না ফেরার দেশে

না ফেরার দেশে

তোমাদের গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নিশাত তাসনীম স্বস্তি #

পাখিদের কিচিরমিচির গান শুনে ঘুম ভাঙে সাইফের। বিছানা থেকে উঠেই জানালা খুলে দিলো। এখনও চারিদিকে অন্ধকার। সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে। সাইফের ডাকে ঘুম ভাঙল তাইফেরও। ও আচ্ছা, আমি তো ওদের পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি। সাইফ আর তাইফ। ওরা দুই ভাই। সাইফ এক বছরের বড়। ওদের বাবা নেই। মা পরের বাড়িতে কাজ করেন। ওদের একটা গাভী আছে। ওকে আদর করে তারা সোনাই বলে ডাকে। সোনাইকে ওরা খুব ভালোবাসে। সারাদিন ঘুড়ি উড়িয়ে আর সোনাইকে মাঠে মাঠে চরিয়েই দিন কাটে ওদের। সাইফ আর তাইফ দু’জন দু’জনকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তবে মাঝে মাঝে দু’জনের মধ্যে রাগারাগি হলেও কিছুক্ষণ পরই আবার ভাব হয়ে যায়। যেমন একদিন হয়েছে কী, ঘুড়ি হারিয়ে যাওয়ায় তাইফ সাইফের ঘুড়ি উড়াচ্ছিল। হঠাৎ সেটা গাছের ডালে আটকে গেল। সাইফ তা জানতে পেরে ভাইকে খুব বকাঝকা করল। কিন্তু সেটাও ক্ষণস্থায়ী। কিছুক্ষণ পরই ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘একটা ঘুড়ি নষ্ট হলে কী হবে? আমি আরও বানাতে পারব। ভাই, তুই রাগ করিসনি তো?’ ব্যাস এখানেই রাগের ইতি। যাহোক ঘুম থেকে উঠেই দুই ভাই মায়ের কাছে গেল। মা বললেন, ‘হাত-মুখ ধুয়ে আয়। আমি খেতে দিচ্ছি’ হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল ওরা, আজও সেই পান্তাভাত। প্রতিদিন একই খাবার খেতে হয়। ওদের মায়ের ইচ্ছা করে ভালো খাবার খেতে দিতে। কিন্তু অভাবের মধ্যে তা আর হয়ে ওঠে না। প্রতি দিনের মতো আজও ওরা সোনাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মাঠে ঘাস খাওয়াতে। সাথে দুটো ঘুড়িও নিয়ে গেল। ওরা দু’জন খুব ভালো ঘুড়ি ওড়ায়। সোনাই এর গলার দড়িটা গাছের নিচে বেঁধে রাখল। আর দুই ভাই মেতে উঠল ঘুড়ি ওড়ানোতে। ঘুড়িটাও মুক্ত আকাশ পেয়ে মনের সুখে উড়তে লাগল।  তারা যত বেশি সুতা ছাড়ছে ঘুড়ি ততই উপরে উঠছে। ঘুড়িটা যেন আকাশ ছুঁতে চায়। ঠিক ওদের মত। দুই ভাইয়ের খুব শখ স্কুল ব্যাগে বই খাতা নিয়ে একসাথে স্কুলে যাবে। রোজ রাতে মায়ের কোলে শুয়ে মাকে বলে, ‘মা সবাই তো স্কুুলে যায়। আমরা যাবো না?’ তার মা বলেন যাবি তো। তোরাও স্কুলে যাবি। আগে তোদের বাবা আসুক। তোদের বাবা তো অনেক  দূরের দেশে গেছে। সেখান থেকে অনেক টাকা নিয়ে আসবে। তখন তোরা সবার মতো বই-খাতা নিয়ে স্কুুলে যাবি। এ কথা বলেই থেমে যান ওদের মা। দুই ভাই সে আশা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে মায়ের মন সারারাত কাঁদে। সন্তানের কথা ভেবে একটুও ঘুমাতে পারেন না। দুই ভাই স্বপ্ন দেখে। তারা সকালে যাবে। রাতে বাবার কাছে পড়বে। বাবা অনেক টাকা আনবে। তাদের আর কোন অভাব থাকবে না। কিন্তু তারা নিজেরাও জানে না তাদের স্বপ্ন সত্যি হবে কি না। আজ সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝেই জোরে বাতাস বইছে। এর মধ্যেই কাজে বের হয়েছেন সাইফের মা। মায়ের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করেছেন তিনি। সাইফ গেছে ওষুধ কিনতে। সকাল পেরিয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। কিন্তু সাইফ আর এলো না। তাইফ খুব ভয় পেল। কাঁদতে লাগল, মায়ের গায়ে হাত দেয়া যাচ্ছে না। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হলো। সাইফ ফিরে এলো, কিন্তু একা নয়; সাথে অনেক মানুষ। সারা শরীর রক্তাক্ত। ‘ট্রেনের নিচে চাপা পড়েছে।’ কে যেন বলে উঠলো একজন। তাইফের সব আশার প্রদীপ যেন নিভে গেল এক নিমিষে। সে বুঝতে পারছে না কী হয়েছে তার ভাইয়ের। তাহলে কী সাইফও না ফেরার দেশে চলে গেল, বাবার মত!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ