দ্য ফাইভ হান্ড্রেড ক্লাব আবু আবদুল্লাহ

দ্য ফাইভ হান্ড্রেড ক্লাব আবু আবদুল্লাহ

খেলার চমক অক্টোবর ২০২০

একশ... দুইশ... তিনশ... চারশ... পাঁচশ। যে কোন অর্জন বা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংখ্যাটি বড়। কারণ কয়েকটি শতকের ধাপ পার হয়ে পৌঁছতে হয় পাঁচশতে। বিশেষ করে খেলাধুলার ক্ষেত্রে পাঁচশ একটি মাইলফলক হিসেবেই বিবেচিত হয়। কোন ফুটবলার যখন তার ক্যারিয়ারে পাঁচশতম গোলটি পান কিংবা কোন টেনিস খেলোয়াড় যদি তার ক্যারিয়ারের পাঁচশতম জয় পান- ধরেই নিতে হবে তিনি শুধু তারকাই নন, রীতিমতো মহাতারকা। কারণ এই মাইলফলক স্পর্শ করতে পারেন শুধুমাত্র সেরারাই। ক্রিকেটে একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে একজন বোলারের পাঁচশ উইকেট প্রাপ্তির বিষয়টি এর চেয়েও বড়। কারণ এই অর্জন ক্রিকেটের দীর্ঘ ইতিহাসে করতে পেরেছেন হাতে গোনা কয়েকজন। আর আমাদের এবারের লেখার বিষয় সেই সব কিংবদন্তি বোলারকে নিয়েই।
সবার আগে ওয়ালশ

ক্রিকেটের একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে একজন বোলারের পক্ষে যে ৫শ উইকেটের মাইলফলকে পেঁৗঁছা সম্ভব সেটি সবার আগে প্রমাণ করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি পেসার কোর্টনি ওয়ালশ। এক সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিলো পেস বোলারদের স্বর্গ। সারা বিশ্বের ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরানো বাঘা বাঘা বোলার ছিলো ক্যারিবীয়দের দলে। ম্যালকম মার্শাল, কার্টলি অ্যামব্রস, জোয়েল গার্নারদের মোকাবেলা করতে অনেক ব্যাটসম্যানেরই বুক কাঁপতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই সোনালি প্রজন্মের শেষ মহাতারকা কোর্টনি ওয়ালশ।
জ্যামাইকার কিংসটনে জন্ম নেয়া এই ফার্স্ট বোলারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ১৯৮৪ সালে। ২০০১ সালের ১৭ মার্চ পোর্ট অব স্পেনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেটি ছিল সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রোটিয়া অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিসের উইকেট নিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতেন ওয়ালশ। ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম কোন বোলারের ৫ শ’ উইকেট নেয়ার ঘটনা সেটি। অবশ্য মাইলফলকে পৌঁছার আনন্দটা খুব বেশি উপভোগ করতে পারেননি এই ক্যারিবীয় গ্রেট। কারণ তার দল ম্যাচটি হেরেছিল ৬৯ রানে। তবে সেই ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন ওয়ালশ। প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট নেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট; কিন্তু প্রথম ইনিংসে লিড নেয়ার পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটি হেরেছিল ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়। ২৩২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে তারা অলআউট হয় ১৬২ রানে।
ম্যাচটি ছিলো ওয়ালশের ক্যারিয়ারের ১২৯তম টেস্ট ম্যাচ। ওই সিরিজটিই ছিলো তার ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজ। কয়েকদিন পর নিজের শহর কিংসটনে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলেন ওয়ালশ। সব মিলে ১৩২ টেস্ট খেলে ৫১৯ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন ওয়ালশ। পাশাপাশি ২০৫ ওয়ানডেতে তার উইকেট সংখ্যা ২২৭।

একই সিরিজে ওয়ার্ন-মুরালিধরন

কোর্টনি ওয়ালশ সবার আগে ৫ শ’ উইকেটে পৌঁছলেও এই তালিকার সবার আগে আসলে রাখা উচিত শ্রীলঙ্কার সাবেক অফস্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের নাম। কারণ টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে মোট ৮ জন বোলার ৫ শ’ উইকেট নিয়েছেন। তবে মুরালিধরন একমাত্র বোলার যিনি দুই ফরম্যটেই এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। আবার উভয় ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি উইকেটও নিয়েছেন তিনি। ১৩৩ টেস্টে ৮০০ উইকেট তার, আর ৩৫০ ওয়ানডেতে ৫৩৪টি। এ ছাড়া দ্রুততম বা সবচেয়ে কম ম্যাচে ৫০০ উইকেট স্পর্শ করার রেকর্ডও তার দখলে।
২০০৪ সালের ১৬ মার্চ শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫০০ টেস্ট উইকেটের রেকর্ড স্পর্শ করেন মুরালিধরন। সেটি ছিলো তার ক্যারিয়ারের ৮৭তম টেস্ট। অর্থাৎ প্রথম এই কীর্তি গড়া ওয়ালশের চেয়ে ৪২টি টেস্ট কম খেলেই এই কীর্তি গড়েন মুরালিধরন। প্রথম ইনিংসে অজি বোলার মাইকেল কাসপ্রোইজকে আউট করে মুরালিধরন দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এক ফরম্যাটে ৫ শ’ উইকেট নেয়ার কীর্তি গড়েন। তবে ওয়ালশের মতো তাকেও এমন স্মরণীয় ম্যাচে পরাজিত দলেই থাকতে হয়। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১২০ রানে অলআউট হয়েও সেই ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া ২৭ রানে জিতেছিল মূলত দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আর ডেমিয়েন মার্টিনের সেঞ্চুরি ও শেন ওয়ার্নের দুর্দান্ত বোলিংয়ে। মুরালিধরন যদিও দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট।
মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই একই সিরিজে আট দিন আগে শুরু হওয়া প্রথম টেস্টে ৫০০ উইকেট স্পর্শ করেছেন অস্ট্রেলীয় লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন। অর্থাৎ একই সিরিজে দু’জন বোলার পরপর দুই টেস্টে এই কীর্তি গড়েছেন। গলেতে সিরিজের প্রথম টেস্টে শেন ওয়ার্ন শ্রীলঙ্কার হাসান তিলকারতেœর উইকেট নিয়ে ৫০০ টেস্ট উইকেট স্পর্শ করেন। তার ক্যারিয়ারের ১০৮তম টেস্ট ম্যাচ ছিলো সেটি। আর ক্যান্ডিতে পরের টেস্টেই মুরালিধরন এই তালিকায় নাম ওঠান। তারিখের হিসেবে তাই তালিকায় ওয়ালশের পর দুই নম্বরে রাখতে হবে ওয়ার্নকেই। ১৪৫ টেস্ট খেলে শেন ওয়ার্ন যখন তার ক্যারিয়ার শেষ করেছেন তখন তার নামের পাশে ছিল ৭০৮টি টেস্ট উইকেট।
ওয়ানডেতে মুরালিধরনের ৫০০ উইকেট নেওয়ার ঘটনাটি এই সিরিজের ৫ বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি। লাহোরে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে ম্যচে পাকিস্তানের সোহেল খানকে বোল্ড করে নিজের নতুন এক কীর্তি গড়ার পাশাপাশি দলের ২৩৪ রানের বিশাল জয় নিশ্চত করেন মুরালিধরন। তার আগেই অবশ্য ওয়াসিম আকরাম ওয়ানডেতে প্রথম বোলার হিসেবে ৫ শ’ উইকেট নিয়েছেন। (সে বিষয়ে বিস্তারিত আছে এই লেখার শেষ দিকে) তবে দুই ফরম্যাটেই এই অনন্য নজির গড়া প্রথম ও আজ পর্যন্ত একমাত্র বোলার হয়ে আছেন মুরালিধরন। মুরালিধরনের এই রেকর্ড সহসা কেউ ভাঙতে পারবে সেই সম্ভাবনাও নেই। কারণ টেস্টে ৫ শ’ উইকেট নিয়েছেন যে কয়জন বোলার তাদের বেশির ভাগেরই ক্যারিয়ার শেষ। যে দু’জন এখনো খেলছেন, তারা আবার ওয়ানডে থেকে অবসর নিয়েছেন। কাজেই মুরালিধরন আরো অনেকদিন এই বিরল রেকর্ডের একক মালিক হয়েই থাকবেন সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

ম্যাকগ্রা-কুম্বলে

ওয়ার্ন-মুরালির পরের বছরই টেস্ট ক্রিকেটের এই অভিজাত ক্লাবে নিজের নাম লেখান অজি পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা। ২০০৫ সালের ২১ জুন লর্ডসে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শুরু হওয়া সেই ম্যাচটি ছিলো তার ক্যারিয়ারের ১১০তম টেস্ট। প্রথম ইনিংসেই ইংলিশ ওপেনার মার্কাস ট্রেসকোথিককে আউট করে ৫০০ উইকেট পূর্ণ করেন ডানহাতি এই পেসার। ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে নয় উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জয়ে নায়ক ছিলেন তিনিই। ১২৪ টেস্ট খেলা ম্যাকগ্রা যখন ক্যারিয়ার শেষ করেন তখন তার নামের পাশে ৫৬৩ উইকেট। পাশাপাশি ২৫০ ওয়ানডেতে ৩৮১ উইকেট।
বরাবরই বোলিংয়ের চেয়ে ভারতীয় দলের ব্যাটিংয়ের শক্তি ছিলো বেশি। দলটি থেকে তাই খুব বেশি বিখ্যাত বোলার উঠে আসেনি। তবে ভারতীয় লেগ স্পিনার অনীল কুম্বলে ঠিকই নিজেকে নিয়ে গেছেন টেস্ট বোলিংয়ের অভিজাত এই ক্লাবে। ২০০৬ সালের ৯ মার্চ মোহালিতে শুরু হওয়া টেস্টে ইংলিশ পেসার স্টিভ হার্মিসনকে আউট করে ৫০০ উইকেট পূর্ণ করেন কুম্বলে। ওই টেস্টে দুই ইনিংস মিলে তিনি নেন ৯ উইকেট। ভারত পেয়েছিল ৯ উইকেটের বড় জয়। সেটি ছিল কুম্বলের ১০৫তম টেস্ট। কম টেস্ট খেলে ৫ শ’ উইকেট নেয়ার তালিকায় মুরালির পরেই তার অবস্থান। সবমিলে ক্যারিয়ারে ১৩২ টেস্টে ৬১৯ উইকেট নিয়েছেন কুম্বলে। পাশাপাশি ২৭১ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ২৩৭ উইকেট।
অ্যান্ডারসন-ব্রড

অনীল কুম্বলের পর ৫ শ’ উইকেট নেয়া বোলার পেতে টেস্ট ক্রিকেটকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় এক যুগ। টি-টোয়েন্টির এই যুগে বেশি বেশি ম্যাচ খেলার কারণে পেস বোলারদের ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয় না। ইনজুরি কিংবা অন্য কোন কারণে লম্বা ক্যারিয়ারের পেস বোলারের দেখা মেলা কঠিন। হয়তো টি-টোয়েন্টির লোভ সামলাতে পারার কারণেই দুই ইংলিশ পেসার জেমস অ্যান্ডারসন ও স্টুয়ার্ড ব্রড অনেক দিন পর নিজেদের নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে অ্যান্ডারসন ৫ শ’ উইকেট নেয়ার কীর্তি গড়েন। সেটি ছিল তার ১২৯তম টেস্ট। আর এ বছরের মাঝামাঝিতে করোনভাইরাসের কারণে লম্বা বিরতির পর যে সিরিজ দিয়ে ক্রিকেট মাঠে ফিরেছিল সেই সিরিজেই অ্যান্ডারসনের পাশে নাম লেখান স্টুয়ার্ড ব্রড। সিরিজের প্রথম টেস্টে একাদশে রাখা হয়নি ব্রডকে। দ্বিতীয় টেস্টে দলে ফিরে নিজেকে নিয়ে যান নতুন উচ্চতায়। সেটি ছিল তার ক্যারিয়ারের ১৪০তম টেস্ট। সেই টেস্টে আবার বিশ্রাম দেয়া হয় অ্যান্ডারসনকে। এরপর সিরিজের তৃতীয় টেস্টে এক সাথে খেলেন দু’জন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জুটি বেঁধে বোলিং করেন ৫ শ’ উইকেট নেওয়া দুই বোলার। ২৬৯ রানে টেস্ট জিতে ইংল্যান্ড জিতে নেয় করোনার সময়ে শুরু হওয়া প্রথম টেস্ট সিরিজ। আরেকটি মিল আছে এই দু’জনের মাঝে। অ্যান্ডারসন-ব্রড দুজনেরই ৫শতম শিকার ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপেনার ক্রেইগ ব্রাথওয়েট। বেচারা ব্রাথওয়েট!

ব্রড অ্যান্ডারসন দু’জনেই এখনো খেলে চলছেন। তাই তাদের ঝুলিতে উইকেট সংখ্যা আরো বাড়বে। অ্যান্ডারসন ইতোমধ্যেই ৬ শ’ উইকেটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন (১৫৩ টেস্টে ৫৮৯ উইকেট)। দুজনই ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়ে খেলে যাচ্ছেন শুধু টেস্ট ক্রিকেট। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের এই সময়ে টি-টোয়েন্টিতে রীতিমতো টাকা উড়ছে। সেই মোহে না পড়ে ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাট টেস্টকে বেছে নেয়ার কারণেই হয়তো এই অর্জন তারা করতে পেরেছেন।
ওয়াসিম আকরাম

এতক্ষণ যাদের কথা বলা হলো তারা ৫শ উইকেট নিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটে। আর ওয়ানডেতে এই কীর্তি সবার আগে গড়েছেন পাকিস্তানের কিংবদন্তি পেসার ওয়াসিম আকরাম। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে ডাচ ওপেনার নিক স্ট্যাথামকে বোল্ড করে অনন্য নজির গড়েন তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেট শুরুর তিন দশক পর ঘটলো এমন ঘটনা। ছয় বছর পর শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়াহ মুরালিধরনও রেকর্ড বইয়ে আকরামের পাশে নাম লেখান।
ওয়াসিম আকরাম ক্যারিয়ার শেষ করার আগে ৩৫৬ ওয়ানডে খেলে নিয়েছেন ৫০২ উইকেট। পাশাপাশি ১০৪ টেস্টে তার উইকেট ৪১৪টি। দুই ফরম্যটেই চারশ বা তার বেশি উইকেট আছে আর শুধুমাত্র মুরালিধরনের।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ