দুর্গম পথের যাত্রী    -আসাদ বিন হাফিজ

দুর্গম পথের যাত্রী -আসাদ বিন হাফিজ

উপন্যাস আগস্ট ২০১৫

খালিদ আবু সুফিয়ানের দরবার থেকে বেরিয়ে গেল। অন্যরা তখনও ওখানেই বসা। আবু সুফিয়ান কিছুটা সংযত হয়ে নঈমকে লক্ষ্য করে বললো, ‘নঈম, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কাব বিন আসাদ এভাবে চোখ উল্টে ফেলবে। সে হয়তো মাতাল অবস্থায় তোমাকে কিছু বলে থাকবে।’
‘আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি অন্য কাউকে পাঠিয়ে যাচাই করতে পারেন।’
আবু সুফিয়ানের দিকে তাকিয়েছিল সবাই। আকরামা বললো, ‘আমি যেতে চাই আসাদের কাছে।’
‘তুমি যাবে?’ একটু ভেবে নিয়ে আবু সুফিয়ান বললো, ‘যেতে পারো। সে যদি এখনও আমাদের পক্ষে আছে মনে করো তবে জামানত হিসেবে কয়েকজনকে তার কাছ থেকে চেয়ে নেবে। একবার জামানত হাতে পেলে সে আর মত পাল্টাতে পারবে না।’
‘যদি জামানত দিতে রাজি না হয়?’ জানতে চাইল আকরামা।
‘রাজি না হলে বুঝতে হবে তার মতলব ভাল নয়।’
নঈম বললো, ‘আমি তার কাছ থেকে বিপদের আশঙ্কা করছি।’
আবু সুফিয়ান আকরামাকে বললো, নঈমের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ইহুদিদের বিশ্বাস করা আসলেই কঠিন। তুমি এক কাজ করো, তোমার কিছু সৈন্য সঙ্গে নিয়ে যাও, বিপদ দেখলে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রইলো তোমার।’
সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে গেল আকরামা। কয়েকজন সুঠামদেহী সৈনিককে সাথে নিলো। তাদের পথ দেখানোর জন্য সঙ্গে গেল নঈম। সে সোজা পথে না নিয়ে তাদেরকে ঘুর পথে নিয়ে চলল। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে অবশেষে ওরা বনু কোরায়জার মহল্লায় ঢুকলো।
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মার্চ। দিনটি ছিল শুক্রবার। তাতানো রোদের তীব্রতা মাড়িয়ে ওরা যখন কাব বিন আসাদের বাড়ির সামনে পৌঁছলো বাড়ির মালিক তখনও মদে মাতাল। কিন্তু যেই শুনলো আকরামা এসেছে, তার মাতাল ভাব পুরোপুরি কেটে গেলো। সে জানে আকরামা কেন তার কাছে এসেছে।
‘এসো আকরামা।’ দরজার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে কাব বিন আসাদ বললো, ‘তোমার আসার কোন দরকার ছিল না। আমি জানি তুমি কেন এসেছো। কিন্তু আমার সাথে এখন আলোচনা করে লাভ নেই। আমি দায়িত্ব থেকে দশ দিনের জন্য ছুটি নিয়েছি।’
আকরামা ঘরে ঢুকে বললো, ‘আগে আমার কথা শোন। পরিস্থিতি এখন খুবই জটিল। অলস বসে থাকার সময় আমাদের হাতে নেই। আমরা হামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আকরামার দিকে তাকিয়ে কাব বিন আসাদ বললো, ‘বসো।’ তারপর চাকরের দিকে ফিরে ইশারায় কিছু বললো। চাকর কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। আসাদ বললো, ‘শোন আকরামা, মুসলমানদের সাথে চুক্তি করেছি ইহুদিদের নিরাপত্তার স্বার্থে আর তোমাদের সাথে চুক্তি করেছি মুসলমানদের পরাজিত করার জন্য। আমরা তো চাই মুসলমানরা শেষ হয়ে যাক।’
কাব বিন আসাদের কথার মাঝখানে কামরায় প্রবেশ করলো এক সুন্দরী চাকরানী। তার হাতে ফলমূল ও মদের পেয়ালা। চেহারায় বুদ্ধির ছাপ। আকরামার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। কাব বিন আসাদ বললো, ‘এসো দোস্ত, সামান্য পান না করলে কি আলোচনা জমে? আগে কিছু পেটে দাও, তারপর কথা বলো।’
‘না।’ আকরামা বললো, ‘পানাহারের সময় নেই আমার। আগামীকালই আমরা মুসলমানদের ওপর হামলা করবো। হামলার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব তোমাদের। তুমি তোমার লোকদেরকে রেডি করো। চুক্তি অনুযায়ী তুমি তোমার জিম্মা পূরণ করো আমরাও আমাদের ওয়াদা পূরণ করবো।’
‘প্রিয় আকরামা, তোমার চোখে আমি রাগ দেখতে পাচ্ছি। তুমি এমনভাবে কথা বলছো, যেন আমরা তোমাদের গোলাম। তোমাদের কাজ হুকুম করা আর আমাদের কাজ তা পালন করা। কিন্তু আমরা একটি স্বাধীন জাতি। তোমাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে আমরা তোমাদের গোলাম হয়ে যাইনি। মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা ধর্মের দাবি। তাদের বাড়তে দিলে আমাদের ধর্ম হুমকির সম্মুখীন হবে। আমরা ধর্মের খাতিরে তোমাদের সহযোগী হতে রাজি হয়েছি। কিন্তু সহযোগিতার মানে তো গোলাম হওয়া নয়। বসো, মাথা ঠান্ডা করো। তোমার নির্দেশে তো আমরা তলোয়ারের নিচে মাথা পেতে দিতে পারি না। আমরা কি করবো, কি করতে পারবো সেটা আমাদের বলতে দাও।’
‘কাব, আমি কোন অযাচিত হুকুম করছি না। তোমরা কি করবে সে চুক্তি আগেই হয়েছে। এখন তোমার কাজ দু’টি। এক. চুক্তি অনুযায়ী তোমাদের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া আর তোমার ধর্মের হুকুম মেনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা। আর রাগের কথা বলছো? আমরা এমন সংবাদ পেয়েছি যে, তোমরা মুসলমানদের সাথে করা চুক্তি রক্ষায় যতটা আন্তরিক আমাদের সাথে চুক্তির ব্যাপারে ততটা আন্তরিক নও।’
‘তার মানে তোমরা আমাদের অবিশ্বাস করছো?’
‘তোমার ভূমিকা আমাদেরকে এমনটা ভাবতেই বাধ্য করছে।’
কাব বিন আসাদের চেহারা রাগে লাল হয়ে গেল। বললো, ‘অবিশ্বাস থাকলে তো এক সাথে কাজ করা সম্ভব নয়। তোমরা কি তবে আমাদের সাথে চুক্তি বাতিল করতে চাও?’
‘না, চুক্তি রক্ষার জন্য নিরাপত্তা জামানত চাই।’
‘সেটা কি রকম?’
‘তোমাদের গোত্রের দশজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমাদের হাতে দিয়ে দেবে, যাতে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। চুক্তি ভঙ্গ করলে ওদের আমরা হত্যা করবো।’
কাব বিন আসাদের ঠোঁটে ফুটে উঠলো কুটিল হাসি। আকরামার কথা শেষ হলে তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দোস্ত, খুবই উত্তম প্রস্তাব দিয়েছো তুমি। আমি রাজি তোমার প্রস্তাবে।’
এত সহজে কাব আকরামার প্রস্তাব মেনে নেবে ভাবেনি আকরামা। আকরামা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কাব বললো, ‘তবে একটা কথা আছে।’
আকরামা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কি কথা?’
‘তোমাদের যেমন জামানত দরকার তেমনি আমারও তো জামানত প্রয়োজন। আমার দশজনের বিনিময়ে তোমরা বনু গাতফান গোত্রের পাঁচজন ও কোরাইশ বংশের পাঁচজনকে পাঠিয়ে দেবে।’
রাগে আকরামার চেহারা লাল হয়ে গেল। বললো, ‘কি বললে? জামানতের বদলে জামানত দিতে হবে? আমরা কি তোমার মতো দু’মুখো সাপ। একদিকে সন্ধি করবে আমাদের সাথে অন্য দিকে সন্ধি করবে মুসলমানদের সাথে? আমরা খবর পেয়েছি, তুমি হাইয়া বিন আফতাবের সাথে করা ওয়াদার বরখেলাপ কাজ করছো, সে জন্যই জামানতের প্রশ্ন উঠেছে।’
‘রাগ করো কেন বন্ধু। একটু মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করো। জামানতের বদলে জামানত চাওয়াটা কি খুব অন্যায়?’
‘না, কিছুতেই তা সম্ভব নয়। তোমরা ওদেরকে মুসলমানদের হাতে হাওলা করে দেবে। জেনেশুনে এমন কাজ আমরা করতে পারি না।’
‘শোন আকরামা, আমি ওয়াদা করছি ওদের আমরা মুসলমানদের হাতে তুলে দেবো না। কিন্তু তোমরা যদি পরাজিত হও তখন আমরা মুসলমানদের বলতে পারবো, আপনারা ছিলেন শহরে। আমরা শহরের বাইরে ছিলাম আর আমাদের পাশে ছিল আপনাদের দশ হাজার দুশমন। ওরা আমাদের বাধ্য করেছিল আপনাদের সাহায্যে না যেতে। জামানত স্বরূপ এই দশজনকে রেখে গেছে প্রমাণ হিসাবে। আমরা ছিলাম নিরুপায়। আমাদের এ অক্ষমতার জন্য আপনাদের কাছে করুণা ভিক্ষা করছি। আমরা আপনাদের সাহায্যে যেতে না পারলেও আমাদের অন্তরগুলো ছিল আপনাদের সাথে। এভাবে বললে হয়তো আমরা মুসলমানদের রোষানল থেকে বেঁচে যেতে পারবো। আমাদের বিষয়টা ভেবে দেখো।’
‘না, এখানে দেখাদেখির কিছু নেই। তোমার হাতে জামানত হিসেবে আমরা একজনকেও দেবো না। মানুষতো দূরের কথা, একটা ঘোড়াও তোমরা জামানত হিসেবে পাবে না।’
‘তাহলে আমিই বা জামানত হিসেবে তোমাদের হাতে কাউকে কি করে তুলে দেই? তোমরা জামানত না দিলে আমিও দিতে পারবো না, এমন সিদ্ধান্ত আমার গোত্রের লোকেরা মেনে নেবে না।’
‘সেটা তোমার ব্যাপার। তবে নিজের ভালো চাইলে কাল তোমার ওপর দেয়া দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করবে, নইলে পরে পস্তাতে হবে তোমাকে।’
আকরামা রাগ করে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। কাব বিন আসাদ বললো, ‘আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? আরে যাও, যাও। তোমাদের মুরোদ আমার জানা আছে। আমার তো মনে হয় তোমরা মুসলমানের চুলও স্পর্শ করতে পারবে না।’ কাব গলা নামিয়ে বললো, ‘হুকুম যদি মানতে হয় তবে মুহাম্মদের হুকুম মানাই ভালো। তারা ওয়াদার খেলাফ করে না। আমরা যেমন তাদের ওপর সন্তুষ্ট তেমনি তারাও আমাদের ওপর সন্তুষ্ট।’
আকরামা রাগে গজরাতে গজরাতে কাব বিন আসাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সফল হলো নঈমের চেষ্টা। বনু কোরায়জা ও কুরাইশদের মধ্যে দেখা দিলো ফাটল। অবিশ্বাসের দেয়াল তাদের ঐক্য বিনষ্ট করে দিলো। ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম লিখেছেন, নঈমের এ চেষ্টা সফল না হলে মুসলমানরা মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যেতো। কুরাইশরা সাহসী হয়ে অবরোধ আরও দীর্ঘ করলে খাদ্যসঙ্কটে পড়ে মদিনাবাসী নাস্তানাবুদ হয়ে যেতো।

আকরামা কাব বিন আসাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর নঈম বিন মাসউদ গেল গাতফান গোত্রের কাছে। গাতফানের সরদারকে বললো, ‘শুনেছেন, বনু কোরায়জা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আগামী কালের আক্রমণের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিল আকরামা। কাব বিন আসাদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। আগের চুক্তি বাতিল করে সে নতুন শর্ত দিয়েছে। সে বলছে, যদি বনু গাতফান ও কুরাইশদের পাঁচজন করে দশজনকে তার কাছে জামানত রাখা হয় তবে সে যুদ্ধে যাবে, নইলে যাবে না।’
গাতফান এ খবরে অবাক হয়ে বললো, ‘তার এত বড় সাহস! কী আছে তার যে সে আমাদের কাছে জামানত চায়?’ গাতফান নিজ গোত্রের সেনাপতিকে ডেকে পাঠাল। নঈমের দিকে ফিরে বললো, ‘আবু সুফিয়ান শুনেছে এ খবর?’
নঈম মাথা নেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ।’
‘এ খবর শুনে আবু সুফিয়ান কি বললো?’
‘আবু সুফিয়ান বনু কোরায়জাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে চায়। বলেছে, কাব বিন আসাদকে আমি ঘোড়ার পেছনে বেঁধে মক্কা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবো।’
গাতফান বললো, ‘কাবকে শাস্তি দেয়াই উচিত।’
সেনাপতি আয়নাল এলে গাতফান তাকে বললো, ‘শুনেছো, কাব আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। সে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নতুন শর্ত আরোপ করে বলেছে, আমাদের পাঁচজনকে তার কাছে জামানত রাখতে হবে।’
সেনাপতি আয়নাল বললো, ‘আমি আগেই বলেছিলাম ওকে বিশ্বাস করবেন না। ইহুদিরা লড়াইয়ের ময়দানে যুদ্ধ করতে জানে না, ওরা জানে ষড়যন্ত্র। কোন ষড়যন্ত্রকারীকে আমি পছন্দ করি না। জামানত? খোদার কসম, ওকে আমি একটা মেষও দেবো না।’
গাতফান বললো, ‘কোন সাহসে সে আমাদের কাছে জামানত দাবি করে?’
আয়নাল হাসলো, বললো, ‘এটা সাহসের বিষয় নয়, ভিতুর পালাবার কৌশল। ওকে নিয়ে ভাববেন না, দেখবেন সে আমাদের ও মুসলমানদের মাঝে পড়ে পিষে মারা গেছে।’
গাতফানদের উসকে দিয়ে নঈম সেখান থেকে সরে পড়লো।

খালেদের ঘোড়া এগিয়ে যাচ্ছে মদিনার দিকে। তার মনের পর্দায় ভাসছে যুদ্ধদিনের স্মৃতি। বদরের পর ওহোদ, ওহোদের পর খন্দক। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। বদর ওহোদে খালিদ দেখেছে মুসলমানদের সাহস ও বলিষ্ঠতা, আর খন্দকে দেখলো মুসলমানদের অসাধারণ রণনীতি ও অপূর্ব রণকৌশল। মদিনায় ফিরে যাওয়ার বেদনাময় স্মৃতি খালেদের মনে পড়লো।
বনু কোরায়জার ওখান থেকে আকরামা ফিরে এলো। আকরামার ফিরে আসার খবর পেয়েই খালেদ ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। রাগে, ক্ষোভে, ক্লান্তিতে আকরামার চেহারা ছিল বিধ্বস্ত। আবু সুফিয়ানসহ সবাই তাকে ঘিরে ধরেছিল। আবু সুফিয়ান, খালেদ ও অন্যান্য সবাই উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খবর নিয়ে এলে আকরামা?’
আকরামা ক্লান্ত পায়ে নামল ঘোড়া থেকে। খালেদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বিশ্বাস করো, কাবের মত বদলোক আর দ্বিতীয়টি দেখিনি আমি।’ একটু বিরতি নিয়ে আকরামা আবু সুফিয়ানকে বললো, ‘আমার ইচ্ছে করছিল, তাকে খুন করে ফেলি। কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করেছি আমি।’
‘সে কি জামানত হিসেবে কয়েকজনকে আমাদের হাতে সোপর্দ করতে অস্বীকার করেছে?’ জানতে চাইল আবু সুফিয়ান।
‘না, তবে বিনিময়ে আমাদের ও গাতফান গোত্রের কিছু লোককে নিজের জিম্মায় রাখার শর্ত জুড়ে দেয়।’
খালেদ বিস্মিত কণ্ঠে বলে, ‘তুমি কি তাকে কিছুই বলোনি? এতটা সাহস সে পায় কি করে? কোরাইশ গোত্রের তুলনায় বনু কোরায়জা তো হাতির পাশে ইঁদুর।’
আকরামা বললো, ‘তুমি ভাবতেও পারবে না ও কতটা খারাপ। সে আমাকে দেখেই এক সুন্দরীকে ডাকলো। তাকে দিয়ে মদ আনিয়ে পরিবেশন করলো আমার সামনে। তারপর এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলো, যেন আমি তার করুণা ভিখারি।’
‘তুমি তাকে শেষ কথা কি বলে এসেছো?’ জানতে চাইল আবু সুফিয়ান।
‘আমাদের সাথে যে চুক্তি ছিল আমি তা ছিন্ন করে এসেছি। শুধু এতটুকু বলেছি, তুমি যা করলে এর পরিণতি ভালো হবে না।’ আবু সুফিয়ানের দিকে ফিরে বললো, ‘নেহাত একটা যুদ্ধে আছি, তাই বেশি কিছু বললাম না।’
‘তুমি ঠিক কাজ করেছো।’ আবু সুফিয়ান বললো, ‘দু’মুখো সাপের সাথে চুক্তি বাতিল করা, চুক্তি বজায় রাখার চাইতে উত্তম। এখন আর ওদের ছোবল খাওয়ার ভয় রইলো না।’
খালেদ চিন্তিত মনে বলেছিল, ‘কিন্তু রণকৌশলের দিক দিয়ে মুসলমানরা সুবিধা পেয়ে গেল। যুদ্ধের সময় কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। দৈহিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে কারো না কারো সমর্থক সে হয়েই যায়। আমাদের দিক থেকে সমর্থন তুলে নিলে সেই সমর্থন চলে যাবে মুসলমানদের পক্ষে। সামনে মূল শত্রু থাকলে পাশে থাকবে শত্রুর লেজ।’
আজকে মদিনার দিকে যেতে যেতে খালেদের সে কথা মনে পড়ায় অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সেদিনের সে কথা কতই না সত্য ছিল। মাত্র তো দু’বছর আগের কথা। সবই স্পষ্ট মনে আছে তার। খালেদের কথা শুনে আকরামার চেহারায়ও চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। আকরামা দেখছিল, সেনাপতি আবু সুফিয়ানের চেহারাও বিমর্ষতায় ছেয়ে আছে।
এক সময় লোকজনের ভিড় কমে এলো। আকরামা ও খালিদ বেরিয়ে এলো তাঁবু থেকে। আকরামা খালিদকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি চিন্তা করছো খালিদ?’
খালিদ বললো, ‘আমার চিন্তার সাথে সেনাপতি আবু সুফিয়ানের চিন্তা কখনই মিলে না। আমি পুরো খন্দক ঘুরে দেখেছি। এক জায়গায় খন্দক খানিকটা চাপা, গভীরতাও তেমন বেশি নয়। আমি সেনাপতি হলে এ বিপুল সৈন্য এভাবে বসিয়ে রাখতাম না। হয়তো খন্দক পার হতে গিয়ে আমাদের ক্ষতি কিছুটা বেশি হতো, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলে পার হওয়া যাবে না এমন নয়। কিছু সৈন্য নিহত হওয়ার পরও যে পরিমাণ সৈন্য নিয়ে আমরা ওপারে উঠতাম তার মোকাবেলা করা মুসলমানদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে আমাদেরই জয় হতো। কিন্তু আবু সুফিয়ান এতই ভিতু যে, সে সেনাপতি হবে কিন্তু বিপদের বোঝা মাথায় নেবে না। এ রকম সেনাপতি নিয়ে কি যুদ্ধে জেতা যায়?’
‘ঠিক বলেছো খালিদ, আবু সুফিয়ানকে এ জন্যই মান্য করি যে সে আমাদের গোত্রপ্রধান ও সরদার। কিন্তু তার মত ভিতু ও কাপুরুষ কোন গোত্রের সেনাপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। আমিও তোমার সাথে একমত, হামলায় প্রথম দিকে আমাদের ক্ষতি একটু বেশি হলেও খন্দক পার হওয়া অসম্ভব নয়। এত বড় বিশাল বাহিনী এভাবে বসিয়ে রাখলে তাদের মনোবল ক্রমেই কমে আসবে। দিন যতো যাচ্ছে ততোই আমরা দুর্বল হচ্ছি। কিন্তু যতদূর বুঝতে পারছি, আবু সুফিয়ান মদিনায় হামলা না করেই ফিরে যেতে চাচ্ছে।’
খালিদ বললো, ‘আকরামা, আমার একবার ভাগ্য পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি যে জায়গার কথা বলছি ওখান দিয়ে অশ্বারোহী পার করা সম্ভব। তুমি রাজি থাকলে আমরা একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। এপারে তীরন্দাজ থাকবে। ওরা অতর্কিতে তীরবৃষ্টি শুরু করলে মুসলমানরা ক্ষণিকের জন্য হলেও পিছু হটতে বাধ্য হবে। সেই সুযোগে অশ্বারোহীর দলকে আমরা ওপারে পাঠিয়ে দেবো। ওরা যুদ্ধ করবে জয়ের জন্য নয়, ওদের লড়াইয়ের মূল টার্গেট থাকবে আমাদের সৈন্যরা যাতে খন্দক পার হতে পারে।’
‘তুমি ভালো করে ভেবে দেখো। রাতভর চিন্তা করে ঠিক করো কী করবে। তুমি হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলে আমি থাকবো তোমার সাথে।’ বললো আকরামা।

পরদিন ভোর। পূর্ব দিগন্তে উঠে এসেছে রক্তিম সূর্য। সেই সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে মদিনা শহরে। ছড়িয়ে পড়েছে শহরের পাশের খোলা প্রান্তরে, যেখানে তাঁবু গেড়ে মদিনা শহরকে অবরোধ করে রেখেছিল কুরাইশরা। খালিদ আকরামাকে বললো, ‘আবু সুফিয়ান অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার জন্য উদগ্রীব হলেও আমি মদিনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি রাজি থাকলে চলো, এখনি আমি মদিনা আক্রমণ করতে চাচ্ছি।’
আকরামা বললো, ‘তোমার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে মল্লযুদ্ধ শুরু করতে হবে। এ জন্য সব সৈন্য ওপারে নেয়ার দরকার নেই। মল্লযুদ্ধ করতে পারে এমন কিছু অশ্বারোহী বাছাই করে তাদের নিয়ে আগে আমি ওপারে যেতে চাই।’
খালিদ বললো, ‘তুমি এপারেই থাকো, আগে আমি যাই।’
‘না।’ আকরামা বললো, ‘আগে আমি যাবো।’
ওরা সুঠামদেহী সাতজন অশ্বারোহী বাছাই করলো। তাদের একজন উমরু বিন আবদুহু। দৈত্যের মতো বিশাল শরীর তার। যেমন তার শরীর তেমনি সাহস। একাই একশজনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতেও ভয় পায় না সে। তাঁবুর সামনে সারি বেঁধে দাঁড়াল ওরা। কোরাইশ সৈন্যরা তাকিয়ে দেখলো ওদের। আকরামা ওদের বুঝিয়ে বললো কি করতে হবে। তারপর খালিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লাফিয়ে চড়লো ঘোড়ার পিঠে। আকরামা ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষলো। ঘোড়া আকরামাকে নিয়ে ছুটলো সামনের দিকে। ঘোড়ার মুখ খন্দকের দিকে। তার পেছনে সাত অশ্বারোহী। তারাও ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। বাতাসের বেগে উড়ে চললো ঘোড়া। তাদের পিছু নিলো একদল তীরন্দাজ। ঘোড়া নয়, তারা যাচ্ছে পায়ে হেঁটে। সবার আগে আকরামার ঘোড়া।
জোবার পাহাড়ের পশ্চিমে ও সালেহ পাহাড়ের পূর্ব পাশে খন্দক সামান্য চাপা। স্থানটি আগেই দেখেছে খালিদ ও আকরামা। চেষ্টা করলে এখানকার খন্দক লাফিয়ে পার হওয়া সম্ভব, এমনটাই ধারণা খালিদ ও আকরামার। সমস্যা হচ্ছে, খন্দকের ওপারেই মুসলমানদের ক্যাম্প। মুসলমানদের সামনে পড়লে ওরা তাদের কচুকাটা করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ছাড়া খন্দক পার হওয়ার সুবিধাজনক জায়গা আর নেই। আকরামার ঘোড়া সেদিকেই ছুটছে। খন্দক যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।
উমরু বলেছিল, ‘আকরামা, আগে আমি যাই, তুমি আমার পেছনে এসো।’ কিন্তু আকরামা তাতে রাজি হয়নি। বলেছে, ‘দলনেতা হিসেবে আমারই আগে থাকার কথা, আমি তাই করবো। এরপর থাকবে তোমার ঘোড়া, তারপর অন্যদের।’
সেভাবেই এগিয়ে গেল দলটি।
ওরা খন্দকের কাছে চলে এসেছে। আকরামা জোরে ঘোড়ার পাছায় চাবুক মারলো। ঘোড়া যেন শূন্যে ভেসে চলেছে। নিরাপদ দূরত্ব রেখে এগিয়ে আসছে বাকি ছয়জন। খন্দকের কিনারায় এসে আকরামা সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত হানলো ঘোড়ার পিঠে। দুরন্ত অশ্ব লাফ দিলো খন্দক পার হওয়ার জন্য। তার সামনের পা পার হয়ে গেল খন্দক, কিন্তু পেছনের পা খন্দকের কিনারায় পড়ে পিছলে গেল। আকরামা ছিটকে পড়লো ঘোড়া থেকে। কিন্তু মুহূর্তেই তলোয়ার হাতে উঠে দাঁড়াল সে। পেছন থেকে উমরু বিন আবদুহু চিৎকার করে উঠলো, ‘সরে যাও আকরামা, আমি লাফ দিচ্ছি।’ কেউ ভাবেনি বিশালদেহী উমরুকে নিয়ে ঘোড়া খন্দক পেরোতে পারবে, কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখলো, উমরুর ঘোড়া খন্দক পার হয়ে ওপারে গিয়ে পৌঁছেছে। একে একে সাতটি ঘোড়ার পাঁচটিই অক্ষত অবস্থায় ওপারে পৌঁছলো, একটি পার হতে গিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল আর একটির পা ভেঙে গেল। অবশ্য এ দুই ঘোড়ার আরোহী অক্ষত ছিল, তারা ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়েছিল।
মুজাহিদদের অধিকাংশই তখন সেনাক্যাম্পে। টহল বাহিনী অবশ্য টহল দিচ্ছিল। তারা দূর থেকে দেখলো এ অবিশ্বাস্য ঘটনা। তারা চিৎকার করে উঠলো, ‘কাফেররা খন্দক পার হচ্ছে। হুঁশিয়ার মুজাহিদ, হুঁশিয়ার।’ তাদের ডাক-চিৎকারে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে এলো মুসলমানরা। তারাও দেখলো এ অবিশ্বাস্য ঘটনা। হাতিয়ার নিয়ে তারা ধাবিত হলো খন্দকের দিকে। আকরামা চিৎকার করে বললো, ‘খবরদার, কেউ খন্দকের কাছে আসবে না। মুহাম্মদকে বলো আকরামা এসেছে। কারো যদি সাহস থাকে আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করো। এগিয়ে আসো মল্লযুদ্ধের জন্য। আমাদের যে কোন একজনকে হত্যা করতে পারলে বাকি ছয়জনকেও হত্যা করতে পারবে তোমরা। সবার আগে মুহাম্মদকে খবর দাও। আমি দেখতে চাই তিনি কোন বীরকে আগে আমাদের মোকাবেলায় পাঠান।’
নিরাপদ দূরত্বে থমকে দাঁড়িয়ে গেল মুসলমানরা। প্রিয় নবীর কানে পৌঁছে দেয়া হলো আকরামার বার্তা। হজরত আলী রা.কে নিয়ে সেখানে এলেন মহানবী সা:। তাকিয়ে দেখলেন অসম সাহসী আকরামা দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার ছয় সঙ্গী। আকরামা আবারও মল্লযুদ্ধের আহবান জানালো। বললো, ‘তোমাদের রক্ত পান করার জন্য মদিনার বালুকারাশি তৃষ্ণাকাতর হয়ে পড়েছে। কে আছো সেই তৃষ্ণা নিবারণ করবে, এগিয়ে এসো।’
আকরামার বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিমা দেখলেন মহানবী। দেখলো মরুর বাতাস, উদার আকাশ আর জ্বলজ্বলে সূর্য। দূর থেকে দেখলো আবু সুফিয়ান ও কাফের সৈন্যরা। এ ঘটনার সাক্ষী রইলো মদিনার সুরক্ষা প্রাচীর ও অনাগত কালের ইতিহাস। মহানবী নিজের মাথার পাগড়ি খুলে সেটা হজরত আলীর রা: মাথায় পরিয়ে দিলেন। তার হাতে তুলে দিলেন সেই বিখ্যাত তলোয়ার ‘জুলফিকার’।
আকরামার বদলে ভেসে এলো সেই দৈত্যাকার পুরুষ উমরুর কণ্ঠস্বর, ‘কে আছো বাহাদুর, এগিয়ে এসো। তোমার রক্ত যতক্ষণ শুষে না নিচ্ছে এই শুকনো বালুকারাশি, ততক্ষণ আমরা ফিরে যাবো না।’ উমরুর কণ্ঠে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের সুর, ‘আমার মোকাবেলা করবে তোমাদের মাঝে এমন কাউকে তো দেখছি না। হোবল ও ওজ্জার কসম, রক্ত পান না করে আমরা ফিরে যাবো না।’
উমরু আসলেই প্রচন্ড শক্তিশালী ছিল। সে তার ঘোড়াকে নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারতো। কেউ তার মোকাবেলা করবে এটা সে ভাবতেই পারতো না। মহানবী তার হুঙ্কার শুনছিলেন আর মনে মনে বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, এই দৈত্যের বিরুদ্ধে আলীকে পাঠালাম। তুমি তার মোহাফেজ ও সাহায্যকারী হয়ে যাও।’
হজরত আলী রা: মহানবী সা:-এর দোয়া নিয়ে উমরুর মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে গেল। তাঁর হাতে জুলফিকার। ঐতিহাসিকরা বলেন, এই তলোয়ারের মূল মালিক ছিল এক কোরাইশ যোদ্ধা। তলোয়ারটির বিশেষত্ব হচ্ছে, তলোয়ারের ধার থাকে এক পাশে, কিন্তু এর দু’পাশই সমান ধারালো। হজরত আলী রা:কে এগিয়ে আসতে দেখে উমরু বিন আবদুহু ঘোড়া থেকে নেমে এলো। কাছাকাছি এলে বললো, ‘হে আবু তালেবের বেটা, তুমি কি ভুলে গেছো তোমার বাবা আমার কত বড় বন্ধু ছিল। এটা খুবই অন্যায় হবে যে, আমি আমার একান্ত প্রিয় বন্ধুর ছেলেকে হত্যা করি। তুমি ফিরে যাও, তোমার বদলে আমার মোকাবেলার জন্য অন্য কাউকে পাঠাও।’
‘হে আমার বাপের বন্ধু! আমি ইসলাম গ্রহণের পর অতীতের সব সম্পর্কই শেষ হয়ে গেছে। তোমার অনুশোচনার কিছু নেই। তুমি নির্দ্বিধায় আমার মোকাবেলা করতে পারো।’ হজরত আলী রা. বললেন, ‘হয় তুমি আমাকে হত্যা করবে, নয়তো আমি তোমাকে হত্যা করবো। ময়দানে নেমে বাহানা তালাশের চেষ্টা বাদ দাও। তবে তোমাকে হত্যা করার আগে আমি তোমাকে দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছি। আমাদের সবার ¯্রষ্টা এক আল্লাহকে নিজের মালিক ও মুনীব বলে মেনে নাও। তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সা:কে নিজের নেতা বলে স্বীকার করো আর নিজের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামকে নিজের জীবনবিধান বলে মেনে নাও। কেবল তাহলেই তুমি আমার হাত থেকে বেঁচে যেতে পারবে, আর না হয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। এখনও সময় আছে, ভেবে দেখো। আমি দ্বিতীয়বার তোমাকে এ কথা বলবো না এবং নিজেকে বাঁচানোর আর কোন মওকা তুমি পাবে না।’
‘হে আবু তালেবের বেটা, তুমি একবার আমাদের ধর্ম ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছো আর আমি হাজারবার তোমাকে বলতে চাই, তুমি আমার বন্ধুর সন্তান। আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না। তুমি ফিরে যাও।’
‘না, ফিরে যাওয়ার জন্য আমি তোমার সামনে আসিনি। হয় আল্লাহর দ্বীনকে মেনে নাও নাহলে নিজেকে বাঁচাও রাসূলের দেয়া তলোয়ার থেকে।’ হজরত আলী রা: বললেন, ‘আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করো না।’
উমরু বিন আবদুহু অবাক হয়ে দেখছিল হজরত আলী রা:-এর দৃঢ়তা ও নির্ভীকতা। সে নিতান্ত তাচ্ছিল্য সহকারে খাপ থেকে তলোয়ার বের করে এগিয়ে এসে আঘাত করলো হজরত আলী রা:কে। আলী রা: চকিতে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করলো। উমরু এভাবে আরও কয়েকটা আঘাত করলো, কিন্তু প্রতিবারই আলী রা: জায়গা বদল করে ঠেকিয়ে দিল সে আঘাত। উমরুর চেহারা এবার রাগে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। সে ভয়ঙ্কর চেহারার বর্ণনা দেয়ার সাধ্য কারও নেই। চোখ থেকে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছিল আগুন। রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল উমরু। সেই রাগ সে ঢেলে দিল হজরত আলী রা:-এর ওপর। পাগলের মত এলোপাতাড়ি আঘাত করে চললো ক্রমাগত। ঘামে সারা শরীর ভিজে গেল তার। এ পর্যন্ত আলী রা.একটি আঘাতও করেননি। তিনি ক্ষিপ্রগতিতে জায়গা বদল করে ক্রমাগত আঘাতের পর আঘাত ঠেকিয়ে যাচ্ছিলেন। এভাবে দীর্ঘক্ষণ লড়াই চললো। উৎসুক জনতা রুদ্ধশ্বাসে দেখছিল সে লড়াই। মুসলমানরা একদম চুপ। এক দৈত্যের সাথে লড়ছেন আলী রা:। যেভাবে উমরু আঘাতের পর আঘাত করছে কতক্ষণ তাকে সামাল দিতে পারবেন আলী রা:? দুশ্চিন্তায় গলা পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছিল মুসলমানদের। উমরুর প্রতিটি আঘাতের সময়ই ভাবছিল, এই বুঝি সব শেষ। অপর দিকে খন্দকের ওপারে এসে জমা হয়েছিল কাফেররা। তারা উল্লাস করছিল। চিৎকার করে বলছিল, ‘হোবল ও ওজ্জার দোহাই, উমরু, শেষ করে দাও এ ধর্মত্যাগীকে।’
দীর্ঘক্ষণ লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে গেল উমরু। সে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিতে গেল, আলী রা:কে ল্যাঙ মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। মাটিতে ফেলে দিয়েই উমরুর বুকের ওপর চেপে বসলেন আলী রা:। চেপে ধরলেন উমরুর কণ্ঠনালী। ঘটনাটা এত আকস্মিক ছিল যে, উমরু কিছু বুঝে উঠার আগেই ধরাশায়ী হয়ে গেল। আলী রা: তলোয়ার ফেলে কোমর থেকে খঞ্জর বের করলেন। সেই খঞ্জর উমরুর গলায় চেপে ধরে বললেন, ‘এখনও সময় আছে উমরু, মুহাম্মদের শিষ্যত্ব মেনে নাও, প্রাণে বেঁচে যাবে।’
(চলবে)
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ