দখল ।  তমসুর হোসেন

দখল । তমসুর হোসেন

গল্প জানুয়ারি ২০১৯

দখলএক গৃহস্থ বাড়ির বারান্দায় থাকতো এক কালো কুকুর। বাহির ঘরের খোলামেলা টানা বারান্দায় সে দিনরাত শুয়ে থাকতো। দিনের বেলা খাওয়ার সময়টুকু বাদে সে চুপচাপ ঘুমালেও রাতে অত্যন্ত সতর্কভাবে সে গৃহস্থের বাড়ি পাহারা দিতো। এ নিয়মের একটুও হেরফের করতো না সে। গৃহস্থের বাড়ির দক্ষিণে ছিল একটা বিরাট বাজার। সেই বাজারে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে। হাটের দিনে কসাইরা গরু, ছাগল, ভেড়া আর মহিষ জবাই করে সারি বেঁধে মাংস বিক্রি করে। তাছাড়া মুদির দোকান, সন্দেশ আর হোটেল রেস্তোরাঁর জমজমাট মেলা বসে সারা বাজার জুড়ে। কত যে খাবার ছড়াছড়ি হয় সেখানে! পাড়ার কুকুরগুলো বাজারে গিয়ে হল্লা করে সময় কাটিয়ে মনের মতো খাবার খেয়ে আসে। তারা বাজারের ফাঁকা জায়গায় দিনরাত দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলা করে। তারা মাঝে মাঝে কলহে লিপ্ত হলেও সেটাও একপ্রকার আনন্দের বিষয় বলে ধরে নেয়া চলে।
কিন্তু কালু বারান্দা ছেড়ে কোথাও যায় না। সে কারণে অন্যরা তাকে ঘরকুনো বলে ক্ষ্যাপাতো। তাতে সে একটুও রাগ করতো না। সে বড়জোর সামনের জাম গাছের ছায়ায় শুয়ে থাকতো। বাড়িটা ছিল পশ্চিমমুখী। বিকেলবেলা বারান্দায় রোদ পড়তো। শীতকালে সে রোদ মিষ্টি লাগলেও গরমের দিনে রোদের প্রচণ্ড উত্তাপে বারান্দাটা আগুনের মতো গরম হয়ে যেতো। তখন সে বাধ্য হয়ে জাম গাছের তলায় গিয়ে বাড়ির দিকে মুখ করে শুয়ে থাকতো। বারান্দায় ঘুম এলেও গাছের নিচে কখনোই তার মন বসে না। তার কোনো বন্ধু-বান্ধব ছিলো না। সে মন খুলে কারও সাথে কথা বলতো না। কুকুরের কাজ মনিবের বাড়ি পাহারা দেয়া। কিন্তু তাই বলে বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যেতে তার মানা কিসের। এ নিয়ে পাড়ার অন্য কুকুররা তাকে বেশ চটাতো।
বাড়ির মালিক ধান চাল এবং পাটের ব্যবসা করতেন। হাল গৃহস্থিও ছিলো তার। তিনি ছিলেন কিছুটা রাগী স্বভাবের। তার বউ চুরি করে আবাদ এবং ব্যবসার ধান চাল বিক্রি করতো। তার ছেলেরা ছিল বখাটে এবং নেশাখোর। তারাও বাবার ব্যবসার পণ্য বিক্রি করে হাটে-বাজারে আড্ডা দিয়ে বেড়াতো। তারা নেশা করে রাস্তাঘাটে ঝগড়া ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতো। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে তারা কলহ করে পারিবারিক শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করতো। ছেলেপেলে এবং বউয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মালিক মাঝে মাঝে খুব হতাশ হয়ে পড়তো। বউকে ডেকে নিয়ে সে বলতো :
‘এমন করলে সংসার চলবে?’
‘কী হয়েছে?’
‘কী হয়েছে মানে। দশ মণ ধানের পাঁচ মণ গেলো কোথায়?’
‘সেটা তুমি জানো। আমরা কি ধানের কারবার করি?’
‘তোমার ছেলেরা নেশা করে। অতো টাকা পায় কোথা থেকে?’
‘সেটা আমাকে জিজ্ঞাসা করো কেন। আমি কি বাজারে আড্ডা দেই।’
‘বাজারে আড্ডা দাও না। তবে বাড়িতে বাটপাড়ের হাট বসাও।’
‘এসব অপবাদ দেবে না। ছেলেকে শাসন করতে পারো না। আমার সাথে খবরদারি।’
‘তোমাদের খাওয়ানো আমার লস। আমার কালুই ভালো। ওকে আমি সব লিখে দেবো।’
‘আমরা তো তোমার কিছুই না। কালুই তোমার সব।’
‘ও আমার বাড়ি পাহারা দেয়। একটা কড়িও সে ক্ষতি করে না। ওকে আমি সব দিয়ে যাবো।’
কালু এসব কথা শুনতো আর মনে মনে খুশি হতো। এ বাড়ির লোকদের যা ব্যবহার তাতে তার বিশ্বাস হয় একদিন মালিক তার নামে সম্পত্তি লিখে দিতেও পারে। অতএব এ বাড়িটাকে যত্ন করে আগলে রাখা তার একান্ত কর্তব্য। এ জন্য সে বাড়ি ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্য কোথাও যায় না। দেখে তো মনে হয় সে সারাদিন চোখ বন্ধ করে ঘুমায়। আসলে সে একদম ঘুমায় না। চোখ বুজে কল্পনার আকাশে উড়ে বেড়ায়। এরকম একটা বাড়ির মালিক হওয়া তো সহজ কথা নয়। এ জন্য সে ভেতরে ভেতরে দারুণ গর্ববোধ করতো।
একদিন বাড়ির মালিক অনেক মালপত্র কিনে গুদামে রেখে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যায়। সেখানে জমিজমা সংক্রান্ত বিশেষ কাজে তার বাড়ি ফিরতে বেশ কিছুদিন দেরি হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে সে তো হতবাক। গুদামের তালা ভেঙে কারা যেন সব মাল সরিয়ে নিয়ে গেছে। কালু বাধা দিয়েছে বলে তাকে মেরে ক্ষতবিক্ষত করেছে দুর্বৃত্তরা। বাড়ির লোকেরা এ বিষয়ে কোন সদুত্তর না দিলেও কালু ইশারায় মালিককে সব বুঝিয়ে দিলো। মালিক বিষয়টি বুঝতে পারলো। একটা অবোধ কুকুর যেখানে তার মালামাল রক্ষার জন্য লড়াই করে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে সেখানে তার সন্তানেরা মনের সুখে নেচে বেড়াচ্ছে। মালিক তার স্ত্রী এবং ছেলেদের ডেকে নিয়ে কাছে বসালো। তাদের চেহারার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ডেকে নিয়ে গেল কালুর কাছে। তারপর বললো:
‘এই গুদাম পাহারার দায়িত্ব তোমাদের না কালুর?’
‘গুদাম তো ওই পাহারা দেয়। মানুষ কুকুর পোষে কিসের জন্য।’
‘তোমাদের কোন দায়িত্ব নেই?’
‘ডাকাতের সাথে লড়াই করে আমরা জান হারাতে যাবো?
‘আমার বিশ্বাস তোমরাই এ মাল সরিয়ে ফেলেছো। কালু আমাকে সব বলেছে। একটু পরে পুলিশ আসবে। ভালো চাও তো সব খুলে বলো।’
‘কালু কী বলবে? বাড়ির লোককে অবিশ্বাস করে তুমি শুনছো কালুর কথা। ঠিক আছে কালুকে নিয়ে থাকো তুমি।’
বাড়ির মালিক ছিলো নামজাদা লোক। সব মহলে তার যাতায়াত ছিলো। তার বাড়ির মালামাল চুরি যাবার কথা শুনে দু’জন কনস্টেবল নিয়ে থানা থেকে দারোগাবাবু এসে তদন্ত করলেন। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা ঘন জঙ্গল ছিলো। সেখানে একটা লোক ফাঁসি দিয়ে মারা যাওয়ায় সচরাচর সেখানে কেউ যেতো না। দারোগাকে আসতে দেখে কালু বারবার ওই জঙ্গলের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। একবার সে আসে দারোগার কাছে, একবার যায় জঙ্গলের দিকে। কালুকে এমন করতে দেখে জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে সবাই অবাক হলো। চুরি যাওয়া সব মালামাল সেখানে কারা যেন স্তূপ করে রেখেছে। কে করতে পারে এমন জঘন্য কাজ। সবাই যখন এমন আলোচনায় ব্যস্ত তখন হঠাৎ কালু মালিকের বড় ছেলের পা কামড়ে ধরে সবার সামনে নিয়ে আসে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভীত হয়ে বাবার পা ধরে সব স্বীকার করে সে। মায়ের পরামর্শে লোক লাগিয়ে সে এ কাজ করেছে। সবার সামনে সে কান ধরে বলে কখনো এমন গর্হিত কাজ করবে না।
এ ঘটনার পর মালিকের কাছে কালুর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। সে কথা প্রসঙ্গে লোকজনের সামনে বলে কালুকেই আমার সবকিছু দিয়ে দেয়া উচিত। বাড়িতে ভাত দিয়ে আমি শত্রু লালন করছি। আসলে কালু ছাড়া সংসারে আমার আপন বলে কেউ নেই। পাশের বাড়িতে থাকতো আর একটা অল্প বয়সী কুকুর। সে মাঝে মাঝে কালুর কাছে আসতো। সে কালুর ভালো-মন্দ খবর নিতো। কোথাও ভালো কিছু পেলে সে কালুকে এনে খাওয়াতো। কালুর শরীর এখন প্রায়ই খারাপ হয়। কেননা তার বয়স বেড়েছে। মাথাব্যথা, সর্দিকাশি, জ্বরবমি প্রায়ই তার লেগে থাকে। ব্যস্ততার কারণে বাড়ির মালিক আগের মতো কালুর খোঁজখবর রাখতে পারে না। আর বাড়ির লোকেরা তো তাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচে। সে জন্য লালু এসে ওর এটা ওটা পরিচর্যা করে। এভাবে দু’জনের মধ্যে একটা গভীর ভাব জন্মে। কোনদিন কাউকে কাছে আসতে দেয়া তো দূরের কথা মেজাজ দেখিয়ে কালু সবাইকে তাড়িয়ে দিতো। বয়স বাড়ার কারণে সে অনেক দুর্বল হয়েছে। ওসব করতে এখন তার মন চায় না। সে জন্য লালুকে সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাছে আসতে দেয়। একদিন লালু বলে:
‘এরা তোমাকে ঠিকমতো খেতে দেয় না। এখানে পড়ে থাকো কেন?’
‘ছোটবেলা থেকে আছি। বুড়ো বয়সে কোথায় যাবো।’
‘তুমি তো বাজারেও যাও না। এরা কি তোমাকে জাদু করেছে?’
‘আরে না না। জাদু করবে কেন? আসলে বাজারের খাবার আমার পেটে সয় না।’
‘তুমিতো কোনোখানে বেড়াতেও যাও না। সারাদিন শুয়ে থাকো কেমন করে। বিরক্ত লাগে না?’
‘আরে দাদু! কোথায় যাবো। জ্ঞাতিগোষ্ঠী নেই। মনের দুঃখে এখানেই পড়ে থাকি।’
‘তা থাকো। থাকতে তো দোষ নেই। অত লাগিভাগি হয়ে থাকছো কেন। মালিক কি তোমাকে বেতন দেয়?’
লালুর কথায় কালুর মনটা ব্যথিত হয়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে:
‘আমি এখানে এমনি পড়ে আছি বলে মনে করো? আমি আছি বড় আশা বুকে নিয়ে।’
‘কী আশা? আমাকে একটু বলো না শুনি।’
‘তুমি যদি সবার সামনে ফাঁস করে দাও। তাহলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
‘যদি বিশ্বাস না করো বলবে না। তোমার ক্ষতি করে আমার কি লাভ?’
‘তুমি তো জান মালিকের বউ- ছেলে ভালো না।’
‘তা জানি। কিন্তু তাতে তোমার কি?’
‘ওসব নিয়ে মালিক আমাকে জড়িয়ে কথা বলে।’
‘কী বলে মালিক?’
‘বলে, ওদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে সবকিছু আমার নামে লিখে দেবে।’
‘কী যে আজেবাজে কথা বলো তুমি! কুকুরের নামে কেউ সবকিছু লিখে দেয়?’
‘সব সময় বলে তো। হুট করে দিতেও তো পারে।’
‘যা বলার আমাকে বলেছো। আর যেন কাউকে বলো না। যা সম্ভব নয় তাই ভেবে বসে আছো।’
‘তুমি ছেলে মানুষ বুঝবে না। লোকটা সংসার দিয়ে সুখ পায়নি। সে জন্য আমার বিশ্বাস হয়।’
‘ওসব কিছু হবে না। এখানে তোমাকে না খেয়ে মরতে হবে। পারলে অন্য কোথাও কেটে পড়ো।’
লালুর কথায় কালু মালিকের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যায় না। বারান্দা আঁকড়ে সে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে থাকে। সে ভাবে লালু তাকে ফুসলিয়ে এখান থেকে ভাগাতে চায়। তাকে তাড়িয়ে দিয়ে বাড়িটার দখল নিতে চায় সে। জীবন থাকতে কালু এ বাড়ি থেকে অন্য কোথাও যাবে না। সে খুব রেগে যায়। কোথাকার এক পুচকে ছোঁড়া এসে তার এতদিনের সাধনা বিফল করে দেয়ার চেষ্টা করছে। সে লালুকে বলে:
‘ভালো যদি চাস এখান থেকে চলে যা। না হলে তোর বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো।’
‘কেন দাদু আমি কি করেছি? তোমাকে ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি, আর তুমি খারাপ মনে করছো।’
‘আমাকে বুদ্ধি দেয়ার দরকার হবে না। আমার ভালো আমি বেশ বুঝি।’
‘তুমি বুড়ো হয়েছ। তোমার মাথা ঠিক নেই। পরের বাসায় বয়স ক্ষয় করে কি লাভ হচ্ছে?’
কালু ছুটে এসে লালুকে একটা আছাড় মারে। তারপর ধারালো দাঁত দিয়ে কামড় মেরে তার শরীর বিক্ষত করে ফেলে। সে অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বলে, পাজির বাচ্চা আমাকে তাড়িয়ে বাসা দখল করতে চাস? ভালো চাস তো এদিকে কোনদিন আসার চেষ্টা করবি না।’ কালুর আচরণে লালু ব্যথিত হয়। সে চোখের পানি মুছে নীরবে সেখান থেকে চলে যায়।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ