পরশ পাথর -মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস
নাটিকা এপ্রিল ২০১৭
চ রি ত্র লি পি মূল চরিত্র খন্ড চরিত্র ড. সৈকত : গবেষক নুরু মামা : চা দোকানি মি. জিসান : গবেষণা সহকারী শোভন : সাধারণ ছাত্র মি. শৈবাল : গবেষণা সহকারী পিয়ন : স্কুল পিয়ন শিরিন : সৈকতের স্ত্রী ওসি : পুলিশ অফিসার সৌরভ : সৈকতের বিপথগামী ছেলে পুলিশ-১ : কনস্টেবল গৌরব : সৈকতের আদর্শবান ছেলে পুলিশ-২ : কনস্টেবল দিলদার : সৈকতের কাজের লোক ডাক্তার : নামেই পরিচয় প্রধান শিক্ষক : নামেই পরিচয় নার্স : নামেই পরিচয় জুয়েল : খারাপ ছাত্র ১ম ব্যক্তি : পাবলিক পলাশ : খারাপ ছাত্র ২য় ব্যক্তি : পাবলিক রহমত : আদর্শবান ছাত্র ছাত্র-ছাত্রী : সাধারণ শিক্ষার্থী দৃশ্য-৩৭ ইনডোর স্থান : প্রধান শিক্ষকের কক্ষ চরিত্র : প্র: শিক্ষক, অন্যান্য শিক্ষক, জুয়েল, পলাশ ও পিয়ন (প্রধান শিক্ষক কলিংবেল বাজান। প্রবেশ করে পিয়ন) প্র: শিক্ষক : দেখ তো, শহীদ মিনারের পাশে কারা? জুয়েল পলাশ না? পিয়ন : (দেখে) জে স্যার। প্র: শিক্ষক : ডেকে দাও। (পিয়নের প্রস্থান) রেজাল্টের জন্য সবাই এলো, অথচ গৌরবের কোনো খোঁজ নেই। (টেবিল সাজায়। জুয়েল ও পলাশের প্রবেশ) প্র: শিক্ষক : কী, সবাই অফিসের সামনে, তোমরা ওখানে কেন? সারা বছর কত বকাবকি করেছি। একটা কথাও কানে নাওনি। এখন ফেল করার মজাটা বুঝলে তো? জুয়েল : স্যার, রেজাল্ট শিটে ভুল রয়েছে। প্র: শিক্ষক : বদের হাঁড়ি, রেজাল্ট শিটে ভুল রয়েছে, তাই না? (গৌরবের প্রবেশ। স্যারকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।) প্র: শিক্ষক : একি! এমন খুশির দিনে কাঁদছো কেন? গৌরব : আব্বু আর বাঁচবেন না। প্র: শিক্ষক : কেন কী হয়েছে? গৌরব : ভাইয়ার অ্যারেস্টের কথা শুনে আব্বু স্ট্রোক করেছেন। ডাক্তার বলেছেন, আর জীবনেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। প্র: শিক্ষক : তোমার খুশির দিনে এতো বড় দুঃসংবাদ। ধৈর্য ধরো। মানুষের ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর হাতে। গৌরব : স্যার ভাইয়ার রেজাল্ট? প্র: শিক্ষক : ফেল করেছে। গৌরব : (জুয়েল ও পলাশকে) তোমরা? প্র: শিক্ষক : ওরাও। গৌরব, চিন্তা করো না। তোমার আব্বুর বিপদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। গৌরব, এখন রেজাল্ট নিয়ে ব্যস্ত। ছাত্র-ছাত্রীরা আনন্দ উল্লাস করছে, অভিভাবকরা আসছেন, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা আসছেন। ঝামেলা কমে গেলে সহকর্মীদের নিয়ে স্যারকে দেখতে যাবো। তুমি আর দেরি করো না। রেজাল্ট নিয়ে এখনই বাড়িতে যাও। গৌরব : দোয়া করবেন স্যার। (প্রস্থান) (দৃশ্যান্তর) দৃশ্য-৩৮/ইনডোর স্থান : বেড রুম চরিত্র : সৈকত, শিরিন, দিলদার, জিসান, শৈবাল, গৌরব, শিক্ষকবৃন্দ, রহমত (বেড রুমে শুয়ে অসুস্থ সৈকত। পাশে শিরিন ও দিলদার) সৈকত : আমি বসতে পারবো না- দাঁড়াতে পারবো না-সারাজীবন শুয়ে থাকতে হবে- তোমাদের কষ্ট করতে হবে। শিরিন এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো ছিল। শিরিন : ডাক্তার বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছেন। সৈকত : না, না, আর বলবো না। (কিছুক্ষণ চুপ দেখে) শিরিন, আজ রেজাল্টের দিন না। কোনো খবর পেলে? দিলদার : গৌরব এহনো ফেরে নাই। সৈকত : আমি জানি, সৌরভ ফেল করবে। যেদিন জেনেছি ও ফেনসিডিল খায় সেদিন বুঝেছি ওর লেখাপড়া শেষ, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার ঘরে এমন কুপুত্র জন্মাবে ভাবতেও পারিনি। শিরিন : একটু চুপ করবে। সৈকত : স্যরি, আর কথা বলবো না। (ফুলের মালা পরে গৌরবের প্রবেশ) গৌরব : (সবার পদধূলি নিয়ে) আব্বু, আম্মু আমি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। সৈকত : এ প্লাস! গোল্ডেন এ প্লাস! ও মাই গড। (শিরিন জড়িয়ে ধরে। সৈকত উঠে বসে) গৌরব : আব্বু! তুমি বসেছ? এই নাও (নিজের মালা সৈকতকে দেয়) শিরিন : শিগগির শুয়ে পড়। তোমার মেরুদন্ডে আঘাত। উঠতে গেলে পড়ে যাবে। সৈকত : না, না, আমি সুস্থ হয়ে গেছি। গৌরব : আব্বু! জড়িয়ে ধরে। (কলিংবেল বাজে) নিশ্চয় স্যারেরা এসেছেন। আম্মু, তুমি একটু ভেতরে যাও। (শিরিনের প্রস্থান। গৌরব দরজা খুলে দেয়। প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্যদের প্রবেশ) প্র: শিক্ষক : স্যার, এমন খুশির দিনে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সৈকত : কে বলে আমি অসুস্থ। এই দেখ- (নড়ে চড়ে বসে) প্র: শিক্ষক : স্যার, আমরা আরো একটা শুভ সংবাদ নিয়ে এসেছি। ৫ বছরে যারা ভালো রেজাল্ট করেছে এবং চরিত্রমাধুর্যে সেরা সরকার তাদের অ্যাওয়ার্ড দেবে। সেই তালিকার শীর্ষে রয়েছে গৌরবের নাম। সৈকত : অ্যাওয়ার্ড! যে অ্যাওয়ার্ডের জন্য আমি ২০ বছর ধরে সাধনা করছি, সেই অ্যাওয়ার্ড পাবে আমার সন্তান। ও মাই গড। এসব আমি কী শুনছি। আরে তোমরা এখনো দাঁড়িয়ে আছো। বসো, বসো, দিলদার, এখনই জিসান, শৈবালকে খবর দে। আজ আমি সকলের সাথে মন খুলে গল্প করবো। (সৈকত বেড থেকে নেমে উঠে দাঁড়ান) গৌরব : একি আব্বু, তুমি কিভাবে দাঁড়ালে! প্র: শিক্ষক : আমরাতো শুনেছিলাম আপনি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। সৈকত : ডাক্তার মিথ্যে বলেছে, আমি সত্যিই সুস্থ। শিরিন, শিগগির মিষ্টি নিয়ে এসো। আমি সকলকে নিজ হাতে খাওয়াবো। গৌরব : আম্মু শিগগির এসো। আব্বু উঠে দাঁড়িয়েছেন। (মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে শিরিনের প্রবেশ) সৈকত : আমার কাছে দাও। শিরিন : না, না, তুমি পারবে না। পড়ে যাবে। সৈকত : (প্যাকেট কেড়ে নিয়ে সকলকে খেতে দেয়।) প্রবেশ করে জিসান ও শৈবাল। সৈকত : এখন এলে! জিসান : টেলিভিশনে খবর দেখছিলাম। (প্রধান শিক্ষককে) স্যার আপনাদের স্কুলে আর কে অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে। প্র: শিক্ষক : রহমত। খুব গরিবের ছেলে। দু’বছর আগে আমাদের স্কুল থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল। সৈকত : রহমত! সেই এতিম ছেলেটা? গৌরব : আব্বু, ভাইয়ার সাহায্য না পেলে আমার রেজাল্ট হয়তো এরকম হতো না। সৈকত : হায় হায় হায়। ওর সাথে আমি বড় অবিচার করেছি। দিলদার, রহমতকে এখনই খুঁজে বের কর। আমি ওর পা ধরে মাফ চেয়ে নেবো। (প্রধান শিক্ষককে) মাস্টার তুমি কত বছর শিক্ষকতা করছো? প্র: শিক্ষক : ৩৫ বছর। সৈকত : এখানে সকলেই শিক্ষিত। জিসান, শৈবাল আমার সাথে দীর্ঘদিন রিসার্চ করেছে। তোমাদের সকলকে একটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। প্র. শিক্ষক : বলেন স্যার, (সবার উৎসুক দৃষ্টি) সৈকত : সৌরভ-গৌরব একই মায়ের সন্তান। এক হাঁড়ির ভাত খেয়ে একঘরে থেকে লেখাপড়া করেছে। অথচ, একজনের হাতে ফেনসিডিলের বোতল। আরেকজনের গলায় ফুলের মালা। একজন হলো নরকের কীট, আরেকজন সোনার মানুষ। বল, এমনটি কী করে হলো? প্র: শিক্ষক : সারাজীবন ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দিয়েছি। এ কথা কখনো ভাবিনি। জিসান : রিসার্চ করতে গিয়ে দেশ-বিদেশের বহু বই পড়েছি। সেমিনার সিম্পোজিয়াম করেছি। কিন্তু এক বাড়ির ছেলে দুই পথে ধাবিত হওয়ার কারণ কখনো তলিয়ে দেখিনি। সৈকত : (গৌরবকে) বাবা, তুই বল। প্র: শিক্ষক : হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই বলো। গৌরব : আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন একটা পরশ পাথর পেয়েছিলাম। সৈকত : পরশ পাথর! সেই পরশ পাথরের ছোঁয়ায় সোনা হয়ে গেছিস তাই না? গৌরব : আব্বু পরশ পাথর আমাকে শিক্ষা দিয়েছিল-মানুষ প্রকাশ্যে গোপনে আড়ালে আবডালে যে কাজই করুক তা রেকর্ড হচ্ছে, ক্যামেরাবন্দি হচ্ছে। একদিন পাই পাই করে সব কাজের হিসাব দিতে হবে। ভালো কাজের পাল্লা ভারি হলে পরম শান্তি। আর খারাপ কাজ বেশি হলে অনন্তকাল কঠিক শাস্তি ভোগ করতে হবে। সেই শাস্তির কোন সীমা-পরিসীমা নেই। প্র. শিক্ষক : এ কথা আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু গুরুত্ব দেইনি। সৈকত : তারপর। গৌরব : যেদিন শুনেছি সব কাজের হিসাব দিতে হবে। সেদিন থেকে কোন খারাপ কাজ করিনি। আমার বিশ্বাস, ভাইয়ার মাথায় এ কথা ঢোকাতে পারলে ফেনসিডিল খেত না। খারাপ পথে পা বাড়াত না। শৈবাল : কী সাংঘাতিক কথা। স্যার, এ থিওরি দিয়ে বাংলাদেশকে মাদকমুক্ত করা সম্ভব। জিসান : অদ্ভুত থিওরি। মৃত্যুর পর প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতার ভয় থাকলে মানুষ এমনিই ভালো হয়ে যাবে। আইন করে পুলিশ দিয়ে মানুষকে ভালো করা যাবে না। ২০ বছর গবেষণার পর একটা তরুণ ছেলে আমাদের সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছে। সৈকত : গৌরব এ পরশ পাথর আমার সৌরভকে দিসনি কেন। ওটা পেলে ‘ও’ সোনার মানুষ হতো। নরকের কীট হয়ে জেলখানায় যেতো না। বল, কেন দিসনি? গৌরব : আব্বু- সৈকত : না, না, আমি আর কিছুই শুনতে চাইনে। বল কোথায় সেই পরশ পাথর? গৌরব : আব্বু, পরশ পাথরের সন্ধান দিলে আমি আর এ বাড়ি থাকতে পারবো না। তুমিই আমাকে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। সৈকত : ভণিতা রেখে আসল কথা বল? গৌরব : আব্বু, তুমি ওটাকে এ বাড়িতে নিষিদ্ধ করেছিলে। সৈকত : সেটা কি কুরআন শরিফ? গৌরব : হ্যাঁ আব্বু। সৈকত : কুরআন শরিফ পরশ পাথর? গৌরব : তোমার গৌরবই তার প্রমাণ। কুরআন বুঝে পড়লে প্রতিটা মানুষ খাঁটি সোনায় পরিণত হয়ে যায়। (সবাই ফ্রিজ হয়ে যায়। নেপথ্যে তেলাওয়াত ... জালিকাল কিতাবু লারইবা ফি হুদাল্লিল মুত্তাকিন। ইহা এমন একটি গ্রন্থ যাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং মুত্তাকিদের জন্য পথপ্রদর্শক।) সৈকত : হায় হায় হায়। আমি ঘরের ভেতর মানিক রেখে মানিকের খোঁজে সারা দুনিয়া হাতড়ে বেড়াচ্ছি। উহ কী ভুল না করেছি। আমার প্রাণপ্রিয় সন্তান সৌরভকে আমি নিজ হাতে খুন করেছি। ভুল থিউরি দিয়ে গোটা জাতিকে বিভ্রান্ত করেছি। সারা জীবন মাথা কুটে মরে গেলেও এর খেসারত দিতে পারবো না। জিসান, শৈবাল, আমার লাইব্রেরি এখনো ফাঁকা পড়ে আছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআন দিয়ে আজকেই ওটা সাজিয়ে ফেল। (রহমতের প্রবেশ) বাবা, তুমি এসেছ। আমাকে ক্ষমা করে দাও। (নিজের গলার মালা রহমতের গলায় পরিয়ে দেন) এ মালা আমার গলায় শোভা পায় না। বাবা, এখন থেকে আমার লাইব্রেরিতে হবে কুরআনের গবেষণা। আর জুয়েল পলাশের মতো অসংখ্য পথহারা তরুণ সেখানে এসে সোনা হয়ে যাবে। গান-আল কুরআনের পথ এই পথই আসল পথ (সমাপ্ত)
আরও পড়ুন...