নিশিরাতে মামাবাড়ি । শরীফ আবদুল গোফরান

নিশিরাতে মামাবাড়ি । শরীফ আবদুল গোফরান

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মুরগাঁও গ্রাম। এই গ্রামের পশ্চিম পাড়ার বটতলায় একসময় সাপ্তাহিক হাট বসতো। লোকে হাটের নাম রেখেছিল মুহুরীগঞ্জহাট। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি বড় খাল। এই খালে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কত রঙের নৌকা চলতো এই খাল দিয়ে। বর্ষা এলে বাইদ্যারা নানা জিনিসপত্র নিয়ে নৌকা ভিড়াতো মুহুরীগঞ্জহাটে। খালের ওপর দিয়ে গড়ে উঠে একটা পাকা ব্রিজ। আর এই ব্রিজের পূর্ব মাথায় খালের ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট এক বটগাছ। লোকেরা জায়গাটির নাম রেখেছে বটতলা। আজ আর মুহুরীগঞ্জ হাট না থাকলেও বটতলা নামটি কেউ মুছে ফেলতে পারেনি।
এই বটতলায় একটি ছেলেকে প্রায়ই দেখা যায়। নাম তার মুসলিম। গ্রামের লোকেরা তাকে মুসা বলে ডাকে। দেখতে বেশ লম্বা। হাত-পা লম্বা লম্বা। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। হাঁটু ভেঙে কোমর বাঁকা করে ও ভাঙা দিয়ে দাঁড়ায়। বটতলায় একটি বর্শি হাতে নিয়ে সে সব সময় মাছ ধরে। রাতের বেলা তাকে বেশি দেখা যেত। কত লোক যে তাকে দেখে ভয় পেয়েছে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
একদিন মোজাম্মেল ও তার মামা তাদের নিজ বাড়ি বসন্তপুর থেকে রওয়ানা করেছে- মুরগাঁও নানা বাড়ি আসবে। বসন্তপুর থেকে মুরগাঁও প্রায় ৭- ৮ মাইলের রাস্তা। বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু দূর এলেই মামার স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যায়। মোজাম্মেল বললো মামা যাত্রাতেই স্যান্ডেল ছিঁড়েছে আজকের যাত্রা শুভ হবে না, আজ না হয় বাড়ি ফিরে যাই। কাল ভোরে রওয়ানা দেবো। কিন্তু মামার তাড়ায় তা আর হলো না। গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা। ধুলায় হাঁটু অবধি প্যান্ট একদম সাদা হয়ে গেছে। মামার কাঁধে একটা ব্যাগ। ওর ভেতর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আট মাইল পথ কিভাবে যাবে ভাবতেই গা চমকে ওঠে তাদের। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে কী করে। যেতে তো হবেই।
গালগল্প করতে করতে পথ চলছিল ওরা। মাটির উঁচু রাস্তার ওপর বাতাস আছড়ে পড়ছে। ততক্ষণে রাতের অন্ধকার নেমে এলো। ধারে কাছে বাড়িঘর নেই। দূরে কালো ছায়ার মতো গ্রাম দেখা যায়। জনমানবহীন মাঠ। আকাশে চাঁদ ছিল। খণ্ড খণ্ড মেঘ তা ঢেকে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। তারা দু’জন হাঁটছে, হাঁটতে হাঁটতে একসময় বটতলার কাছাকাছি এসে পড়লো। ব্রিজের ওপর উঠে সামনে বটগাছের গোড়ার দিকে তাকাতেই ধক করে উঠলো ওদের বুকের ভেতর। মোজাম্মেল, ও মামা ওটা কি বলে মামাকে জড়িয়ে ধরলো। ভূতের মতো কী যেন সটা হয়ে বটগাছটায় হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মধ্যে মশার কামড়ে নড়ে ওঠে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বলে না। ভয়ে মনটা চুপসে গেল। শরীর দিয়ে ঘাম বেরুতে লাগলো। আশপাশে কোনো বাড়িও নেই যে কাউকে ডাকবে।
মোজাম্মেল বললো, এটা ভূতই হবে। মনে হয় এই বটগাছেই থাকে। কি প্রেথমই বলিনি আজ বিপদ রয়েছে? যা হোক সাহস করে হাঁটতে লাগলো ওরা। মোজাম্মেল কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো, ভূত বাবাজি আমি কিছু করিনি যা করেছে মামাই করেছে। আমি ওকে না আসার জন্য বারণ করেছি। সে আমার কথা শোনেনি।
কবির মামা মোজাম্মেলের হাত চেপে ধরে বলতে গেলে টেনে- হেঁচড়ে বটতলা পার হতে লাগলো। এ দিকে ভূতটি নড়েচড়ে ওঠে বলে উঠলো-‘কাগু হারই যান। আই এ না। ডরান কিল্লাই’। এতক্ষণে মোজাম্মেলের দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। তাকে কাঁধে নিয়ে কবির মামা কোনমতে বাড়ি গিয়ে পৌঁছলো। বাড়ি গিয়ে বলতেই সবাই হ্যারিকেন নিয়ে বটতলায় এলো। দেখে খোনার বাড়ির আম্বর আলীর ছেলে মুসা। বটগাছের নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। লোকজন দেখে ও ভাঙা দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। একজন গিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলো তাকে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে। আরে মারেন কিল্লাই, আই কিচ্ছি।
গ্রামের উত্তর পাড়ায় মুসারা থাকে। মুসারা মানে মুসার ছোট এক ভাই ও বোন। মুসার বাপ নেই। মা মারা গেছে তারও আগে। বছর দুয়েক আগে হঠাৎ চার দিনের জ্বরে যখন তার বাপ মারা যায়, তখন মুসার বয়স আট।
তারপর শুরু হয়েছিল তাদের দুঃখের জীবন। জমি-জমা ওদের কিছুই নেই। মুসার বাবা পরের জমিতে কামলা খাটতো। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর খুব কষ্টে পড়লো ওরা। তাই তাকেই ভাইবোনের দিকে তাকিয়ে সংসারের হাল ধরতে হলো। সে মাছ ধরে করিম সওদাগরের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্রি করে। কখনো কখনো লাকড়ি কুড়িয়ে নিয়ে যায় গফুরের চা দোকানে। যখন একেবারেই কোন আয়-রোজগার হয় না তখন হাত পাতে অন্যের কাছে। এভাবে ভাই-বোন দু’টিকে নিয়ে চলে তাদের সংসার।
পরদিন সকালবেলা মুসা তার ছোট ভাই কালাকে নিয়ে বাঁকা হয়ে কাসেমের চা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাতে মার খেয়ে বাড়ি ফিরেছে বলে মাছ ধরতে না পারায় আজ আর পকেটে একটা টাকাও নেই। খিদেই পেট চোঁ চোঁ করছে। রাতে দু’খানা শুকনো রুটি পেটে পড়েছিল। সকালে এখন পর্যন্ত কিছুই যায়নি। কাসেম মিয়া বিটা এক তাওয়ায় পরটা ভাজছে। দু’ ভাই তাকিয়ে আছে ওদিকে। ভাজি দিয়ে পরটা খাওয়া খুব পছন্দ তার।
এমন সময় করিম সওদাগার ডাক দিলো একটা বস্তা নিয়া দিতে। মুসা এগিয়ে গেল ওদিকে। কিন্তু তার আগেই পৌঁছে গেল ছদরিয়া। মুসা কাছে গিয়ে বলছে, সওদাগর আঁরেনি বোলাইছেন। ছদরিয়া ভেংচি কেটে বললো, তোরে ‘ন, আঁরে বোলাইছে। তোরে বোলাইলে কি অইবো? নিজের গতরটা লই আঁটিতে হারছ না, আবার বস্তা ধরবি। মুসা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো করিম সওদাগরের দিকে।
গফুরের চা দোকানে বসে আছে গ্রামের মেম্বর সাহেব। হাত পাতলো মুসা। মেম্বর সাব আঁরে অগগা টেয়া দেন। মেম্বর সাব আট আনা পয়সা বের করে দিলো। আডা না, নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেল মুসার মুখ থেকে। অগগা টেঁয়া হুরাই দেন মেম্বর সাব। মেম্বর সাহেব রাগ হয়ে গেল, কি কস? এক টাকা? টাকা কি গাছে ধরে। অমনি চা দোকানদার গফুর মিয়া ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো দোকান থেকে। মুসা দোকানের বাইরে কাত হয়ে পড়ে গেল। করুণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকলো। আর এদিকে তার চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো।
ঐ পথ দিয়ে মোজাম্মেল বগু মাস্টারের মক্তব থেকে পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ গফুর মিয়ার দোকানের দিকে তাকাতেই মুসাকে তার চোখে পড়লো। তার মনে পড়ে গেল বগু মাস্টারের অনেক উপদেশের কথা। এতিমকে ভালোবাসবে। এতিমের গায়ে হাত বুলাবে। তুমি নিজে খেলে প্রতিবেশীকে খেতে দিলে না তাহলে মোমিন হতে পারবে না। নানা বাড়ি আসার সময় মায়ের দেয়া দশটি টাকা এখনো তার পকেটে আছে। তার দয়া হলো। সে পকেট থেকে দশটি টাকা বের করে মুসার হাতে দিলো। আর বললো, ভাই এ টাকা দিয়ে কিছু কিনে খাও। ভিক্ষা করো না ভাই। কাজ করে খাও। এটা আমাদের নবীর শিক্ষা।
নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত করো সবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ