দশে মিলে করি কাজ

দশে মিলে করি কাজ

গল্প জুলাই ২০১৫

মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত#

ডাক্তার বাড়ির কাচারিতে বৈঠকের আয়োজন চলছে, ঘণ্টাখানেক পরেই অর্থাৎ আসরের নামাজের পর বৈঠক শুরু হওয়ার কথা। ডাক্তার বাড়ির ছেলেপুলেরা বাড়ির ভেতর থেকে চেয়ার, মোড়া, পিঁড়ি নিয়ে এসে কাচারির সামনে উন্মুক্ত জায়গায় রাখছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে জনা পঞ্চাশেক লোকের বসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মাঝে একটা মোড়ার ওপর পান-সুপারির বেশ আয়োজন দেখা যাচ্ছে। গ্রামের বৈঠকগুলোতে পান-সুপারিই আপ্যায়নের অন্যতম মাধ্যম। এই গ্রামে যখনই কোনো বৈঠক কিংবা বিচার-আচারের প্রয়োজন হয় তখনই সবাই ডাক্তার বাড়ির সদর দরজায় কাচারির সামনে জড়ো হয়। কাচারিটি একটি আধাপাকা ঘর। ওপরে টিনের চালা ছাড়া বাকি সবটাই ইটের তৈরি। জরাজীর্ণ না হলেও দেখেই বোঝা যায় এটি একটি পুরনো বিল্ডিং। আশপাশ কয়েক গ্রামের এটিই প্রথম বিল্ডিং। কাচারির দেয়ালের সাথে সাঁটানো দু’টি পাকা ইটের কারুকাজের বেঞ্চি লম্বা লম্বা ভাবে বসানো। এই দু’টি বেঞ্চে বসেই যাবতীয় বৈঠকের আয়োজন করা হয়। মাঝে মধ্যে লোকজনের সংখ্যা বেশি হলে ডাক্তার বাড়ির লোকজন বাড়ির ভেতর থেকে চেয়ার, মোড়া, পিঁড়ি দিয়ে বসার প্রয়োজন মেটায়।
সালাতুল আসরের পর ইমাম হজরত আলীর নেতৃত্বে এলাকার মুরুব্বিরা এসে বেঞ্চ, মোড়া ও চেয়ারে যার যার আসনে বসেন। আরও কয়েকজন আসতে এখনও বাকি। জমিলার বাপ আজকের সভার সভাপতিত্ব করবেন। তিনি গ্রামের সবার মুরুব্বি। গ্রামের সবাই তার কথা মান্য করে। সবাই আসার পর বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে শুরুতেই জমিলার বাপ কিছু কথা বলেন। আজকের সভার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো ডাকাতিয়া নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি করে গ্রামের লোকজনের সীমাহীন কষ্ট লাঘব করা। নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি করা সহজ কথা নয়। কিভাবে এগোনো যায় সে ব্যাপারেই সলাপরামর্শ প্রয়োজন। শুরুতেই উত্তর পাড়ার এয়াকুব মিয়া হাত তুলে বললেন, চাচা আমার কিছু কথা আছে, আমি আগে বলতে চাই। জমিলার বাপ বললেন, আচ্ছা তুমি আগে বল তাহলে।
এয়াকুব মিয়া ক্ষোভের সাথে জানতে চাইলেন- গত ইলেকশনের আগে প্রার্থীরা আমাদের কাছে ওয়াদা করেছিল তারা নির্বাচিত হতে পারলে আমাদের ব্রিজ করে দেবে। কিন্তু এক নির্বাচন গিয়ে আর এক নির্বাচন ঘনিয়ে এলো, আমাদের ব্রিজের কোনো কূলকিনারা হলো না। তখন সবাই সমস্বরে বলে উঠল, হ হ এয়াকুব মিয়া ঠিকই বলেছে। আগে আমাদের জানা দরকার যারা আমাদের কাছে ওয়াদা দিয়েছিল, ওয়াদা দিয়ে ভোট নিয়েছিল। আমাদের ভোটে এমপি-মন্ত্রী হইল- তারা এখন কই? তারাতো আমাদের বেমালুমই ভুলে গেল। নির্বাচিত হলে বছরখানেকের মধ্যেই ব্রিজ করে দেবে বলেছিল। অথচ আজ চার বছরেও তাদের দেখা মেলা ভার।
জমিলার বাপ সবাইকে থামিয়ে বললেন, শোন- এসব তো আমাদের সবারই জানা, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আমাদের কদর বাড়ে আর নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে আমাদের আর খোঁজখবর কেউ রাখে না। কত সরকার এলো কত সরকার গেল। মন্ত্রী হইল, এমপি হইল, নদীর জায়গায় নদী রইল, আমাদের দুর্ভোগ বাড়ল, কিন্তু ব্রিজ হইলো না। এইতো গত নির্বাচনের আগে এমপি সাব আমাদের গ্রামবাসীর সামনে আগেরবার এমপি থাকা অবস্থায় ব্রিজ করে দিতে না পারার জন্য ক্ষমা চাইলেন, বললেন এবার যদি এমপি হতে পারি তাহলে একটা ডিজিটাল উন্নতমানের ব্রিজ করে দেবো। কই ডিজিটাল তো দূরের কথা একটা কাঠের সাঁকোর ব্যবস্থাও তো করতে পারলেন না। আগে এমপি ছিলেন এবার মন্ত্রী হলেন। তারপরও তো আমজনতার কোনো লাভ হলো না। এমপি থেকে মন্ত্রী হয়ে নিজের আখের গোছালেন, নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটল। কিন্তু যাদের ভোটে এমপি-মন্ত্রী হলেন তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না। জমিলার বাপ কথাগুলো বলতে বলতে বুকভরা একটা বড় নিঃশ্বাস নিলেন। এবার আর ওপরের দিকে তাকিয়ে লাভ নাই যা করার আমাদেরই করতে হবে বললেন জমিলার বাপ। একটা মূল্যবান কথা আছে- ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’। আমরা গ্রামের সবাই মিলে একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করতে চাই। তোমরা সবাই যদি এ ব্যাপারে একমত হও তবে সেটা কিভাবে করা যায় এ ব্যাপারে পরামর্শ আসতে পারে।
একে একে সবাই তাদের মতামত পেশ করল। এ বিষয়ে সবাই একমত যে, মন্ত্রী-এমপিদের দিকে তাকিয়ে থেকে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি আর অপেক্ষার প্রহর গণনা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না গ্রামের মানুষের ভাগ্যে। বরং জমিলার বাপ মুরুব্বি মানুষ, তার প্রস্তাবটাই গ্রহণযোগ্য। গ্রামের সবাই মিলে মিশে একটা সাঁকো তৈরি করা যায়। দক্ষিণ পাড়ার ইলিয়াস হাত তুলে বলল, কিন্তু চাচা এতো বড় একটা সাঁকো তৈরি করাও তো চাট্টিখানি কথা নয়। এতো বাঁশ, কাঠ কোথায় পাবেন? ইমাম হযরত আলী বললেন, দেখুন এটা ঠিক, ডাকাতিয়া নদীর ওপর যে সাঁকো তৈরি করার প্রস্তাব এসেছে এটা অনেক কঠিন কাজ, তবে আমরা গ্রামের সবাই যদি হাত বাড়িয়ে দিই, সকল যুবক যদি কাজে হাত লাগাই তাহলে একটি সাঁকো সেটা যত বড়ই হোক তৈরি করা কঠিন কিছু হবে না। এ জন্য গ্রামের প্রতিটি বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ সংগ্রহ করতে হবে। প্রত্যেকটি বাড়ি থেকে যদি একটি করে গাছ দেয়া হয় তাহলে খুঁটি ও কাঠের সমস্যা হবে না। আর গ্রামের বিত্তবানদের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে বাকি সরঞ্জামও ব্যবস্থা করা সম্ভব। ইমাম হযরত আলীর এই প্রস্তাবটি সবার মনোপূত হলো। জমিলার বাপ সবার সাথে পরামর্শ করে বিভিন্ন কমিটি করে দিলেন। কেউ বাঁশ সংগ্রহ করবে, কেউ কাঠ, কেউ গাছ। আর সবার পরামর্শে জমিলার বাপ ও ইমাম হযরত আলীসহ ৫ জন সম্মানিত ব্যক্তির সমন্বয়ে বিত্তবানদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য কমিটি করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো আগামীকাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে বাঁশ, গাছ ও অর্থ সংগ্রহের কাজ।
পরদিন ফজরের নামাজের পর পুরো গ্রামে ঢাকঢোল পিটিয়ে জরুরি ঘোষণা দেয়া হলো। ঘোষণায় বলা হলো, প্রিয় গ্রামবাসী আসসালামু আলাইকুম, আনন্দের খবর শুনুন, আমাদের গ্রামের সকল মুরুব্বি মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে গ্রামের সকলের সহযোগিতা নিয়ে ডাকাতিয়া নদীর ওপর একটি সাঁকো তৈরি করা হবে। আপনাদের যার যা সামর্থ্য আছে তা উত্তর পাড়ার করিম মাঝির ঘাটের বটতলায় দিয়ে আসবেন। তা ছাড়া আমাদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আপনাদের বাড়ি বাড়ি আসবে। আপনারা আপনাদের বাড়ি থেকে বাঁশ, গাছসহ সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা দেবেন, মনে রাখবেন ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’। এই কথাগুলো বলে প্রত্যেক বাড়ির দরজায় ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিয়ে আসা হলো। এই প্রচারণায় এলো এক উৎসবমুখর পরিবেশ। গ্রামের শিশু-কিশোররাও দলবেঁধে ঢাকঢোল পেটানো লোকজনের পিছু পিছু গ্রামের এপাড়া থেকে ওপাড়া ছুটে বেড়াল। শিশু-কিশোদের সে কি আনন্দ! বাড়িতে গিয়ে তারাও তাদের বাবা-মায়েদের ডাকাতিয়া নদীর ওপর সাঁকো তৈরির খবর জানাল। এভাবে প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল সাঁকো তৈরির আনন্দবার্তা।
ঢাকঢোল পেটানোর পরদিন থেকেই গ্রামের সকলের গমনের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠল উত্তর পাড়ার করিম মাঝির ঘাটের বটতলা। কারো হাতে বাঁশ, কারো হাতে কাঠ, কারো হাতে খুচরা টাকা, পয়সা। যার যা আছে তাই নিয়ে ছুটলো করিম মাঝির ঘাটে। আর যাদের কিছুই দেয়ার ছিল না তারা এসে বটতলায় স্বেচ্ছাসেবক তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়ে গেল। গোটা গ্রামের দৃশ্যই যেন হয়ে উঠল এক অভূতপূর্ব মিলনের। সবাই এক কাতারে শামিল হলো একটি সাঁকোর জন্য। এক দিকে গ্রামের প্রতিটি বাঁশঝাড় থেকে সংগ্রহ হতে লাগল বিপুল পরিমাণে বাঁশ, জমা হতে লাগল করিম মাঝির ঘাটে। অন্য দিকে বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত গাছ কেটে পাঠানো হলো করাতের মিল কারখানায়। এ দিকে জমিলার বাপ আর ইমাম হযরত আলীরাও বসে নেই। তারাও গ্রামেগঞ্জে বিত্তবানদের কাছ থেকে আদায় করছেন আর্থিক সহায়তা। এক সময় বিপুল পরিমাণ বাঁশ, করাতের মিল কারখানা থেকে কাটা গাছের কাঠ আর সাঁকো তৈরির বাকি সরঞ্জামের বিশাল স্তূপ তৈরি হলো করিম মাঝির ঘাটের বটতলায়। অল্প কয়েকদিনেই সাঁকো তৈরির সব কিছুই প্রস্তুত হয়ে গেল, অপেক্ষা শুধু কাজ শুরু হওয়ার।
শুক্রবারে সাঁকো তৈরির জন্য সফলতা কামনা করে গ্রামের মসজিদে মসজিদে দোয়ার আয়োজন হলো। জুমার নামাজের পর সবাই উত্তর পাড়ার করিম মাঝির ঘাটে হাজির হলো। সেখানেও ইমাম হযরত আলীর দোয়া-মুনাজাতের মাধ্যমে কাজ শুরু হলো সাঁকো তৈরির। গ্রামের প্রতিটি যুবক অংশ নিলো সেই কাজে। সবাই নিজ নিজ বাড়ি থেকে দা, কুড়াল, খন্তা, কোদাল নিয়ে এসে কাজে লেগে গেল। কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ গর্ত খুঁড়ছে, কেউ পেরেক মেরে কাঠ তৈরি করছে। গ্রামের কাঠমিস্ত্রি যারা তারাও কাঠের পরিশ্রমের মাধ্যমে সাঁকো উপযোগী করে কাঠ বাঁশ তৈরি করছেন। ডাকাতিয়া নদীতে ছিল তখন কোমর পানি। গ্রামে যাদের নৌকা ছিল তারা সেই নৌকা নিয়ে এসে কাজে যোগ দিল। বাড়ি থেকে কিশোর ছেলেমেয়েরা এসে পানি, খাবার, নাশতা দিয়ে যাচ্ছিল, আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে আহার করে শক্তি সঞ্চার করে আবার নতুন করে সবাই কাজে নেমে পড়ছিল। সবাই মিলেমিশে যখন কাজ করছিল তখন তৈরি হয়েছিল এক অভূতপূর্ব, অসাধারণ দৃশ্য। অল্প কয়েকদিনেই তৈরি হয়ে গেল ডাকাতিয়া নদীর ওপর সেই কাক্সিক্ষত সাঁকো। যে একটি সাঁকোর অভাবে গোটা গ্রামের মানুষের জীবন থমকে গিয়েছিল, আজ মিলেমিশে সবার পরিশ্রমে সেই জীবনে হলো নতুন করে গতি সঞ্চার। স্বেচ্ছাশ্রমের এক অনন্য নজির স্থাপন করল গ্রামের যুবকেরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সোৎসাহে কাজ করে বাড়ি ফিরে আবার সকালে এসে যে যার মত করে কাজে লেগে যেত। তাদের উৎসাহের ক্ষেত্রে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, মনে হচ্ছিল সাঁকো তৈরি করা ছাড়া তাদের আর বিশ্রাম নেই। সবার তরে গ্রামের সকলের সমস্যা লাঘবে একটা সাঁকো তৈরির জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের এক অনন্য নজির ছিল স্বেচ্ছাশ্রমে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ