পরিবর্তন

পরিবর্তন

গল্প সেপ্টেম্বর ২০১০

বিশ্বাস আবুল কালাম

সন্ধ্যেবেলা পড়তে পড়তে অকস্মাৎ বাইরে বের হয়ে এল টিপু। তার চোখে-মুখে এখন শিশু ছাড়িয়ে কৈশোরের রঙ্গমঞ্চ। এটা ওটা নিয়ে একটু একটু করে চিন্তা করতে শিখেছে সে। টিপুর মন এখন চিন্তাদ্রোহী। আর যারা এভাবে অল্প বয়স থেকে চিন্তার সাথে বিদ্রোহ করে তারাই সমাধান পায়। আর তারাই পারে জীবনকে উচ্চ রাজ শিখরে সমর্পণ করতে।

টিপু রিডিং রুম থেকে বের হয়ে তাদের উঠানের পেয়ারা গাছটার নিকটে আসতেই তার চোখ গেল দেড় শ’ বছরের পুরনো ঝাউগাছটির মগডালের যে পাতাগুলো আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে- সে দিকে। ঠিক ওখানটাতে সে দেখতে পেল একটি তারা আকাশের কাল পর্দা চিড়ে বিদ্যুৎগতিতে বের হয়ে গেল। টিপু বিস্মিত হয়ে গেল। পরক্ষণে সে আবার নিস্পলকে অন্যান্য তারার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কই? এমন করে তো আর কোন তারা ছুট দেয় না। তার মনে অগণিত প্রশ্ন এসে ভিড় করে। অনেকক্ষণ ধরে কাটলো তার বিস্ময়ের খেলা। কিন্তু কোন সমাধান এসে টিপুকে শান্ত করতে পারলো না। সে দৌড় দিল রিডিং রুমে। ভূগোল বইটি নিয়ে একের পর এক পাতা উল্টিয়ে দেখতে লাগলো কিন্তু কিছুতেই কোন সমাধান মিললো না। টিপুর মন আরও চঞ্চল হয়ে উঠলো।

ওদিকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাইনিং রুম হতে তার মায়ের কণ্ঠ ভেসে এলোÑ কিন্তু টিপু একরোখা, কোন জটিল সমস্যা তাকে নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়ে দেয়। টিপু না গিয়ে একটু গরম স্বর ছুড়ে বলে দিলÑ

আমার ুধা লাগেনি, আমি এখন খাব না, বলেই বেড নিল। টিপুর এই গরম মেজাজ দেখে রাতের তন্দ্রা ও তার অক্ষিযুগল স্পর্শ করতে ভয় পেয়ে গেল। সে গভীরভাবে ভাবতে লাগলো। এ সম্পর্কে তার মায়ের কাছে কোন গল্প শুনেছে কি না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, টিপুর বয়স যখন সাত বছর তখন একদিন চৈত্রের রাতে সে তার বড় আপা শামিমার কাছে তারা সম্পর্কে একটা গল্প শুনেছিল।

টিপু গল্প শুনতে খুব ভালবাসে। গল্প বলার লোক পেলেই ব্যস নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। তার বড় আপা শামিমা বলেছিলÑআকাশে অনেক ধরনের তারা দেখা যায়। বলত টিপুমণি, যে তারাগুলো অসংখ্য তারার মধ্য থেকে হঠাৎ ছুটে বের হয়ে যায় তাদের কে কী বলে? টিপু সেদিন বলতে পারেনি। তার বড় আপা বলে দিয়েছিল ঐ তারাটিকে তারাখসা বলে। টিপু তার বড় আপার প্রশ্নটির উত্তর স্বনজরে দেখে নিল আজ। টিপুর আনন্দ আর ধরে না। এই আনন্দের মাঝে তাদের দেয়াল ঘড়িটাও যেন আনন্দে কিড়িং কিড়িং শব্দ দিয়ে শুনিয়ে দিল ঘণ্টাধ্বনি। টিপু পাশ ফিরে মাথা কিঞ্চিৎ উঁচু করে তাকিয়ে দেখে ১২টা বেজে গেছে। টিপু এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

সকাল বেলা কার ডাকে যেন টিপুর ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে সে। টিপু এখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ফার্স্ট বয়। ভাল ছাত্র হিসেবে স্কুলে খুব সুনাম কুড়িয়েছে সে। তেমনি দুষ্টুমিতেও টিপুর সুনাম কম যায় না।

টিপুর প্রাথমিক জীবন শেষ হয়ে গেছে। এই দুই মাস হল সে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। সামনে ফার্স্ট টার্মিনাল পরীক্ষা। টিপুর পাশাপাশি জুটেছে ঐ স্কুলেরই হেড মাস্টারের ছেলে রতন। কিন্তু টিপু তাতে বিন্দুমাত্র ঘাবড়ালো না। বরং সে আগের চেয়ে পড়াশোনায় আরও জোর দিয়েছে। ফার্স্ট টার্মিনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। টিপু প্রতিটা বিষয়ে ফার্স্ট হলো। বলা বাহুল্য, ঐ স্কুলেরই হেডমাস্টারের কাছে প্রতিটা শিক্ষক কেঁচোমনা। সুতরাং টিপুর বার্ষিক পরীক্ষার ফল দাঁড়ালো অন্য রকম। তখন টিপুর মন খারাপ হয়ে গেল। সে স্কুল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিল।

ছাড়পত্র নিয়ে টিপু ভর্তি হল শহরের এক নাম করা স্কুলে। শ্রেণীশিক্ষক নাম ডেকে চলেছেন। টিপু সবার পেছনে বসা। কিশোর টিপু সুঠাম দেহের অধিকারী। সুতরাং তার চেহারা অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। তিনি টিপুকে সামনের বেঞ্চে বসতে বললেন। অঙ্কের কাস। তার শ্রেণীশিক্ষক বীজগণিতের মান নির্ণয়ের একটা ফর্মুলার প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন করলেন। কিন্তু পুরাতন ছাত্র-ছাত্রীদের দেয়া উত্তরটি শিক্ষকের মনকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। কিন্তু টিপু যেহেতু নতুন, সেহেতু টিপুকে কোন প্রশ্ন করলেন না। নতুন হলেও আর বসে থাকতে পারলো না সে। শ্রেণীশিক্ষকের অনুমতি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এবং প্রশ্নটির একটা সঠিক সমাধান দিয়ে দিল। শিক্ষক খুশি হয়ে তাকে এক গাল প্রশংসা ছুড়ে দিলেন। দ্বিতীয় পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়ে গেল। শিক্ষক টিপুর দিকে এক পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই আচমন ভঙ্গিতে কাস ত্যাগ করলেন। পাছে টিপুর বন্ধুরা তাকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করতে লাগলো। সেদিনকার মত স্কুল ছুটি হয়ে গেল। টিপু স্কুল ছেড়ে রোড ধরলো। টিপুর মন আজ আর অন্য দিকে নেই। শুধু তার সেই অবিস্মরণীয় কাসটির কথা চিন্তা করতে করতে বাড়ি পৌঁছে গেল। রাতে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে সে। বারবার হৃদয়পটে, তার সহপাঠিদের কথা ভেসে উঠতে লাগলো। সে এর প্রতিশোধ নিতে চায়। দেখিয়ে দিতে চায়, সে তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

প্রথম দিনের মত দ্বিতীয় দিনও যথারীতি কাস চলছে। শ্রেণীশিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মাইক্রো টিচিং দেয়ার জন্য বোর্ডে ওয়ান বাই ওয়ান ডাকতে লাগলেন, কিন্তু কোন ছাত্র-ছাত্রীই টিপুর মত এত সুন্দর করে সাবলীলভাবে মাইক্রো টিচিং দিতে পারেনি। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে টিপুর নাম স্কুলের শ্রেণীশিক্ষক থেকে শুরু করে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর মুখে বৃষ্টি হওয়ার পর অতিরিক্ত জলের মত স্কুল কার্নিসে যেন থৈ থৈ করতে লাগলো। টিপুর আনন্দ আর ধরে না। যেন তার জীবনে ঘটে গেল এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ