নিজেকে গড়ার মাস রমজান

নিজেকে গড়ার মাস রমজান

বিশেষ রচনা আগস্ট ২০১০

ইকবাল কবীর মোহন

বছর ঘুরে প্রতি বছর মাহে রমজান আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়। রোজা মুসলমানদের বহুল পরিচিত ও পালনীয় ইবাদাত। এ সময় মুসলিম উম্মাহ পুরো এক মাস রোজা পালন করে। রমজান হিজরি সালের নবম মাস। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। রমজান শব্দটি আরবি ‘রমজ’ থেকে এসেছে। ‘রমজ’ অর্থ দহন বা পোড়ানো। এ মাসে রোজা পালন করলে মানুষের মধ্য থেকে লোভ-লালসা, পাপ-পঙ্কিলতা ও হিংসা-দ্বেষ দূরীভূত হয়। আগুন যেমন কোন জিনিসকে পুড়িয়ে ফেলে, ঠিক তেমনি রোজাও মানুষের অসৎ কাজকে পুড়ে ফেলে। রোজা পালনকারী রমজানে তার যাবতীয় পাপ মুছে ফেলার সুযোগ লাভ করে। এই অর্থে এই রোজার মাসকে ‘মাহে রমজান’ বলা হয়। ‘রোজা’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ উপবাস। আরবিতে রোজাকে বলা হয় ‘সওম’। সওম-এর বহুবচন সিয়াম। এর অর্থ বিরত থাকা। তাই শরিয়তের পরিভাষায় রোজা বলতে বোঝায়-সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারসহ আল্লাহর নিষিদ্ধ সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। রোজা শুধু হজরত মুহাম্মাদ (সা)-এর উম্মত মুসলমানদের ওপরই ফরজ হয়নি, এর আগেও রোজা পালনের বিধান ছিল। পৃথিবীতে প্রথম মানুষ ও নবী হজরত আদম (আ)। তিনিও রোজা পালন করতেন। হজরত নূহ (আ)-এর সময় প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার প্রথা প্রচলন ছিল। হজরত দাউদ (আ) তাঁর শিশু পুত্রের অসুস্থতার সময় সাত দিন রোজা পালন করেছেন বলে জানা যায়। হজরত মূসা ও হজরত ঈসা (আ) ৪০ দিন করে রোজা রেখেছেন। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা) রমজানের রোজা ফরজ হবার আগে মহররমের নবম ও দশম তারিখ রোজা রাখতেন। তবে তিনি যে রোজা রাখতেন তা ছিল ইহুদিদের নিয়ম। এটা রাসূল (সা) ভালো মনে করলেন না। তাই তিনি এই ইবাদাতের পদ্ধতি আলাদাভাবে করার জন্য চিন্তাভাবনা করলেন। এর জন্য তিনি মহান প্রভুর কাছে মুনাজাত জানালেন। আল্লাহ রাসূলের (সা) মুনাজাত কবুল করলেন। সেই অনুযায়ী হিজরি দ্বিতীয় বর্ষ (৬২৩ ঈসায়ী) রোজাকে ফরজ করে আল্লাহ নির্দেশ জারি করলেন। মাহে রমজানের পুরো এক মাস তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম দশ দিন রহমত, দ্বিতীয় দশ দিন মাগফিরাত এবং তৃতীয় দশ দিনকে নাজাতের সময় বলা হয়। এ মাসে আমরা আল্লাহর কাছ থেকে অশেষ রহমত ও করুণা লাভের সুযোগ পাই। আমাদের অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়ার সুযোগ দিয়েছেন বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এক মাস রোজা পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের আখিরাতের জীবনে শান্তি লাভের পথও প্রশস্ত করতে পারি। মহান আল্লাহতায়ালা রমজানের রোজাকে সকল মুসলমান নর-নারীর বাধ্যতামূলক করার আদেশ করেছেন হিজরি দ্বিতীয় সালে। কুরআনে পাকে সূরা আল-বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ!  তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর- যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ পরে রাসূলে করীম (সা) নিজেও রোজা পালনের গুরুত্ব এবং এর ফজিলত সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে এবং এমনিভাবে রাতে ইবাদত করে তার আগের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘রমজান মাস ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে বেহেশত।’ অপর এক হাদিসে রাসূল (সা) বলেছেন, ‘মাতৃগর্ভ থেকে শিশু যেমন নিষ্পাপ হয়ে ভূমিষ্ঠ হয় রমজানের রোজা পালন করলে মানুষ ঠিক সেরূপ নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ নবী (সা) রোজাকে পাপ থেকে বেঁচে থাকার উপায় বলে ঘোষণা করেছেন। তাই অপর এক হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ ওপরে বর্ণিত কুরআন ও হাদিসের আলোকে এ কথা স্পষ্ট  বোঝা যায়, সবাইকে রমজানের রোজা অবশ্যই পালন করতে হবে। কুরআনের আয়াতে ও রাসূলের (সা) হাদিসের রোজা পালনের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বলা হয়েছে। রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো- তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্থাৎ নিজের মধ্যে আল্লাহর ভয় তৈরি করা। আল্লাহকে ভয় করলেই যে কেবল সকলপ্রকার গুনাহ তথা পাপ ও অন্যায় থেকে বাঁচা যায় সেটাই কুরআনে  বোঝানো হয়েছে। যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা কখনও খারাপ কাজ করতে পারে না। কোন অন্যায় রোজা পালনকারী করতে পারে না। আল্লাহর ভয়ে যারা ভীত তারা যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ পায় রোজার মাধ্যমে। কেউ সঠিকভাবে রোজা পালন করলে এবং খারাপ কাজ ত্যাগ করলে সে শিশুর মতো পাক-সাফ হওয়ার সুযোগ লাভ করে। রমজানের রোজা মানুষের দেহ ও মনকে পবিত্র করে। তেমনি রোজা সবার মধ্যে যাবতীয় ভাল কাজের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করে। রোজার সময় সারাদিন উপবাস থাকতে হয়। ফলে রোজাদার মানুষের মধ্যে অভাবী ও দরিদ্র মানুষের অভাব ও কষ্ট বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়। রোজার দিনে মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় কাজ করে। ফলে যাবতীয় বাজে কাজ থেকে সে বিরত থাকে। ফলে রোজাদারের মধ্যে অন্যায় ও অসৎ কাজের প্রবণতাও দূরীভূত হয়। রোজা পালন করলে আল্লাহ তায়ালা মানুষের সব গুনাহ মাফ করে দেন। তাই এ মাসে যদি আমরা আমাদের অতীতের সব অপরাধ মাফ করিয়ে নিতে পারি, তাহলেই আমরা আখিরাতে সফল হবো। রোজার দিনে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরও রাতে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। তারাবি আমাদের জন্য রোজার মাসে বাড়তি ও বরকতময় ইবাদত। তারাবির নামাজ আমাদের সবার পড়তে হয়। এ মাসে দিনের নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়লে অনেকগুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। রোজার দিনে যে কোন ভাল কাজের সওয়াব অন্যান্য সময়ের তুলনায় ৭০ থেকে ৭০০ গুণ বেশি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই সবাই পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ জামাতের সাথে নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করব। অন্যান্য ভাল ভাল কাজগুলোও যতটা সম্ভব বেশি করার চেষ্টা করব। এভাবে রোজার এক মাস নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করলে, ভাল কাজ করলে বছরের বাকি মাসগুলোতে আমরা অনায়াসেই সে নিয়মে নামাজ আদায় করতে পারব। সবসময় ভাল কাজ করে আল্লাহর দিদার লাভ করার সুযোগ পাবো। আমরা জানি, ইসলাম আমাদের জন্য একমাত্র ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। আর পবিত্র আল কুরআন আমাদের জীবন পরিচালনার নির্দেশিকা। রাসূলের (সা) মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা এ পবিত্র মহাগ্রন্থ আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। এ কুরআন নাজিল হয়েছে মাহে রমজানের পবিত্র মাসে। তাই রোজার গুরুত্ব অনেক বেশি। তেমনি কুরআনের মর্যাদাও অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এ মাসে বেশি বেশি কুরআন অধ্যয়ন করলে অফুরন্ত সওয়াব লাভ করা যায়। তাই রোজার দিন আমরা প্রত্যহ কুরআন অধ্যয়ন করার অভ্যাস গড়ে তুলবো। কুরআনই আমাদের বলে দেবে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ। কোন পথে আমাদের মুক্তি ও আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি তা কুরআন পাঠে অনায়াসে বোঝা যায়। এ জন্য শুধু অধ্যয়নই নয়, কুরআনকে বুঝে-শুনে পাঠ করতে হবে। আজকাল কুরআনের বাংলা তাফসির পাওয়া যায়। সেটি পড়লে কুরআনের আদেশ-নিষেধ জানা যায় এবং জীবনে চলার পথ সুগম হয়। পবিত্র রোজার দিনে আমরা সারাদিন উপবাস থাকি। শেষরাতে উঠে আমরা সেহরি খাই। এ সময়ে অনেকেই ভাল ভাল সেহরি খেতে চেষ্টা করি। আবার দিনের শেষে ইফতারেও যথেষ্ট ভাল খাবার খেতে আমরা সবাই পছন্দ করি। লক্ষ করলে দেখা যাবে সমাজের অগণিত গরিব ও অভাবী মানুষ রোজার দিনেও অনেক কষ্ট করে জীবনযাপন করে। তারা ভাল  সেহরি কিংবা ইফতার খেতে পারে না। আমরা তাদের প্রতি খেয়াল করতে পারি। তাদের অভাব-অনটনে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। এতে তারা যেমন খুশি হবে, তেমনি আমাদের স্রষ্টাও আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। রোজার মাসে আমরা ইচ্ছা করলেই বেশি বেশি দান খয়রাত করার চেষ্টা করতে পারি। এ সময়ের দানকে অন্যান্য সময়ের চাইতে অনেক বেশি বরকতময় বলা হয়েছে। সবাই মিলে আমরা এ কাজটি করতে পারলে সমাজে অভাবী মানুষের সংখ্যাও কমে যাবে। সমাজ থেকে দূর হবে অনটন। এভাবে এক মাসব্যাপী অন্যান্য মানুষের দুঃখ লাঘবের যে চেষ্টা আমরা করবো তাতে আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ এবং সহানুভূতির গুণ তৈরি হবে। আর এ গুণ আমাদেরকে সুন্দর মানুষে পরিণত করবে। এভাবেই আমরা আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা হিসেবে গণ্য হবো। রোজা পালনের সময় মারামারি ও ঝগড়া-ফাসাদ অশোভনীয়। রোজা রেখে আমরা কারো সাথে ঝগড়াঝাটি বা রাগারাগি করতে পারি না।  কেউ রোজার সময় কোন উত্তেজক কথা বললে বা ঝগড়া করতে চাইলে তাকে জানাতে বলা হয়েছে যে- ‘আমি রোজাদার।’ দীর্ঘ এক মাস এ ধরনের খারাপ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার ফলে  রোজাদারদের মধ্যে এক অসাধারণ গুণ সৃষ্টি হয়। এর আলোকে আমরা মহান চরিত্র মাধুর্য অর্জন করতে পারি। রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস। তাকওয়া অর্জনের মাস। এ মাস ধৈর্য ও সহনশীলতার মাস। এ মাস ইবাদাতের মাস। রমজান সমাজের অন্যান্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বোঝা ও লাঘব করার মাস। সর্বোপরি, মাহে রমজান পবিত্রতা অর্জন করে আখিরাতে মুক্তির মাস। তাই এসো, সবাই মিলে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করি। এ মাসকে নিজেদের গড়ে তোলার কাজে লাগাই। তাহলে আমরা ইনশাআল্লাহ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারব। জান্নাতের পথে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ