পরিবেশ বাঁচলে আমরাও বাঁচবো

পরিবেশ বাঁচলে আমরাও বাঁচবো

প্রচ্ছদ রচনা জুন ২০১৩

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ এখন বাইরে যেওনা, পরিবেশ খুবই খারাপ।’ ‘ওদের মনোমালিন্যটা মিটবে কী করে? কথা বলারই তো কোনো পরিবেশ নেই।’ ‘পরিবেশের দোষে ছেলে-মেয়েগুলো এক্কেবারে নষ্ট হয়ে গেলো।’ এমন হাজারো কথায় উঠে আসে পরিবেশের প্রসঙ্গ। পরিবেশ শব্দটা যেনো আমাদের চলার পথে নিত্য সঙ্গী হয়ে থাকে। তাহলে এ সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়েই চিন্তা করা জরুরি নয় কি? আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। একটু চিন্তা করে দেখা যাক, কী আছে আমাদের চারপাশে? তুমি যদি ছাত্র হও এবং এখন পড়ার ঘরে থাকো, তাহলে তোমার চারপাশে কী কী আছে? চেয়ার টেবিল, বই-খাতা, কলম, ঘরের টুকিটাকি আসবাবপত্র ইত্যাদি। যখন তুমি স্কুলে থাকো তখন শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী বন্ধুরা, সিনিয়র জুনিয়র ভাইবোন, স্কুলঘর, খেলার মাঠ, গাছপালা, সবুজ ঘাস, খেলার উপকরণ, আরো কতো কী। তোমার বন্ধু রফিক। সে যদি রাখাল হয় এবং এ সময় মাঠে থাকে তাহলে উন্মুক্ত মাঠ, ফসলের ক্ষেত, সবুজ গাছ-গাছালি, গরু-ছাগল, ক্ষেত ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হাজার প্রজাতির জীব-জন্তু, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, নদী-পুকুর-ডোবায় অনেক প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ প্রভৃতি থাকবে তার চারপাশে। মূলত এসব নিয়েই আমাদের পরিবেশ। পরিবেশের উপাদান আমাদের বাঁচার জন্যে যা যা প্রয়োজন এর সবকিছু নিয়েই পরিবেশ। জীব-জড়, ছোট-বড়, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান, আল্লাহ তায়ালার সমস্ত সৃষ্টি নিয়েই আমাদের পরিবেশ। এটি অঞ্চল, দেশ, মহাদেশ, পৃথিবী, সব কিছু ছাপিয়ে গোটা সৃষ্টি জগৎ এবং তার স্রষ্টাকেও বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। আলোচনার সুবিধার্থে এটাকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি। যথা সজীব এবং অজীব। সজীব বলতে যাদের জীবন আছে যেমন, প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ। আর অজীব বলতে যাদের জীবন নেই, যেমন- মাটি, পানি, বায়ু প্রভৃতি। প্রাণিজগৎ যাদের প্রাণ আছে, তাদেরকেই প্রাণী বলা গেলেও গাছপালা কিন্তু এর আওতামুক্ত। এখানে প্রাণী বলতে মানুষ থেকে শুরু করে স্থলজ ও জলজ সব রকমের জীব-জন্তু ও কীটপতঙ্গ বুঝানো হচ্ছে। মানুষও কিন্তু প্রাণী। কী, অবাক হচ্ছো? হ্যাঁ, তবে এরা বাক ও বিবেকসম্পন্ন প্রাণী। বাক ও বিবেকের শক্তি দিয়ে  আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অন্যান্য প্রাণীর উপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের যোগ্যতা দিয়েছেন বলেই একে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়ে থাকে। আচ্ছা, তুমি কতগুলো প্রাণীর নাম জানো বলোতো? ঠিক আছে আমিও একটু সহযোগিতা করি। এই ধরো পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী। প্রথমে পশুর নামই বলা যাক। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাতি, ঘোড়া, গাধা, উট, দুম্বা, বাঘ, সিংহ, হরিণ, জিরাফ, জেব্রা, শিয়াল, কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, বেজি, সজারু, ক্যাঙ্গারু, কাঠবিড়ালী ইত্যাদি। বাকি পশুগুলোর নাম তুমি একটা একটা করে খাতায় লিখে নাও, দেখি কয়টা পারো! এখন পাখির নাম বলি। আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল। এছাড়াও টিয়ে, ময়না, ময়ুর, শালিক, মাছরাঙা, কবুতর, চড়–ই, বাবুই, পেঁচা, হাঁস, মুরগি, ঘুঘু, বুলবুলি, কাকাতুয়া, চিল, ঈগল, উটপাখি, সারস, বক, ডাহুক, বালিহাঁস, ফিঙে প্রভৃতি। কিছু কীট-পতঙ্গের নাম বলোতো দেখি? প্রজাপতি, ফড়িং, মশা, মাছি, জোনাকি, মাকড়শা, পিঁপীলিকা, মৌমাছি, তেলাপোকা, উইপোকা প্রভৃতি। জলজ প্রাণীর নাম বলতে পারো? হ্যাঁ, মাছ এর অন্যতম। রুই, কাতলা, মাগুর, শিং, কৈ, পুঁটি, ট্যাংরা, গুছি, শোল, গজার, টাকি, ইলিশ, রূপচান্দাসহ হাজারো প্রকারের মাছ। এছাড়া, কুমির, হাঙ্গর, ডলফিনসহ অনেক প্রজাতির জলজ প্রাণী আছে। এসব নিয়েই তৈরি হয়েছে প্রাণিজগৎ। বিশাল এই প্রাণিজগৎ সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্যই। এ বিশাল প্রাণিজগতের জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ। কথায় বলা হয়ে থাকে, বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। যে পরিবেশ যার জন্য প্রযোজ্য তার জন্যে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই বিপর্যয় নেমে আসে। আগেই বলেছি, মানুষও এক ধরনের প্রাণী। মানুষের বাঁচার জন্যে মৌলিক প্রয়োজন হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। অন্যান্য প্রাণীর জন্যে নিরাপদ খাদ্য ও বাসস্থান একান্ত জরুরি হলেও বস্ত্র, শিক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা জরুরি নয়। মাছেরা কি পোশাক পরে? তারা কি স্কুলে যায়? তবে হ্যাঁ, মানুষ যখন প্রাণিজগতকে তার নিজস্ব বলয় থেকে বের করে এনে অন্যান্য কাজেও লাগাতে চায় তখনি তাদের জন্যও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যেমন শিকারি কুকুর, পোষ মানানো পশু-পাখি ইত্যাদি। ওদের চিকিৎসাসেবারও প্রয়োজন হতো না যদি ওদের পরিবেশ যথাযথভাবে নিশ্চিত থাকতো। মানুষ নামক এ প্রাণীগুলো ওদের নিকট থেকে অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করতে গিয়েই ওদের পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে নানা রকমের রোগ বালাই সৃষ্টি হচ্ছে। আর তাই ওদের জন্যও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে চিকিৎসাসেবা। উদ্ভিদজগৎ আমাদের চারপাশে সবুজের যে সমারোহ, রঙবেরঙের ফুল-ফল আর বৈচিত্র্যময় ফসল তা সবই উদ্ভিদ হিসেবে পরিগণিত। এগুলো থেকেই প্রাণিজগতের খাদ্য প্রস্তুত হয়। এগুলোকে স্থলজ ও জলজ উদ্ভিদ, ফলজ ও বনজ উদ্ভিদ, সপুষ্পক ও অপুষ্পক উদ্ভিদ, একবীজপত্রী ও দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ প্রভৃতি নামে বিভাজন করা যায়। তবে যেভাবেই বিভাজিত করা হোক না কেন সকল উদ্ভিদই প্রাণীর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি শ্রেষ্ঠ উপহার। এ উদ্ভিদ আমাদের ফল, ফুল, শস্য, কাঠ, ঔষধসহ জীবন ধারনের সব উপকরণ সরবরাহ করে থাকে। আমরা যে সব ফল মজা করে খাই, তার দু’চারটির নাম বলোতো? আম, জাম, লিচু, কলা, আনারস, পেপে, পেয়ারা, আতা, কাঁঠাল, নারকেল, তাল, তরমুজ, আমড়া, জামরুল, কামরাঙা, বেল, ডালিম, জলপাই, বরই প্রভৃতি। ফুলের মধ্যে গোলাপ, জবা, জুঁই, চামেলী, হাসনাহেনা, টগর, বেলী, শিউলী প্রভৃতি। শস্যের মধ্যে রয়েছে ধান, গম, পাট, ডাল, সরিষা প্রভৃতি। এছাড়া অবশিষ্ট উদ্ভিদ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় ঔষধ, সবজি এবং আসবাবপত্রসহ জীবন ধারনের সব ধরনের উপাদান পেয়ে থাকি। জল ও স্থলের এ সব উদ্ভিদই মূলত পরিবেশের প্রাণ। উদ্ভিদ না থাকলে প্রাণীর অস্তিত্বই শুধু বিলুপ্ত হবে না বরং এ সৃষ্টি জগতের ধ্বংস নিশ্চিত হবে। এ জন্য উদ্ভিদ রোপন ও পরিচর্যাকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে অন্যতম প্রধান কাজ ও ইবাদতের মধ্যে গণ্য করেছেন। তোমরা কি জানো, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ভীষণ উদ্ভিদপ্রেমিক ছিলেন! তিনি গাছ লাগানোকে খুব পছন্দ করতেন। নিজে গাছ লাগাতেন এবং পরিচর্যা করতেন। যুদ্ধের মহাধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও তিনি গাছকাটা পছন্দ করতেন না। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আনাস (রা) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে, মহানবী (সা) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি গাছের চারা লাগায় অথবা কোনো বীজ বপন করে, অতঃপর সেই গাছ ও ফসল দ্বারা কোনো মানুষ উপকৃত হয় কিংবা কোনো পশু পাখি ভক্ষণ করে, এর বিনিময়ে তার আমলনামায় সদকার সওয়াব লিখিত হয়।’ অন্য হাদিসে মহানবী (সা) বলেন, ‘তোমরা যদি দুনিয়াতে একটি ফলবান গাছ রোপন করে তার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ করো, তাহলে তোমাদের দ্বারা জান্নাতে একটি ফলবান বৃক্ষ রোপন ও রক্ষণাবেক্ষণের সমতুল্য হবে।’ মহানবী (সা)-এর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তার মাধ্যমে শুধু দুনিয়ার পরিবেশই সংরক্ষিত হবে না বরং অনন্ত জীবনের পরম সুখের জন্য জান্নাত লাভেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে সাদকায়ে যারিয়াহ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। তোমরা কি জানো, সাদকায়ে যারিয়াহ কী? এটা হলো সওয়াবের চলমান প্রক্রিয়া, যা মানুষের মৃত্যুর পরেও চলতে থাকে। দৃশ্যমান উপকার ছাড়াও প্রাণী জগতের জন্যে হাজারো উপায়ে সহযোগিতা করে উদ্ভিদ। আমরা যে নিঃশ্বাস ছাড়ি, তা কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভর্তি। এটা প্রাণী জগতের জন্য ভীষণ মারত্মক। উদ্ভিদরা এ বিষাক্ত জিনিস গ্রহণ করে আমাদের জন্য অক্সিজেন তৈরি করে দেয়। এ অক্সিজেন না হলে আমরা কেউই বাঁচতে পারবো না। এছাড়া ঝড় ঝাপটাসহ নানা রকমের দুর্যোগে উদ্ভিদ আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে। ফলজ গাছ তো বটেই, একটি ছোট্ট উদ্ভিদেরও গুরুত্ব নিরূপণ করা কঠিন। উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, একটি ছোট গাছ তার জীবদ্দশায় প্রাণী জগত ও পরিবেশের জন্যে যে উপকার করে তার ন্যূনতম মূল্য প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। কিন্তু মানুষই আজ উদ্ভিদের জীবনচক্রের বড় শত্র“। উদ্ভিদের প্রতি যতœবান হওয়া তো দূরের কথা আমরা নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে চলেছি। বনাঞ্চল সাবাড় হচ্ছে লোভী বনকর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আর গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন জঙ্গলাপূর্ণ এলাকা এখন খা খা মরুর মতো পড়ে আছে। ফলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে গ্রামীণ ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা পশু-পাখিসহ জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে মারত্মকভাবে। মাটি প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য মাটি অন্যতম প্রধান ও প্রয়োজনীয় বিষয়। মাটির সুস্থতার উপরই পরিবেশের বাঁচা মরা নির্ভর করে। পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মাত্র স্থলভাগ। এর মধ্যে বিশাল অংশ জুড়ে আছে জীববৈচিত্র্যের আড়ালে অর্থাৎ বাসযোগ্য ও উদ্ভিদ উৎপাদনযোগ্য মাটির বাইরে। জীববৈচিত্র্য বসবাসযোগ্য মাটিকে সাধারণভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এঁটেল, বেলে ও দোআঁশ। কঠিন শিলাসম্পন্ন ভূমি ও পাহাড়সমূহকেও স্থলভাগের অনন্য স্থান হিসেবে ধরে নেয়া হয়। স্থলজ প্রাণীর জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় উপাদানের অধিকাংশ আসে মাটির বুক থেকে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য তাই মাটির পরিবেশ রক্ষা করা অতীব জরুরি বিষয়। কিন্তু মানুষ বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সুযোগ নিয়ে মাটিকে তার স্বকীয় অস্তিত্বে ধারণ করে রাখতে বাধাগ্রস্থ করছে। বিশেষ করে অপচনশীল অজৈব বর্জ্য, যেমন পলিথিন জাতীয় পদার্থ, কাপড়-চোপড়, কাঁচের দ্রব্য, প্লাস্টিক দ্রব্য, ধাতব পদার্থ, কৃষি বা গৃহস্থলিতে ব্যবহার্য নানাবিধ উপকরণ ও কীটনাশক সার, ব্যাটারি জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ, কলকারখানা থেকে নির্গত ও পরিত্যক্ত কঠিন, তরল কিংবা দানাদার অপদ্রব্য প্রভৃতি দূষিতবর্জ্য মাটিকে চরমভাবে দূষিত করছে। এ সব বিষাক্ত ছোবলের পরিণতি খুবই ভয়াবহ। এগুলোর অনেকটাই বিশ-ত্রিশ বছরেও পঁচে না। আবার পচনশীল দ্রব্যাদিরও বিষাক্ত ছোঁয়া দীর্ঘ দিনেও নষ্ট হয় না। এ সব কিছুই মাটির জীবনীশক্তিকে নষ্ট করে সকল ধরনের উৎপাদন ক্ষমতা নিঃশেষ করে দেয়। মূলত এখন বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার অধিকাংশ প্রক্রিয়া মাটির প্রধান শত্র“ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অতিলোভে পাহাড় কেটে কেটে বসতি ও কলকারখানা স্থাপন স্থলভাগের জন্য মারাত্মক হুমকি ডেকে আনছে। পানি শুধু প্রাণীর বাঁচার জন্যে নয়, পরিবেশ বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে থাকে পানি। এ জন্য বলা হয়, পানির অপর নাম জীবন। সৃষ্টিগতথভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা এ পৃথিবীতে শতকরা ৭১ ভাগ পানি সৃষ্টি করেছেন। মানব শরীরেও শতকরা ৬৫ ভাগ পানি রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে শতকরা ৯৭.৪ ভাগ পানি রয়েছে সাগরে। পানিও আবার দুভাগে বিভক্ত। লোনা পানি ও মিঠা পানি। লোনা পানি কি পান করা যায়? যায় না। শুধুমাত্র পানের জন্যই নয়, ফসল ফলানো থেকে শুরু করে কলকারখানা পরিচালনার জন্যেও মিঠে পানির দরকার হয়। অথচ মিঠে পানির পরিমাণ মাত্র ২.৬ শতাংশ। তাও আবার এর শতকরা ৯৮ ভাগ রয়েছে জমাটবাধা বরফ অবস্থায়। সেটা কি সব সময় ব্যবহার করা যাচ্ছে? না, যখন বরফ গলে প্রবাহিত হয়ে আমাদের কাছে আসছে তখনি কেবল আমরা সেটা ব্যবহার করি। তরল মিঠে পানির এ স্বল্প মজুদ থেকেই আমরা কৃষিকাজে সেচের জন্য ব্যবহার করি প্রায় ৭৩ শতাংশ। অবশিষ্ট পানি থেকে আমরা পাই হাজারো প্রজাতির মিঠে পানির মাছ। মাছ উৎপাদনের এ খামারগুলোও আমাদের সর্বনাশা থাবায় দূষিত হয়ে মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। অতএব বুঝতেই পারছো, মিঠে পানি আমাদের কতটা জরুরি। এ পানিকে কি দূষিত হতে দেয়া যায়? সামুদ্রিক নোনা জল পানীয় উপযোগী না হলেও প্রাণী ও উদ্ভিদ তথা পরিবেশের জন্য এক অফুরন্ত নেয়ামত। সামুদ্রিক মাছ, অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ পরিবেশ রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশের মাছ সম্পদের অন্যতম হচ্ছে চিংড়ি। সাগর ছাড়াও দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঘেরসমূহে এর ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে। হ্যাচারির মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে এর পোনা সংগ্রহের জন্য উপকূলীয় এলাকায় অসংখ্য মাছ শ্রমিক কাজ করে। তারা বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করতে গিয়ে অতিমূল্যবান অসংখ্য প্রজাতির পানীয় প্রাণী ডাঙ্গায় ফেলে হত্যা করে থাকে। ফলে তারা একটি পোনা ধরতে গিয়ে চাপদা, বাগতারা, ডিমুয়া, রশনাই, ছটকাসহ প্রায় ৩৮ প্রজাতির চিংড়ি; পারশে, ভেটকি, ভাঙনসহ ৬ প্রজাতির মাছ এবং এসিটেস, মাইসিড, মেগালোপা, কপপিডসহ প্রায় একশো প্রজাতির পানীয় প্রাণী হত্য করে ফেলে। তাই এ বিষয়েও আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। পানি আমাদের অপরিহার্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হলেও বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার দোহাই দিয়ে মিঠে পানিসহ সাগরের নোনা পানিও দূষিত করে ফেলছি। কলকারখানার বর্জ্য, অসর্তক পয়নিষ্কাষন ব্যবস্থা, ফসলের ক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহৃত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে পুকুর, নদী-নালাতে মেশা, বিভিন্ন জলাশয়ে ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ এবং আবদ্ধ পানিতে গবাদি পশুর গোসলসহ বিভিন্ন অসাবধান প্রক্রিয়ায় গ্রাম ও শহরাঞ্চলের পাশাপাশি সাগরের পানিও দূষিত হচ্ছে। আর পানি দূষণে শুধু জীববৈচিত্র্যই নষ্ট হয় না বরং মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর রোগ বালাইয়ের শতকরা ৮০ ভাগ আসে এ দূষিত পানি ব্যবহার জনিত কারণে। সুতরাং সময় থাকতেই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। বায়ু ‘চোখে দেখা যায় না, না থাকলে চলে না’ সেটা কী বলোতো! হ্যাঁ সেটা হলো বাতাস বা বায়ু। বিশুদ্ধ বায়ু পরিবেশের আত্মা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বায়ুতে সাধারণত ২১ ভাগ অক্সিজেন, ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন, .০৩১ ভাগ কার্বন ডাই-অক্সাইড, একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে ওজোন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি থাকে। যদি কোনো কারণে বাতাসে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে অন্যান্য গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায় অথবা বালিকণার ভাগ বেড়ে যায় তবে তাকে দূষিত বায়ু বলা হয়ে থাকে। আগুন থেকেই বায়ু দূষণের সূত্রপাত। আগুন অক্সিজেন খেয়ে ফেলে। বিশেষ করে যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোয়া বাতাসকে ব্যাপকভাবে দূষিত করে। সেইসাথে ট্যানারী, এসিড, হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া প্রভৃতি কেমিক্যাল থেকে সৃষ্ট বিষক্রিয়ার দ্বারাও বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। আধুনিকবিশ্বে যুদ্ধবিগ্রহ বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। গোলাবারুদ, বোমাসহ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ফলে যে মারাত্মক গ্রিনহাউজ গ্যাসের উৎপন্ন হয় তাতে তাৎক্ষণিক ক্ষতির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিও অনেক। হিরোশিমা নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ থেকে শুরু করে আধুনিক সকল যুদ্ধবিগ্রহসহ বিশ্বব্যাপী শক্তির মহড়ার মাধ্যমে উৎপন্ন কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সীসাসহ মারাত্মক বিষাক্ত গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে নভোমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের ঘটনায় মানব সভ্যতা শুধু নয় গোটা প্রাণিজগত ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। মানুষের ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুস ক্যান্সার, হার্টসমস্যা, ব্রেইন, নার্ভ, লিভার ও কিডনি সমস্যা তৈরি হয় এ বায়ু দূষণ থেকেই। সেইসাথে বায়ু দূষণে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা তৈরি হচ্ছে তার ফলে বাংলাদেশকে মাসুল গুণতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বাতাসের মাধ্যমেই ভেসে আসে শব্দ। অতিরিক্ত শব্দই শব্দদূষণ। প্রতিনিয়ত মোটর গাড়ির হর্ন, কলকারখানার বিকট আওয়াজ, বাজি পটকার শব্দ, রেডিও টেলিভিশনের শব্দ, লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি, উৎসবের মত্ততা, মাইকের কড়া শব্দ প্রভৃতির মাধ্যমে শব্দদূষণ ছড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহৃত সাউণ্ড গ্রেনেডও শব্দ দূষণের ভয়াবহতা তৈরি করছে। শব্দ দূষণ শুধুমাত্র বাহ্যিক বিরক্তিই সৃষ্টি করে না বরং মানব দেহের আর্টারিগুলো বন্ধ করে দেয়, এড্রনালিনের চলাচল বৃদ্ধি করে এবং  হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়। ধারাবাহিক শব্দদূষণ হার্টঅ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আজকাল শব্দদূষণ ঠেকানোর ভঙ্গিতে মোবাইলে বা ইয়ার ফোনের মাধ্যমে গান শুনতে দেখা যায় অহরহ। শিশুরাও দিনমান কাটিয়ে দেয় টেলিভিশন, ভিডিও গেমস কিংবা কার্টুনের মজায়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড তাদের জীবনের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। এগুলো শ্রবণশক্তি নষ্ট করা থেকে শুরু করে স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতিসাধন, হার্ট-কিডনি ও ব্রেনের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মেজাজ ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। তাই এসব ব্যাপারেও সতর্ক হওয়া একান্তভাবে দরকার। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা এখন সকলেরই জানা। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা ও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আমরা পরিবেশের সাথে যে নিষ্ঠুর আচরণ করে যাচ্ছি পৃথিবী যেন তার বদলা নিতে ভুলছে না। অগ্নুৎপাতের বিপর্যয় ও জলবায়ুর তীব্র পরিবর্তন, সিডর, টর্নেডো, ঝড়, বন্যা, খরা, এসিড বৃষ্টি, ভূমিধস, পাহাড়ধস ও দাবদাহসহ বিভিন্ন রকমের ভয়াবহতা বিশ্বকে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। পরিবেশ আমাদের, আমরাও পরিবেশের। তাই পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বড় বড় সমস্যাগুলো সমাধানে যেমন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা চিন্তাভাবনা করবেন তেমনি আমরাও আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারি। কেননা আমরা প্রত্যেকেই পরিবেশের এক একজন সদস্য। তাই আমরা পরিবেশ সংরক্ষণে সুবিধাজনক ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগাবো, পলিথিন-প্লাস্টিকসহ অপচনযোগ্য জিনিসের ব্যবহার রোধ করার চেষ্টাসহ সেগুলো যেখানে সেখানে যাতে কেউ না ফেলে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবো। ধূমপানসহ ক্ষতিকারক ধোঁয়া থেকে বাতাসকে রক্ষা করবো। শব্দদূষণ তৈরি হয় এমন কাজ থেকে দূরে থাকবো। ইয়ার ফোনে গান শোনা, দীর্ঘসময় ধরে ভিডিও গেমস খেলা এবং বেশি সময় ধরে টেলিভিশন দেখা থেকে দূরে থাকবো। কি বন্ধুরা, পারবো না? হ্যাঁ, আমাদেরকে যে পারতেই হবে। কারণ পরিবেশ আমাদের; পরিবেশ বাঁচলে আমরাও বাঁচবো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ