ধার্মিক চাষি -তমসুর হোসেন

ধার্মিক চাষি -তমসুর হোসেন

গল্প অক্টোবর ২০২০

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়ামত নামে এক গরিব চাষি বাস করত। তার ছিল দুই ছেলে আর এক মেয়ে। তার বড়ো ছেলেটি ছিল জন্ম থেকেই অন্ধ আর ছোট ছেলেটি ছিল বোবা। আর মেয়েটি ছিল বধির এবং বিকলাঙ্গ। এই সন্তানদের নিয়ে নিয়ামতের ভাবনার শেষ ছিল না। সে মারা গেলে এদের কী উপায় হবে সে কথা ভেবে কান্নায় তার বুক ভিজে যেত। নিয়ামতের স্ত্রী আমিনা ছিল খুবই ধর্মপরায়ণা এবং ধৈর্যশীলা। সে সব সময় নিয়ামতকে সান্ত¡না দিত এবং তাকে ধৈর্যধারণ করতে বলত।
সেই রাজ্যের এক নিভৃত গ্রামে বাস করত একজন বুজুর্গ আবেদ। আল্লাহর কামেল বান্দা হিসেবে তার নাম রাজ্যের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন তার কাছে গিয়ে তাদের সমস্যার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলত। তিনি প্রাণ খুলে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতেন। তিনি অত্যন্ত পরিশুদ্ধ জীবনযাপন করতেন। আল্লাহপাক তার দোয়ার বরকতে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করে দিতেন। এ খবর শুনে একদিন নিয়ামত তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে সেই বুজুর্গের দরবারে গেল। খুব বিনয়ের সাথে তার কাছে সে সন্তানদের কষ্টের কথা জানাল। বুজুর্গ আবেদ তার অসুস্থ সন্তানদের দেখে খুবই ব্যথিত হলেন এবং কায়মনোবাক্যে খোদার কাছে তাদের সুস্থতার জন্য দোয়া করলেন। বৃদ্ধ আবেদ লোকদের ধর্মীয় দীক্ষাও দিতেন। তার কাছ থেকে শরীয়তের বিধান এবং মারেফাতের সবক জেনে নিয়ে নিয়ামত ও তার স্ত্রী সহিশুদ্ধ জীবনযাপনে ব্রতী হল। বুজুর্গ আবেদ নির্দেশ দিলেন নিয়ামত যেন মাঝে মাঝে সন্তানদের নিয়ে তার কাছে আসে।
বুজুর্গের নির্দেশমত নিয়ামত মাঝে মাঝে সন্তানদের নিয়ে তার কাছে যায়। হঠাৎ একদিন বুজুর্গ তার বড়ো ছেলেকে কাছে ডেকে নিয়ে কানে কানে কী যেন বললেন। তারপর জোরে গলাধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘যাও বেটা, গোলক রাজ্যের রাজা হও।’ আর একদিন তার ছোট ছেলের গালে থাপ্পড় দিয়ে আদেশ করলেন, ‘যাও বেটা পুশকিন রাজ্যের সেরা বিদ্বান হও।’ একইভাবে অন্য একদিন তার বিকলাঙ্গ মেয়েটিকে বললেন, ‘যাও বেটি জৈন্তা রাজার পুত্রবধূ হও।’
নিয়ামতের বড় ছেলে জুনুন আবেদের কথার তাছিরে হাঁটতে হাঁটতে গোলক রাজ্যের ভেতরে চলে যায়। সেখানে এক বৃক্ষের নিচে বিশ্রাম নিয়ে সে দৃষ্টিশক্তি লাভ করে। বৃক্ষের নিচে পড়ে থাকা সুমিষ্ট ফল খেয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে সে অনেক কথা ভাবতে শুরু করে। সে দেশের রাজা বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে রাজ্যের প্রথা অনুসারে সেদিন রাজহস্তীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নতুন রাজা খুঁজে নিয়ে আসার জন্য। রাজহস্তী এসে বিশ্রামরত জুনুনকে তুলে নিয়ে যায় রাজ দরবারে। সোনার পালঙ্কে বসিয়ে তাকে ঘিরে সবাই আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। জুনুনের মাথায় তারা পরিয়ে দেয় স্বর্ণের তাজ। মূল্যবান পরিচ্ছদে সজ্জিত করে বিশাল রাজদরবারে সম্মানিত মন্ত্রীবর্গ এবং সেনাপতি তাকে রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এ দৃশ্য দেখে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। বৃদ্ধ রাজা এসে অত্যন্ত তাজিমের সাথে তাকে রাজ সিংহাসনে বসিয়ে দেয়। নতুন রাজার সম্মানে প্রজারা সারা রাজ্যজুড়ে আনন্দ কোলাহলে মেতে ওঠে।
নিয়ামতের ছোট ছেলে শাহবাজ ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূরের অজানা পুশকিন রাজ্যে চলে যায়। কত সুন্দর সেখানকার পথঘাট, কত মনোরম সেখানকার দালানকোঠা! ঘন সবুজ অরণ্য, পরিচ্ছন্ন জলাশয় এবং সারিবদ্ধ বৃক্ষরাজি দেখে সে অবাক হয়ে যায়। একটি শানবাঁধা পুকুর দেখে তার খুব পিপাসার উদ্রেক হয়। পুকুরের পাড়ে বসে সে মনের আনন্দে পানি পান করে। সে পানি এতটা সুমিষ্ট আর স্বাস্থ্যকর যে তার শরীর সবল এবং রোগমুক্ত হয়ে যায়। সে পুকুরের পানির বরকতে সে বাকশক্তি লাভ করে। তার শরীরে এতটা লাবণ্য প্রকাশ পায় যে শহরের চাবিরক্ষক দূর থেকে তাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে যায়। তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, মনোমুগ্ধকর অবয়ব এবং কোঁকড়ানো চুল দেখে তার অন্তরে দারুণ মায়া জাগে। শাহবাজের পরিচয় জেনে সে তাকে নিজের মহলে নিয়ে যায়। তার সন্তানহীনা স্ত্রী কোহিনুর শাহবাজকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। সেখানে থেকে লেখাপড়া শিখে সে অনেক বড় বিদ্বান হয়ে পুশকিন রাজার সভাসদের পদ অলংকৃত করে।
নিয়ামতের বধির এবং বিকলাঙ্গ মেয়েটি খোঁড়াতে খোঁড়াতে এদিক থেকে সেদিকে ঘুরে ঘুরে একদিন জৈন্তা রাজার খাসমহলের প্রধান ফটকে পৌঁছে যায়। খাসমহলের বিশাল ইমারতের চমৎকারিত্বে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফটকের পাশে কিম্মতি ফলের গাছে একটি অপরূপ সুন্দর তোতাপাখি বসে ছিল। সে ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে একটি রঙিন পাকা ফল তার সামনে ফেলে দেয়। পথ চলার ক্লান্তিতে সে দারুণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল। ফলটি পেয়ে খুশি হয়ে গাছের ছায়ায় বসে সে তৃপ্তিভরে খাওয়া শুরু করে। আর সাথে সাথে তার কৃশ এবং বিকলাঙ্গ দেহটি অপরূপ লাবণ্যে ভরে যায়। কে যেন তাকে তড়িঘড়ি করে জরির কাজ করা সবুজ ঘাগরা পরিয়ে দেয়। হীরের নকশা দিয়ে কে যেন পরিপাটি করে দেয় তার মাথার ওড়না। খাসমহলের বারান্দায় পায়চারি করছিল জৈন্তা রাজা। তার নজর পড়ে খুবসুরত বালিকাটির দিকে। তিনি তাকে দেখে খুব পুলকিত হলেন। তাকে লাগছিল শাহ বুরুন্দির কন্যা শাহাজাদী দিলতাজের মত দেখতে! যার ছিল ভুবনজোড়া রূপ। কেমন করে সে এল তার খাসমহলের সামনে। দারোয়ানকে ডেকে তিনি মেয়েটিকে মহলে নিয়ে আসতে বললেন। তার কাছে তিনি সব কথা জেনে নিলেন। সত্যই বলেছে মেয়েটি। এক রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল তার। এক দরবেশ তাকে বলেছিল শাহজাদার বিয়ের পাত্রী আল্লাহর অশেষ করুণায় একদিন তার মহলেই চলে আসবে। এমন সুন্দর একটি মেয়েকে দেখে আনন্দে তার মন ভরে গেল। মনে মনে কত মেয়েই তো দেখেছেন তিনি হরমুজের সাথে বিয়ে দেবার মানসে। কিন্তু এমন অপরূপ লাবণ্যময়ী কোন মেয়ে অদ্যাবধি তার নজরে পড়েনি। খুব ধুমধাম করে তিনি পুত্র হরমুজের সাথে মেয়েটির বিয়ে দিলেন।
আর কোন দুঃখ থাকল না নিয়ামতের। বৃদ্ধ আবেদের দোয়ার বরকতে তার জীবনে নেমে এলো অভাবিত সুখ শান্তি এবং সম্মান।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ