দস্যুদল     -আব্দুল্লাহ আদনান

দস্যুদল -আব্দুল্লাহ আদনান

তোমাদের গল্প নভেম্বর ২০১৫

রিদম, মেঘ ও সামির- তিনজনই প্রত্যেকের ছোট ব্যাগে আনা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নতুন করে দেখে নিচ্ছিল। টর্চলাইট, কলম, পেন্সিল, ছোট খাতা, ছুরি, দড়ি প্রভৃতি। তিনজনই বাড়ি থেকে এগুলো সংগ্রহ করেছে।
ওরা আজ এক অভিযানে বের হচ্ছে। ওদের গ্রামের নদীর ওপারের পোড়োবাড়িটাতে। ওরা ওদের বাবা-মা ও গ্রামের লোকদের কাছে শুনেছে অনেক আগে এক ডাকাত দল একজন ধনী ব্যক্তির বাড়িতে ডাকাতি করে অনেক সোনাদানা ও রাশি রাশি মোহর পেয়েছিল। তবে পুলিশ তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছিল। এ কারণে তারা ঐ বাড়িতে আত্মগোপন করে। এর বেশ কয়েক বছর পর তাদের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এর কার্বন টেস্ট রিপোর্টে বলা হয়, তারা খাদ্যাভাবে মারা গিয়েছিল ঐ ঘটনার ৭ দিনের মাথায়। তবে ডাকাতি করা ঐ ধনসম্পদ উদ্ধার করা যায়নি। এত বছর পর ঐ ঘটনা সম্পর্কে জেনে ওরা তিনজন পাগল হয়ে গিয়েছিল ঐ সম্পদ উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু বাড়িটি সম্পর্কে অনেক গুজব থাকায় প্রচুর বাধা এসেছে। সেই বাধা মাড়িয়ে ওরা অভিযানে তখন যেতে না পারলেও আজ যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর রিদম তার রেডিয়াম ডায়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন আটটা। চল আমরা নদীর দিকে যাই। এখানে যেই ভেলা রেখে যাওয়া হয়েছিল, তা দিয়েই ওপারে পৌঁছে যেতে পারব।’ সামির ও মেঘ সাথে সাথেই রাজি হলো। ওরা সবাই ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পা উঠাল।
ভেলা নিয়ে নদীর ওপারে পৌঁছেই ওরা পোড়োবাড়ির চার পাশের ম্যাপটা একবার দেখে নিলো। দিনের বেলায় মেঘ ও রিদম এসে পোড়োবাড়ির চার পাশটা ঘুরে একটা দিকনির্দেশক ম্যাপ এঁকে নিয়েছিল। ম্যাপ দেখা হলে ওরা সবাই প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। দেখল বিরাট গেটে একটা তালা ঝুলানো। তবে তালা কাটা ছাড়া ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। ওরা সবাই ঠিক করল তালা কাটতে গেলে শব্দ হবে যাতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং গেট ডিঙিয়ে ওপারে পৌঁছানো-ই শ্রেয়। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। তবে ওরা মাটিতে লাফিয়ে পড়ার সাথে সাথেই একঝাঁক বাদুড় উড়ে গেল ওদের মাথার ওপর দিয়ে। এরপর টর্চ দিয়ে ওরা চার পাশটা দেখতে লাগল। মেঘ তার টর্চের আলোতে একটা গেটের দিকে ইশারা করল। কারো বুঝতে বাকি রইল না ওটা বাড়িতে ঢোকার গেট। তবে এখানে সমস্যায় পড়তে হলো। এ গেটটা একটা কাঠের গেট। এর ওপর একটা তালা ঝুলানো, ওরা টর্চ দিয়ে দেখতে লাগল। এমন সময় মেঘ প্রায় চিৎকার করে বলতে লাগল, দেখ, তালার ওপর একটা সবুজ রঙের চতুর্ভুজ, লাল রঙের বৃত্ত ও হলুদ রঙের ত্রিভুজ, ওরা সকলে ভাবতে লাগল নিশ্চয় এটা কোনো ধাঁধা। ঠিক তখনই মেঘ ইউরেকা, ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠল। চিৎকার করেই ও ওর বুড়ো আঙুল দিয়ে আগে চতুর্ভুজের এরূপ ত্রিভুজের ওপর চাপ দিতেই মরিচা পড়া তালা কট শব্দে নড়ে উঠল। সবার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সামির বলল, এটার অর্থ? মেঘ বলল, সবুজ ও হলুদ রঙ মেশালে হয় নীল। আর সেটা আভিজাত্যের প্রতীক। ওরা এবার কাঠের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢুকেই দেখল প্রকান্ড একটি বাড়ি এটা। ফলে এখানে প্রচুর জায়গা। আর বর্তমানে ওরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তা একটি হলঘর তবে ড্রয়িংরুমও বলা যায়। এখানে অনেক সোফা টাইপের গদি পাতা। ওরা সবাই সিদ্ধান্ত নিলো বাড়ির প্রতিটি সূক্ষ্মস্থান খুঁজে দেখা হবে। কেননা, ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’। বাড়িটিতে কমপক্ষে ত্রিশটি ঘর। দেখে বোঝাই যাচ্ছে বাড়িটি আদি কালের। লোকটি জমিদার হলেও হতে পারে। প্রায় দেড়ঘণ্টা পর ওরা সব ঘর গরু খোঁজা শেষে একেবারে শেষ ঘরটিতে পৌঁছল। প্রতিটি ঘরের খুঁটিনাটি সব কিছু খুঁজেছে। তবে তেমন অস্বাভাবিক কিছুই নজরে পড়েনি। শেষ ঘর খুঁজতে গিয়ে রিদম একটি চিঠি পেল। সবাইকে সেটা দেখিয়ে ওটা পড়তে শুরু করল। আমরা পেটের টানে ডাকাতি করেছিলাম। আজ সাতদিন হতে চলল কিছুই খেতে পাইনি, পানি পর্যন্তও না। আমাদের দুই সহযোগী মারা গেছে। আমরাও মুমূর্ষু। পুলিশ খুঁজছে আমাদের। তাই বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না। কেননা, পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ফাঁসি হতে পারে। তবে তা সমস্যা নয়। অন্যায় যখন করেছি তখন শাস্তি তো পেতে হবেই। তবে আমরা ধরা পড়লে আমাদের পরিবারকে অপবাদ সইতে হবে। কিন্তু আমাদের শাস্তি তারা কেন পাবে? জানলে তো তারা এ পথে কখনও আমাদের আসতেই দিত না। এ জন্য শুকিয়ে মরা বেছে নিলাম। আর যে মোহর চুরি করেছি, তা লুকিয়ে রেখে যাচ্ছি, যাতে কেউ চোরের ওপর বাটপাড়ি, করতে না পারে। আর এখন এ চিঠি লিখে রেখে যাচ্ছি যাতে কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি তা উদ্ধার করেন। তবে সে যেন উক্ত ব্যক্তিকে এটা ফেরত দেন, আর তা যদি না হয় তবে মানবতার কল্যাণের জন্য এটা দান করেন। এভাবে তিনি হয়তো আমাদের পাপের বোঝা একটু হলেও লাঘব করবেন। রাব্বুল আলামিনের ওপর ভরসা করেই এটা রেখে যাচ্ছি, যাতে উপযুক্ত ব্যক্তি এটা পান মোহরের জন্য তিনি যেন ‘দুই’ শিরোনামের চিঠিটা সমাধান করেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিদম পড়া শেষ করল। ‘দুই’ শিরোনামের চিঠিটাও পাওয়া গেল। ঐ চিঠির পাশেই ছিল। এটাও খুলল রিদম নিজেই। পড়া শুরু করল, ‘রলাত দু রেত্তউ রানেডা ররেঘ রেডোরিক টাকএ রলেফু বট ছেআ রবেট ররেতভে টিমা য়েরিস টাকএ শাকন বেপা যা য়েদি রাদ্ধাউ বেহ ররিচু নধ’
রিদমের পড়া শেষ হলেই সবাই ঝুঁঁকে পড়ল চিঠির ওপর। একে একে ওরা দু’জনেই পড়ল। বারবার পড়ল। কিছু না বুঝতে পেরে খাতা, কলম নিয়ে বসল সবাই। ভাবনার কালো ছায়া সবার চোখে মুখে। প্রায় পৌনে একঘণ্টা চেষ্টার পর সামিরের আলহামদুলিল্লাহ শুনে চমকে উঠল বাকি দু’জন। বলল, কী হলো?
- পেয়ে গেছি।
- কী? উত্তর?
- হ্যাঁ।
কোথায়? দেখাও দেখি?
সামির ওর খাতাটা এগিয়ে দিল। ওরা লুফে নিলো খাতা, দেখল উত্তরটা :
‘দু’ তলার উত্তরে ডানের ঘরের করিডোরে একটা ফুলের টব আছে। টবের ভেতরের মাটি সরিয়ে একটা নকশা পাবে যা দিয়ে উদ্ধার হবে চুরির ধন।’
ওরা সাথে সাথেই দৌড়ে ওপর থেকে নকশা নিয়ে এলো। নকশা অনুযায়ী কুয়ার ভেতর ফেলে দেয়া হয়েছে উক্ত ধন। ওরা দু’জন দড়ি ধরে নেমে পড়ল আর মেঘ ওপরে থাকল। বেশ কিছুক্ষণ পর তিন বস্তা মোহর ও সোনা খুঁজে পেল। উপরে তুলল সব ধন-সম্পত্তি। এদিকে সুবহে সাদিকের আলো ফুটে উঠেছে। ওরা বস্তা নিয়ে হাঁটতে লাগল গ্রামের পথে। যখন ওরা গ্রামে পৌঁছাল তখন সারা গ্রামে হইচই পড়ে গেছে। ওদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ওরা রাতের আঁধারে গোপনে মিশনে গেছে। তাই সকালে বাবা-মা ওদের বিছানায় না পেয়ে সবাইকে খবর দিয়েছে। এরই মধ্যে ওদের আগমনে আকাশের চাঁদ হাতে পেল সবাই; তবে বস্তা দেখে কৌতূহলের সীমা নেই। পুরো ঘটনা জানার পর বিস্ময়ে সবার চোখ ছানাবড়া। ভাবা যায়! তিনজনে বস্তা বোঝাই মোহর এনেছে পোড়োবাড়ি থেকে; যেখানে যেতেই কি না ভয় পায় সবাই! পোড়োবাড়ি অভিযানের পর সবার কাছে ওরা রীতিমতো বনে গেল দস্যুদল।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ