবস্থার কথা গোপন রাখে। কিন্তু আহসানের সন্দেহ হয়। শেষ পরীক্ষার দিন আহসান রাতুলের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। যখন সে রাতুলের খোঁজ নেয় তখন জানতে পারে রাতুল বাড়ি চলে গেছে। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। রাতুল এবং আহসান দু’জনের গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। পরীক্ষার রেজাল্ট শোনার পর রাতুল আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। সে এক দৌড়ে বাড়ি চলে এলো। বাড়ি এসে জানতে পারল তার মা রাস্তায় গাড়ির সাথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। রাতুল তার মাকে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের নিকট নিয়ে গেল। ডাক্তার তার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে রাতুলকে বলল, তোমার মায়ের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই ইমার্জেন্সি ৭-৮ ঘণ্টার মধ্যে রক্তের প্রয়োজন তা ছাড়া, তার হার্টের প্রবলেম রয়েছে। দু’দিনের মধ্যে অপারেশন না করলে তিনি মারাও যেতে পারেন। জলদি ৫ লাখ টাকার ব্যবস্থা করো। এ কথা শুনে রাতুলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এত টাকা সে কিভাবে জোগাড় করবে। রাতুল টাকা ও রক্তের জন্য বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনের কাছে গেলো। তারা তাকে ফিরিয়ে দিল। যারা তাদের সুসময়ে সাথী ছিল, তারা আজ শুধু বঞ্চনা দিচ্ছে। সে টাকা ও রক্ত জোগাড় না করতে পেরে হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। পথে রাতুলের সঙ্গে আহসানের দেখা হলো। আহসান বলল, সে রাতুলকে অনেক দিন ধরে খুঁজছে। তারপর তাকে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। রাতুল সংকোচবোধ না করে আহসানের কাছে সব খুলে বলল। আহসান তাকে সাহায্য করার আশ্বাস দিল। রাতুল ভাবতে লাগল, যাকে সে এত কষ্ট দিয়েছে এত বঞ্চনা দিয়েছে, যার অনেক ক্ষতি করেছে সেকি সত্যিই তাকে সাহায্য করবে? আহসানের রক্তের গ্রুপের সাথে তার মায়ের রক্তের গ্রুপ মিলে গেল, ফলে, সে রক্ত দিতে পারলেও টাকা দেবে কোথা থেকে? আহসান তার মাকে রক্ত দিলো। এমনকি টাকাও জোগাড় করে দিল। রাতুল আহসানকে বলল, - আমি তোমার এত ক্ষতি করেছি, তবু তুমি কেন আমাকে সাহায্য করলে? - এটা মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য। এসব বলে লজ্জা দিও না। - তুমি এত টাকা পেলে কোথায়? - আমি মেডিক্যালে পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। চান্স হলে কিছু টাকার ব্যাপার তো থাকবেই। টাকা ছাড়া ভর্তি অসম্ভব। এ জন্যই মা কষ্ট করে টাকাগুলো জোগাড় করেছিলেন। - এখন তো তোমার মেডিক্যাল পরীক্ষা দেয়া হবে না। - তাতে কী! আগামী বছর না হয় পরীক্ষা দেবো। - তুমি আমার মতো কাপুরুষের জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করলে। তোমার স্বপ্নটা তো ভেঙে গেল। - আমার স্বপ্নের চেয়ে তোমার মায়ের জীবন অনেক মূল্যবান। রাতুল ভাবল, একজন মানুষের পক্ষে আর কতটা ত্যাগ করা সম্ভব?
আরও পড়ুন...