দুর্ভাগা হিরোশিমা-নাগাসাকি

দুর্ভাগা হিরোশিমা-নাগাসাকি

বিশেষ রচনা আগস্ট ২০১০

মীর আমজাদ আলী

তোমরা বোধ হয় হিরোশিমা-নাগাসাকির নাম কম-বেশি শুনে থাকবে। আবার কেউ কেউ হয়ত এ নাম শোনেইনি। আর শুনলেও কেন এবং কী জন্য এ দুটো নাম মনে রাখার মতো তা বিশ্বের ইতিহাস-ভূগোল অন্যান্য ‘বিশ্ব দিবস’ পালনের পাশাপাশি এ দিনটিকেও পালনের জন্য তাগিদ দেয়। দিনটি হলো ৬ আগস্ট। এ দিনে জাপানে যে ঘটনা ঘটেছিল ইতঃপূর্বে বিশ্বে তেমন নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেনি। সেই নিষ্ঠুর, ভয়ঙ্কর ও লোমহর্ষক ঘটনা তোমাদেরকে এখন বলব। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা বিস্তার আর প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে শত্রু ও মিত্র পক্ষ। যে দেশ এ যুদ্ধে জড়িত ছিলো না তাকেও আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। এই সময়ে কে কার বন্ধু, কে কতটুকু বিরোধিতা করেছে, কার শক্তি কত বড়, কে কোন নীতিতে বিশ্বাসী সব পরিচয় পাওয়া গেল। যৌথ যুদ্ধই চলছিল প্রায় সবখানে বৃহৎ শক্তির নেতৃত্বে। বিজ্ঞান তখনও এখনকার মতো এত আধুনিকতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। কিন্তু নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর মনে মনে মহাশক্তি অর্জন করার একটা উন্মাদনা দানা বেঁধে উঠেছিল তখন থেকেই। বিশ্বের দিকে দিকে বিজ্ঞানের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল বৃহৎ শক্তিগুলি। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পর্যটকরা ভৌগোলিক আবিষ্কারে অজানার উদ্দেশ্যে দুর্বার যাত্রা শুরু করেছিলেন। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শিল্প ও শক্তির সন্ধানে উঠে পড়ে লাগল বিজ্ঞানী মহল। নব নব আবিষ্কারে বিশ্ব স্তম্ভিত। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আবিষ্কার হলো মারণাস্ত্র। মহাশক্তিগুলো যে যা আবিষ্কার করল তা চুপিসারে মজুদ রাখল ভবিষ্যতের আশায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একে একে ২০টি বছর কালের গর্ভে অতীত হলো। বিশ্ব আবার সদম্ভ শক্তির আস্ফালনে কম্পমান। অগ্রসরমান বিজ্ঞান রচনা করল সন্ত্রাস। যুদ্ধের মহাকাশে দেখা দিল ঘনঘটা। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে প্রাপ্ত ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব নেতৃত্বের কষাকষি ডাক দিল আরেক মহাসমরের। শক্তিধর দেশগুলোর নেতৃত্বে একে অপরের পক্ষ নিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ওই সময় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকা এবং জাপান, জার্মান ও ইতালিই বিশেষ ভূমিকা পরিগ্রহ করে। ১৯৩৭ সাল। জাপান তখনকার এক নেতৃস্থানীয় দেশ। শৈল্পিক, অর্থনৈতিক ও সমর শক্তির দিক দিয়ে প্রথম সারিতে স্থান পাওয়ার দাবি রাখে। ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব নিয়ে চীনের সাথে তার বিরোধ। বিরোধ এমনই যে পরিণামে তুমুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। বেমালুম চীনকে হটিয়ে মাঞ্চুরিয়া দখল করল জাপান। এবার ধাপে ধাপে ধ্বংস ঘটাতে ঘটাতে এগিয়ে চলল পিকিংয়ের উপকণ্ঠে। নিষ্ঠুর পৃথিবীর নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল। বিশ্বের শক্তিধর নেতা চার্চিল। চার্চিল কথা বলে না, হিটলার পদক্ষেপ নেয় না, পরাক্রমশালী মুসলিনী ফ্যাসিস্ট নীতির খেল দেখাতে ব্যস্ত। আমেরিকার জাপানবিরোধী নীতিতে অনেকেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল। জেনেভার লিগ অব নেশনস বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হলো। কয়েকবারই অস্ত্র সংবরণ চুক্তি শিকেয় উঠল। সাম্রাজ্যবাদ নীতিকেই কেন্দ্র করে গোটা বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো উঠে পড়ে লাগল। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের প্রতিযোগিতা চলল অব্যাহত গতিতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। ১৯৪৫ সাল। ইতোমধ্যে আমেরিকা যথেষ্ট শক্তিধর হয়ে উঠেছে। বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক ভারসাম্য যখন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন তখনই কয়েকটি দেশের অবস্থানে আমেরিকা সর্বশেষ ভূমিকা পালন করবে আশ্বাস দিল। গভীর রাত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভবন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সাথে বেশ কয়েকজন উচ্চ স্তরের সহচর এসে বসলেন এক রুদ্ধদ্বার কক্ষে। সব ঠিক। হয় এসপার না হয় ওসপার। সমৃদ্ধি আর সৌন্দর্যের শহর জাপান। পৃথিবীর সূর্যোদয়ের দেশ। টোকিও, সিকোকু, ওয়াসাকা কর্মব্যস্ত প্রশান্ত মহাসগরীয় বন্দর। রাজধানী টোকিও থেকে চার শ’ মাইলের ওপর হবে সুন্দর ছবির মত শহর হিরোশিমা। আর ছয় শ’ মাইলের ওপর হবে রূপসী বন্দর নাগাসাকি। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, সকাল ৭টা ৩০ মিনিট। সুসুপ্তিময় নগরী হিরোশমা হঠাৎ এক বিকট আওয়াজে নড়ে উঠল। এক বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়া তখন আকাশে বাতাসে মিশে বিষাক্ত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। শিশু-যুব-বৃদ্ধ সকলেই দিশেহারা হয়ে যে দিকে পারল ছুটল। কিন্তু যাবে কোথায়? নিমেষের মধ্যে কারো চোখ অন্ধ হয়ে গেল, কারো দেহের মাংস খসে পড়ছে, কেউ আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। দেখতে দেখতে শহরময় মৃতের পাহাড় গড়ে উঠল। যেন কোন অজানা পাপের ফল নাটকীয় অভিশাপ নিপতিত হয়েছে এদের ওপর। কী হলো, কোথায় হলো, কে করল এসব প্রশ্ন করবার অবকাশ নেই কারো। ৯ আগস্ট অনুরূপ অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটল নাগাসাকিতে। বিস্ফোরণ মুহূর্তে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অনুপম এই শহরও বিরানভূমিতে পরিণত হলো আর কয়েক মাইল মাটির নিচে তলিয়ে গেল। সেই থেকে বহুকাল পর্যন্ত ঐ শহরদ্বয়ের পানি, ফল, ফসল থেকে বিষক্রিয়া কাটেনি এবং মানব সন্তানগুলো বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিতে লাগল। একজন ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক বোমারু বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত করেছিলেন ২০,০০০ টিএনটি ওজনের এক মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক বোমা অ্যাটম। বৈমানিক ক্লড ইথারলি এটা নিক্ষেপ করলেন বটে কিন্তু বিস্ফোরণ প্রতিক্রিয়ার মর্মান্তিক অবস্থা স্বচক্ষে দেখে তাঁর নিজের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছিল। বিস্ফোরণের ফলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৬,৮৫০ এবং ৩৯ সহস্রাধিক আহত হয়। এক একটি মৃত্যুর করুণ চিত্র ইথারলিকে ভারসাম্যহীন করে ফেলে। কালক্রমে ইথারলি চুরি, ডাকাতি, হত্যা ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়েন এবং তিনি এই সকরুণ মৃত্যু বিভীষিকার রূপ দান করেন তাঁর লিখিত অনেকগুলো চিঠিতে। বন্ধু গ্যান্থার এনডোর্সের জবাবসহ এগুলো একটি লোমহর্ষক পত্র সাহিত্যে পরিণত হয় পরবর্তীকালে। এই বইটির নাম দেয়া হয় ‘বার্নিং কনসেন্স’ অর্থাৎ বিবেকের দংশন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ