নজরুলের মনচিত্র ও পেছনের মানচিত্র   -আহমাদ হোসাইন নির্ঝর

নজরুলের মনচিত্র ও পেছনের মানচিত্র -আহমাদ হোসাইন নির্ঝর

স্মরণ আগস্ট ২০১৫

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আমরা সবাই জানি তিনি আমাদের জাতীয় কবি কিন্তু আমাদের সংবিধান জানে না আমাদের জাতীয় কবি কে? কারণ সাংবিধানিকভাবে আমাদের কোনো জাতীয় কবি নেই। কেন নজরুল আমাদের জাতীয় কবি? এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কখন একজন কবি জাতীয় কবি হতে পারেন? যখন একজন কবি একটা জাতির প্রতিভূ হয়ে ওঠেন তখনি তিনি ঐ জাতির জাতীয় কবি হতে পারেন। যখন কোনো কবির কাব্যে সে দেশ ও সমাজের মানুষের আবেগ অনুভূতির সামগ্রিক রূপ ফুটে ওঠে, যখন কোনো কবি সে জাতির হাসি-কান্না, আনন্দ- বেদনাকে তার কাব্যে রূপায়িত করেন, যখন কোনো কবি তার কবিতার বিষয়বস্তÍু হিসেবে নিজের জাতিকে উপস্থাপন করেন, যখন কোনো কবি তার কবিতার মাধ্যমে নিজ জাতিকে জাগিয়ে তুলতে চান, যখন কোনো কবি তাঁর জাতিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পরিণত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, যখন কোনো কবি সমাজের সকল মতের-পথের-শ্রেণির-ধর্মের-বর্ণের মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন, যখন কোনো কবি ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস তৈরি করেন, যখন কোনো কবি তার সংস্কৃতিকে বিশ্ব সংস্কৃতিতে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রমাণ করতে চান তিনিই তখন ঐ জাতির জাতীয় কবি হতে পারেন। এই সব শর্ত পূরণ করেই নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। তিনি আমাদের হাসিয়েছেন-কাঁদিয়েছেন-ভাবিয়েছেন-বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন-মানবতার জয়গানে মুখরিত করেছেন- প্রেমের গভীর ভাব উচ্চকিত করেছেন। তার কবিতা পড়ে অবালবৃদ্ধবনিতা প্রাণের উচ্ছ্বাসে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বাংলার মাটির গহিনে প্রোথিত তার কাব্য শিকড়। বাঙালির যেখানে সমস্যা দেখেছেন সেখানেই তার কলম সজাগ হয়েছে।
নজরুল ব্যক্তিগত মননে জাতীয় চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন তার কাব্যে। নিজেকে আবিষ্কার করেছেন সবার মাঝে। সকল কালের সকল কবির সকল গীতির ছন্দ সুর পেয়েছে নজরুল মননে। জীবনকে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তিনি এবং বুঝতে পেরেছিলেন নিজ হৃদযের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নেই। তাই হৃদয়ের ধ্যানগুহা মাঝে বসে তিনি নিজেকে চিনেছেন ভাঙা গড়ার কারিগর হিসেবে। নজরুল পাঁকে পাঁকে ঘুরে বাঁকে বাঁকে ঠেকে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন বিদ্রোহী ভৃগু হিসেবে। বীণা, বাঁশি, প্রেম, বিদ্রোহ, গান; নজরুল সাহিত্যের প্রাণ। নবসৃষ্টির উন্মাদনায় মুখর ছিল তার ব্যক্তিসত্তা। সত্য ও সুন্দরের সাধনায় তার অন্তরালোক উদ্ভাসিত হয়েছিল স্বর্গীয় আলোক ধারায়। নিজেকে জানা নিজেকে চেনা বেশ জটিল। নজরুল প্রথম যৌবনেই নিজেকে চিনেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন -
“আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।”
খুব অল্প বয়সেই নজরুল যখন নিজেকে চেনার ঘোষণা দিলেন তখন বুদ্ধদেব বসুর মত সমালোচকেরা মনে করেছিলেন বাচ্চা ছেলের আস্ফালন। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, নজরুল কোনো দিন বাড়েননি, বড় হননি-কুড়ি বছর আর চল্লিশ বছরের লেখার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। বুদ্ধদেব বসু যদি অবজ্ঞার দৃষ্টিতে নজরুলকে না দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন নজরুলের কুড়ি বছরের লেখা আর চল্লিশ বছরের লেখা এক নয়। তার কুড়ি বছরে যে লেখা কুড়ি ছিল চল্লিশে তা হয়েছিল বিকশিত পুষ্প। ফুটি ফুটি করেছিল যে ফুল বিশ বছরে চল্লিশ বছরে সে শুধু ফুটেইনি ঘ্রাণেও মাতোয়ারা করেছিল বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যকে। কুড়ি বছরে উড়ি উড়ি করেছিল যে কবি চল্লিশ বছরে সে উড়াল দিয়েছে অসীমের পানে। প্রিয়-ঘন সুন্দর, প্রেম-ঘন সুন্দর, আনন্দ-ঘন সুন্দরের অতীন্দ্রিয় স্পর্শলোকে আরোহণ করেছেন কবি। নিজেকে রাঙিয়েছেন অপার অসীম শক্তির বর্ণিল রঙে। কুড়ি বছরে যে সৌন্দর্য লোকের ধ্যান করেছেন, তপস্যা করেছেন চল্লিশ বছরে এসে তাতে বিলীন হয়েছেন, পরম সত্তাকে চিনেছেন, ডুব দিয়েছেন তার অরূপ রূপের মহা সমুদ্রে। নিজের ঈশ্বরকে আবিষ্কার করেছেন নিজের মাঝেই ......

আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল, আমার দেউল
আমারি এই আপন দেহ
আমার এ প্রাণের ঠাকুর নহে সুদূর
অন্তরে মন্দির গেহ
সে থাকে সকল সুখে সকল দুখে
আমার বুকে অহরহ,
কভু তায় প্রণাম করি, বক্ষে ধরি,
কভু তারে বিলাই স্নেহ
(বাউল-চন্দ্রবিন্দু)
নিজেকে নিয়ে নিজেই খেলায় মেতে ছিলেন কবি। দুঃখের আগুনে পুড়ে পুড়ে, শত দুর্বিপাক আর কঠোর জীবন সংগ্রামের বৈতরণী পার হয়ে নজরুল নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়। রবীন্দ্রনাথ যেটা ৮০ বছর বয়সে বুঝেছিলেন (সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম) নজরুল সেটা ২২ বছর বয়সেই বুঝেছিলেন।

নজরুল যোগ সাধনা করতেন এই তথ্য সবারই জানা ছিল কিন্তু কেউ কখনো তাকে যোগ সাধনা করতে দেখেননি। একবার তিনি ফিল্ম স্টুডিওতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন এবং একটা খুব রোমান্টিক গল্প বলতে বলতে হঠাৎ করে উদাস হয়ে গেলেন। সবাই অধীর হয়ে আছে গল্পের শেষ শোনার জন্য কিন্তু নজরুলের কণ্ঠ পরিবর্তন হযে গেল। সদা দিল খোলা হাসির অধিকারী সম্পূর্ণ ভিন্ন কণ্ঠে বললেন- কে যেন আসছে। তখন অন্ধকার রাত ছিল ফিল্ম স্টুডিওর বন্দুকধারী কডা দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে এটা নজরুলের বন্ধুদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে অন্ধকারের বুক চিরে বিশাল দেহধারী কালো রঙের একজন মানুষ তাদের সামনে চলে এলো। তার কথাবার্তা উদভ্রান্তের মত, তিনি নজরুলকে বাসন্তী রঙ ত্যাগ করতে নিষেধ করলেন। সবাই তাকে পাগল মনে করল এবং দু-একজন রক্তচক্ষু দেখিয়ে তাকে বের করে দিতে চাইল কিন্তু নজরুল তা করতে দেননি। লোকটি এসেই নজরুলের সঙ্গেই কথা বলেছিল বেশি। পরে তিনি লোকটিকে বুঝিয়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন। আসার পর সবাই ঠাট্টা করে বলেছিল- এমন আতিথ্যের কারণেই ইান্ডাস্ট্রিতে পাগল প্রবেশ করে। কিন্তু নজরুল কণ্ঠ নিচু এবং ভরাট করে বলেছিলেন ও পাগল নয় যোগভ্রষ্ট। যোগে ভুল হয়ে ও এখানে চলে এসেছে ওর এখানে আসার কথা ছিল না। পরবর্তীতে সবাই নজরুলের আধ্যাত্মিক শক্তি উপলব্ধি করতে পারল। নজরুল আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত ছিল এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য তার কাছে অনেক টাকাও এসেছিল। নজরুল যখন গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান লিখছিলেন তখন তার কাছে প্রচুর টাকা এসেছিল। তিনি মানবসৃষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রচন্ড শক্তি দিয়ে সেটা রুখে দিতে চেয়েছেন কিন্তু যখন তার ছেলে বুলবুল মারা যায় তখন তিনি দেখলেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি এ কাজ করেছে যার সঙ্গে কোনোভাবেই যুদ্ধ করা যাবে না। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত এবং মহাশক্তিশালী। তখন থেকে নজরুল অদৃশ্য শক্তির ধ্যানে মগ্ন হলেন এবং যোগ সাধনা শুরু করলেন।
একবার নজরুল তার অফিসে বসে আছেন। সে সময় একজন মাওলানা তার কাছে এলেন। নজরুল তাকে বললেন আমি আপনার সঙ্গে ইসলাম নিয়ে বহাস করতে চাই। মাওলানা বললেন- ইসলাম নিয়ে বহাস করা যায় না। আমি আপনার সঙ্গে বহাস করতে পারবো না; ইসলাম বহাস সমর্থন করে না। আপনি ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে প্রশ্ন করতে পারেন। তখন নজরুল কাগজ কলম হাতে নিলেন। তিনি একটা সূর্য আঁকলেন আর একটা কেন্দ্রবিন্দুতে একটি মানুষের ছবি এঁকে সেখান থেকে ঐ সূর্যের কাছে পৌঁছার অনেক পথ দেখালেন, কোনোটা সোজা, কোনোটা বক্র, কোনেটা ঘুরানো, কোনোটা আবার প্যাঁচানো। সব রেখা এসে ঐ সূর্যে মিশেছে। তারপর সেই দৃশ্য মাওলানাকে দেখিয়ে নজরুল বললেন- ইসলামের লক্ষ্য হলো আল্লাহকে পাওয়া। সেই পাওয়ার জন্য অসংখ্য পথ আছে যার যেটা খুশি সে সেটা পছন্দ করে নেবে। এ নিয়ে হুজুরদের এত বাড়াবাড়ি কেন? তখন মাওলানা বললেন- লক্ষ্যে পৌঁছার অনেক পথ আছে ঠিক কিন্তু ইসলামের পথ একটাই। সেটা হলো আপনি কেন্দ্রবিন্দু থেকে যে সোজা রেখাটি এঁকেছেন সেটা। অন্যগুলো ইসলামের পথ নয়। ইসলাম হলো ইহ্দিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম এ বিশ্বাসী। তখন নজরুল চোখ বন্ধ করলেন তিনি দেখতে পেলেন অসংখ্য আলোক রশ্মি তাঁর চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে তিনি খুব জোরে চিৎকার করে উঠলেন এবং বেহুঁশ হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। তারপর অফিসের সবাই এসে তাঁকে মাথায় পানি দিয়ে দীর্ঘ সময় পর তার হুঁশ ফিরিয়ে আনল। হুঁশ ফেরার পর নজরুল চেয়ারে বসে আবার একই বিষয়ে ভাবা শুরু করলেন কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি আবারো একই দৃশ্য দেখতে পেলেন এবং আবারো চিৎকার করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।
নজরুলের অনেক কবিতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য স্মৃতি। এত দ্রুতগতিতে অল্প সময়ে ভালো কবিতা লেখার শক্তি নজরুল ছাড়া আর কারো ছিল না। তিনি মুহূর্তের মধ্যে কবিতা লিখতে পারেতেন। তাকে চা আর পান দিয়ে কোনো ঘরে ঢুকিয়ে দিলে অনর্গল বেরিয়ে আসতো কবিতার পর কবিতা। তিনি অঝোর লিখেছেন, প্রচুর লিখেছেন, হাততালিও পেয়েছেন, নিন্দাও কম সহ্য করতে হয়নি।
মূলত তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বের হওয়ার পরই নজরুল যেমন জননন্দিত হয়ে ওঠেন তেমনি জননিন্দিতও হয়ে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গে তার শত্রুও জুটতে থাকে। এমনকি তার একান্ত কিছু গুণগ্রাহীও তার শত্রুতে পরিণত হয়। কবিতাটি নজরুলকে হঠাৎ করেই খ্যাতির সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের ঘটনাও ভিন্নতর। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বিজলী’ পত্রিকায় (২২ পৌষ, ১৩২৮/ ৬ জানুয়ারি, ১৯২২)। বিজলী পত্রিকায় লেখা ছিল কবিতাটি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক ১৩২৮ সংখ্যা থেকে সংগৃহীত। মজার বিষয় হলো বিদ্রোহী যখন প্রকাশিত হয় ‘বিজলী’ পত্রিকায় তখন পর্যন্ত ‘মোসলেম ভারত’ কার্তিক-১৩২৮ সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যে প্রথম কোনো কবিতা যেটি যে পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে সেই পত্রিকা বের হওয়ার আগেই অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নানামুখী অসুবিধার কারণে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকা তখন নিয়মিত প্রকাশিত হতে পারতো না। কবিতাটি মূলত ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার জন্য লেখা হয়েছিল কিন্তু ‘বিজলী’ সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকার যখন শুনলেন এমন একটি কবিতা নজরুল লিখেছেন যা বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা করেছে তখন তিনি ‘মোসলেম ভারত’ অফিসে যান এবং সেখান থেকে কবিতাটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন এবং ‘বিজলী’তে ছাপিয়ে দেন।
১৯১৬ সালে রানীগঞ্জ শহরে এক অদ্ভুত দর্শন ফকিরের আবির্ভাব ঘটে। গোঁফ- দাড়িতে মুখ ভর্তি, মাথায় লম্বা জটা চুল, হাত-পায়ের নখ বোধ হয় কোনো দিন কাটা হয়নি। সমগ্র দেহের তুলনায় পা অত্যন্ত ছোট। সব সময় তার হাত বাঁধা থাকায় বালকেরা তার প্রতি কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তার প্রতি ঢিল ছুড়ে, খোঁচা দিয়ে আঘাত করতে থাকে কিন্তু ঐ ফকির কোনো দিন কথা বলত না। নজরুলও তার প্রতি আকৃষ্ট হন। একদিন গরুর গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ঐ লোকটি মারা যায়। নজরুল তাকে নিয়ে লিখেন তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’।
কোরবানি মুসলিম সমাজের একটি পবিত্র অনুষ্ঠান। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের দিলের কালিমা মোচন করাই এই অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। কিন্তু তরিকুল আলম নামে এক উচ্চশিক্ষিত মুসলমান কোরবানির নোংরা ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তার মূল বক্তব্য হলো কোরবানি উৎসবে ব্যাপক হারে যে পশু হত্যা করা হয় তা বর্তমান সভ্য সমাজের উপযোগী নয়। এই অযথা রক্তপাতের মধ্যে আদিম বর্বরতা লুকিয়ে আছে। নজরুল এর প্রতিবাদ করে লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘কোরবানি’। তিনি এতে কোরবানির মাহাত্ম্য ঘোষণা করেন এবং বলেন ...
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খামকা ক্ষুব্ধ মন!

হেমেন্দ্রকুমার রায়ের বড় মেয়ের বিয়েতে যখন নজরুল এলেন তখন সবার মাঝে কানাকানি পড়ে গেল। হিন্দুর বিয়েতে মুসলমান এসেছে এতে তাদের জাত চলে যাবে, বিয়েটা অমঙ্গল হবে। তা ছাড়া মুসলমান কিভাবে হিন্দুর পাশাপাশি বসে খাবে? এসব নিয়ে মোটামুটি হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। অসন্তোষের বিষ ছড়িয়ে পড়ল সব হিন্দুর ভেতরে। নজরুল এই ঘটনায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। এ ধরনের আরো একটি ঘটনার শিকার হলেন নজরুল তার বন্ধু নলিনাক্ষ সন্যালের বিয়েতে। একই অসন্তোষ কানাঘুষাতে পরিণত হলো, মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। হিন্দুর বিয়েতে মুসলমান অসহ্য। বিষয়টা চাপা না থেকে গুঞ্জরণ শুরু হলো, সর্বশেষ চিৎকারে ফেটে পড়ল সবাই। নজরুল তখন বিয়ে আসর ত্যাগ না করে রচনা করেন ‘জাতের বজ্জাতি’ গানটি। তারপর উদাত্তকণ্ঠে সবাইকে গেয়ে শুনান ...
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছ জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতে জাতির জান,
তাইতো বেকুব করলি তোরা এক জাতিকে এক শ’ খান

বলতে পারিস্ বিশ্ব পিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন্ ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
নারায়ণের জাত যদি নাই ,
তোদের কেন জাতের বালাই ?
তোরা ছেলের মুখে থুতু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া।

মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশের জন্য জনাব আফজালুল হক ঢাকার নওয়াব স্যার আহসান উল্লাহ বাহাদুরের কন্যা ও নওয়াব সলিমুল্লাহ বাহাদুরের বোন নওয়াবজাদী মেহেরবানু খানমের আঁকা একটি চিত্রশিল্প সংগ্রহ করেন। ছবিটিতে ফুটে উঠেছিল খেয়া পারাপারের দৃশ্য। তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ ¯্রােতধারা নদী উন্মাদ গর্জনে বয়ে চলেছে আপন বেগে। দু’টি তরণী সেই তরঙ্গ সঙ্কুল নদীতে ভাসছে- তারা পারাপারের যাত্রী। চিত্রে একটি তরণীকে নিমজ্জমান অবস্থায় দেখানো হয়েছে অন্যটি দুর্যোগ অতিক্রম করে অবলীলায় যাত্রী পারাপার করছে। একটি পাপের অন্যটি পুণ্যের নৌকা। পাপেরটি পারাপারে যেতে ব্যর্থ তাই নিমজ্জমান। কিন্তু পুণ্যের নৌকা সওদায় ভরপুর, পারাপারের যাত্রায় অটল, অবিচল। কোনো বাধায় তার যাত্রাপথ থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পারে না। এই নৌকার চারটি দাঁড়ের মাথায় আরবি অক্ষরে ইসলাম ধর্মের প্রথম চারজন খলিফা আবু বকর, উমর, ওসমান ও আলী (রা)- এর নাম লেখা রয়েছে। হাল ও পালের মধ্যে লেখা আছে মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর নাম ও শাফায়াত। এ নৌকা ধর্মেরি বর্মে সুরক্ষিত। আফজালুল হক এ ছবির পরিচিতি লিখে দিতে নজরুলকে অনুরোধ করলে নজরুল লিখলেন বিখ্যাত কবিতা-‘খেয়াপারের তরণী’-
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও
কান্ডারি আহমদ তরী ভরা পাথেয়।
আবু বকর, ওসমান, ওমর, আলী হায়দর
দাঁড়ি যে এ তরণীর নাই ওরে নাই ডর !
কান্ডারি এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা
দাঁড়ি মুখে সারি গান লা শারিক আল্লাহ!

নজরুলের নিকট ‘মোসেপটোমিয়া’ নামে একটি সচিত্র ইংরেজি বই ছিল। ধারণা করা হয় এটি তিনি করাচি সেনানিবাসে থাকার সময় সংগ্রহ করেছিলেন। এই বইয়ের প্রথমে আর্ট পেপারে একটি অপূর্ব ছবি মুদ্রিত ছিল। ছবিটি আফজালুল হক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ছাপাতে চান। এ জন্য তিনি নজরুলকে ছবিটির উপযোগী একটা পরিচিতি লিখে দিতে বলেন। নজরুল সেটা করতে গিয়ে খুব অল্প সময়ে লিখে ফেলেন বিখ্যাত ‘শাত-ইল আরব’ কবিতাটি।
আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে নজরুল সঙ্গীত অপূর্ব লালিত্য পেত ও মুগ্ধতা ছড়াতো। আব্বাস উদ্দীন নজরুলকে ইসলামী সঙ্গীত লেখার জন্য অনুরোধ করেন। নজরুল দ্বিধায় পড়ে যান। রেকর্ড কোম্পানি যদি রাজি না হয় এই আশঙ্কায় নজরুল প্রথমে সেদিকে ততটা মনোযোগ দেননি। কিন্তু আব্বাস উদ্দীন ছাড়বার পাত্র নন। তিনি রেকর্ড কোম্পানির রিহার্সেল ইনচার্য শ্রী ভগবতী ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করেন। প্রথমে ভগবতী বাবু বিষয়টি উড়িয়ে দিলেও আব্বাস উদ্দীনের পীড়াপীড়িতে মাত্র একটি গানের রেকর্ড করার অনুমতি দেন এবং নজরুলকে সেই গান রচনার দায়িত্ব দেন। অনুমতি পেয়ে আব্বাসউদ্দীন নজরুলের কাছে ছুটে যান। নজরুল তখন রিহার্সেল রুমে ইন্দুবালাকে গান শিখাচ্ছিলেন। অনুমতির সংবাদ পেয়ে তিনি ইন্দুবালাকে বিদায় করে দিলেন এবং মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে লিখে ফেললেন...
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’- এই গানটি। সঙ্গে সঙ্গে সুরারোপ করে শিখিয়ে দিলেন আব্বাসউদ্দীনকে। তারপর দিন একই সময় আব্বাসউদ্দীন এলেন এবং কবি লিখলেন....
‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর’। গান দু’টি লেখার চারদিন পর রেকর্ড হয়। রেকর্ডের দুই মাস পর ছিল ঈদুল ফিতর। গান দুটো বাজারে বের হলো। রেকর্ড কোম্পানির রেকর্ড বিক্রির সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়ে গেল। প্রত্যেক মুসলমানের বাড়িতে বাড়িতে বাজতে থাকল...ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ। হাটে-মাঠে-বাটে শিক্ষিত-অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত সবার কণ্ঠে বাজতে থাকলো...ও মন রমজানের ঐ...। রেকর্ড় কোম্পানি ব্যাপক লাভবান হলো। অঝোর ধারায় ইসলামী গান রচনা ও রেকর্ড় শুরু হলো। এত বেশি পরিমাণে গানগুলো চলতে লাগল হিন্দু গায়ক-গায়িকারা মুসলমান নাম ধারণ করে ইসলামী সঙ্গীত গাইতে শুরু করে দিলো। চিত্ত রায়ের নাম হলো দেলোয়ার হোসেন, ধীরেন দাসের নাম হল গণি মিঞা, গিরীন চক্রবর্তী হয়ে গেলেন সোনা মিয়া। নারী শিল্পীদের মধ্যে আশ্চর্যময়ী দেবি হলেন সকিনা বেগম আর হরিমতি দেবি নাম ধারণ করলেন আমিনা বেগম। চলতে থাকল ইসলামী সঙ্গীত। নজরুল ইসলামের বদৌলতে হিন্দুরাও ইসলাম জানতে শিখল আর দরদভরা কণ্ঠে ইসলামের মহিমা প্রচার করতে লাগলো।
কবি চট্টগ্রাম গেলে সব সময় উঠতেন বাহার-নাহারদের বাড়িতে। কবি যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরের জানালার পাশে পুকুরের কিনারায় ছিল নয়টি সুপারি গাছ। জ্যোৎস্না রাতে এ গাছগুলো কবির কাছে অপূর্ব লাগত। কবি গাছগুলোর সঙ্গে মনে মনে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন। কিন্তু যখন চট্টগ্রাম ছেড়ে আসছিলেন তখন তার মন আকুল হয়েছিল এই সুপারি গাছগুলোর জন্য। তিনি লিখলেন কালজয়ী কবিতা ‘গুবাক তরুর সারি’ ....
বিদায় হে মোর বাতায়ন পাশে
নিশীথ জাগার সাথী
ওগো বন্ধুরা পান্ডুর হ’য়ে
এল বিদায়ের রাতি !
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ আমার
জানালার ঝিলিমিলি
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর লিখলেন ‘রবীহারা’ খান বাহাদুর আব্দুল আজিজের মৃত্যু নিয়ে লিখলেন ‘বাংলার আজিজ’।
এইভাবে অসংখ্য ঘটনাকে নজরুল কবিতায় রূপ দিয়েছেন। কালজ বিষয়কে কালোত্তীর্ণ করেছেন। ক্ষণকালের জিনিসকে মহাকালের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ ঘটনার অসাধারণ ধ্বনি ব্যঞ্জনা দিয়েছেন। নানা ঘটনা-রটনার মধ্য দিয়ে তৈরি করেছেন তার কাব্য জমিন, যা যুগ থেকে যুগান্তরে বিশ্বমানবের সৌন্দর্য পিপাসার তৃষ্ণা নিবারণ করে চলছে আজো; হয়তো চলবে অনাদিকাল পর্যন্ত ...।
লেখক : প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ, সারদা, রাজশাহী
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ