পহেলা বৈশাখ   -মামুন মাহফুজ

পহেলা বৈশাখ -মামুন মাহফুজ

বিশেষ রচনা এপ্রিল ২০২০



পহেলা বৈশাখ শুধু বাংলাদেশের নয় বাঙালির ঐতিহ্য। এই উৎসবটি শত শত বছর ধরে বাঙালি উদযাপন করে আসছে নিজেদের মতো করেই। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো পহেলা বৈশাখ এমন এক উৎসব যা হিন্দু মুসলিম সব ধর্মের মানুষই তাদের মতো করে পালন করে থাকে।
পহেলা বৈশাখের ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায়, এটি আগে আর্তব উৎসব নামে পালিত হতো। যার অর্থ হচ্ছে ঋতুর উৎসব বা ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব। এরপর সম্রাট আকবরের আমলে এটি পহেলা বৈশাখ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই সন গণনা কার্যকর করা হয় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। কারণ ওই দিনটি ছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিন।
বর্তমানে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে নানান ধরনের আয়োজন লক্ষণীয়। তবে প্রাচীনকালে পহেলা বৈশাখ বিশেষভাবেই ছিল ফসলের উৎসব হিসেবে। এমনকি এই পহেলা বৈশাখ কিন্তু কেবল আনন্দ বা উৎসবের জন্য প্রবর্তিত হয়নি। বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, কর্মজীবী মানুষের অনেক গল্প।
গল্পটা আমাদের সবারই জানা উচিত। আমরাতো সবাই জানি যে এই ভারতীয় উপমহাদেশে যে মুঘল শাসকরা ছিলেন তারা কিন্তু খাজনা আদায়ের মাধ্যমেই সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু মুঘল আমলে এই খাজনা আদায়ের কাজটি ছিল হিজরি মাস অনুযায়ী। কিন্তু হিজরি মাস চন্দ্রবর্ষ বা চাঁদের সাথে স¤পৃক্ত হওয়ায় খাজনা আদায়ে অনেক জটিলতা তৈরি হতো। চন্দ্রবর্ষ ৩৫৪ দিনের, আর খ্রিষ্টবর্ষ হলো ৩৬৫ দিনের। অর্থাৎ চন্দ্রবর্ষ ১১ দিন কম। ফলে এ বছর যে তারিখে খাজনা আদায় করা হতো পরের বছরে তা এগারো দিন এগিয়ে আসতো। এভাবে তিন বছর পর একমাস এগিয়ে যেত। অথচ কৃষিজীবী মানুষের ফসলের মৌসুম কিন্তু এগিয়ে আসে না। ফলে তাদের খাজনা দিতে সমস্যা হতো। এই সমস্যার কথা বিবেচনা করে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আর বাংলা সনের প্রথম মাস হলো বৈশাখ এবং পহেলা বৈশাখ হলো বাংলা সনের প্রথম দিন। অর্থাৎ গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি বা খ্রিস্টবর্ষের প্রথম দিন যেমন জানুয়ারির প্রথম দিন, তেমনি বাংলা সনের প্রথম দিন হচ্ছে পহেলা বৈশাখ।
বাংলা সন সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমরাতো জানিই মুঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকে এটি শুরু হয়। কিন্তু সম্রাট আকবর মূলত কৃষিকাজ ও রাজস্ব আদায়ে সামঞ্জস্য আনার জন্য প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার করার নির্দেশ দেন। অতঃপর সম্রাটের আদেশে রাজ-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজি সৌরবর্ষ এবং হিজরিবর্ষ দুটোকে ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
অনেকেই মনে করে থাকে যে বাংলা সন বোধ হয় হিন্দুধর্মের আবিষ্কার বা হিন্দুদের আবিষ্কার, এমনকি কোনও কোনও ঐতিহাসিক দাবিও করেন এটি সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্কের প্রবর্তিত। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত হচ্ছে ১৪ এপ্রিল থেকে যে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা সন গণনা হয়ে আসছে তা সম্রাট আকবরের আমলে শুরু এবং তার রাজ-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজির গবেষণার ফল এবং পহেলা বৈশাখ পালন কোনও হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিও নয়। এটি সব ধর্মের মানুষই তাদের মতো করে পালন করে আসছে। বিশেষ করে কৃষিকাজের সাথে স¤পৃক্ত মানুষেরা এই বঙ্গাব্দকেই তাদের ফসল কাটার, বা খাজনা দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিল।
চৈত্রসংক্রান্তি বা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে ফসলের খাজনা আদায় করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল। তারপর পহেলা বৈশাখ খাজনা আদায়ের পর রাজা বা জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। সেই থেকে পহেলা বৈশাখ একটি উৎসব হয়ে ওঠে বাঙালির জন্য। কারণ একদিকে খাজনা আদায় শেষ অন্যদিকে নতুন ফসলের নতুন ঘ্রাণ। সবার মুখেই ফুটতো সুখের এবং স্বস্তির হাসি। পহেলা বৈশাখ শুধু বাংলাদেশের মানুষের উৎসব নয় বরং এটি আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরার বাঙালিদের উৎসব।
প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি বাঙালির এই ঐতিহ্যবাহী পহেলা বৈশাখেরও অনেক ব্যাপ্তি এবং বিকৃতি ঘটেছে। বাংলাদেশের মানুষ এই উৎসবকে আজ প্রাচীন ঐতিহ্যের বেলাভূমি থেকে সরিয়ে নতুন কিছু সংস্কৃতির যোগ ঘটিয়েছে। এখন গ্রামের মানুষ আর শহুরে মানুষ অনেকটাই আলাদাভাবে, আলাদা আলাদা আয়োজনে পালন করে দিনটি। গ্রামের মানুষ প্রতিদিনের মত খুব ভোরে উঠে নতুন জামাকাপড় পরে পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যায়, নিজের ঘরদোর পরিষ্কার করে, বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করে, আবার কয়েক গ্রামের মানুষ একত্র হয়ে আয়োজন করে গ্রামীণ মেলার।


এর নাম বৈশাখী মেলা। মেলায় নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষ অংশ নেয়। খেলনা কেনে, চরকিতে ঘোরে। দিনটি শিশুদের জন্য বিশেষ আনন্দের।
এছাড়া পহেলা বৈশাখকে ঘিরে আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচ খেলা, লাঠিখেলা, কুস্তিখেলা, জব্বারের বলিখেলাসহ নানান ধরনের গ্রামীণ খেলার। অন্য দিকে শহরের মানুষ অন্যদিন ভোরে না উঠলেও এই দিন খুব ভোরে ওঠে পান্তা ভাত খায়, কেউ আলু ভর্তা, শুকনা মরিচ দিয়ে, কেউবা ইলিশ মাছ দিয়ে। আর এই সুযোগে কিছু ব্যবসায়ী ইলিশ মাছের দাম হাঁকায়। পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে দিনটি পালিত হয়। সেখানে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মানুষেরা একত্র হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গে বলতে গেলে পুরো চৈত্রমাসজুড়েই নানান অনুষ্ঠানাদি হয়ে থাকে। এরপর হয় চৈত্রসংক্রান্তি। অর্থাৎ চৈত্রমাসের শেষ দিন গাজন উৎসব করে তারা। এই দিন চড়ক পূজা ও চড়ক মেলার আয়োজন করে থাকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তারা এটিকে ধর্মীয় উৎসবে রূপ দিয়ে থাকে। তবে প্রাচীন বাংলায় পহেলা বৈশাখ উৎসবের প্রধান আয়োজন ছিল হালখাতাকে কেন্দ্র করে। এখন সেটা অনেকটাই বিলুপ্তপ্রায়। এই হালখাতা করাটাকেও অনেকে মনে করে থাকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি। অথচ জেনে অবাক হতে হয় যে হালখাতা দুটি আরবি শব্দের সমষ্টি। হাল এবং খাতা। হাল যে আরবি শব্দ তাতো সবাই কমবেশি জানে, সৌদি আরবে কেমন আছ? এটাকে বলা হয় কাইফা হালুকা, অর্থাৎ তোমার বর্তমান অবস্থা কী? আবার আমরা বলে থাকি হালনাগাদ করা। যেমন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। এর অর্থও ভোটার তালিকা নতুন করে করা বা ইংরেজিতে বলা যায় আপডেট করা। আর খাতা শব্দের অর্থ হিসাবের বই। লালমলাটের মোটা মোটা হিসাবের বই হয়তো এখনও দেখে থাকবে। এসব খাতা পহেলা বৈশাখের উৎসবে নতুন করে খোলা হতো। পুরনো বছরের সমস্ত পাওনাদি শোধ করে নতুন খাতা খুলতো হিসাবের। আর এই আয়োজনটি ছিল পহেলা বৈশাখ উৎসবের অন্যতম আনন্দের অনুষঙ্গ।
হালখাতা করা হতো ব্যবসায়ী বা দোকানিদের সাথে ক্রেতাসাধারণের সুন্দর একটা স¤পর্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে। বছরজুড়েও যারা ব্যবসায়ীদের পাওনা শোধ করতে পারতো না তারা হালখাতার দিনে সমুদয় পাওনা পরিশোধ করে দিত। আর দোকানি বা ব্যবসায়ীরাও পাওনা টাকা পরিশোধকারীকে মিষ্টিমুখ করিয়ে কৃতজ্ঞতা আদায় করতো। দোকানি হালখাতা উপলক্ষে খুব সুন্দর সুন্দর কার্ড করতো, চিঠি করতো, চিঠির ওপরে মুসলমানরা লিখতো এলাহি ভরসা বা আল্লাহ ভরসা আর হিন্দুরা লিখতো শ্রী শ্রী সিদ্ধিদাতা গণেশায় নমঃ। দোকানিরা দোকানের সামনে মাটি খুঁড়ে ইটের চুলা বসিয়ে দিনভর জিলাপি ভাজতো আর সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতো। এই যে ঋণশোধের সংস্কৃতি এটাই কিন্তু ইসলামের শিক্ষা। কারণ ইসলাম ধর্মে আমরা জানি সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করলেও আল্লাহ কোনও ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা গেলে তা ক্ষমা করেন না। ঋণ পরিশোধ ইসলামের ফরজ ইবাদত। আর সেই ফরজ আদায়ের পর তাকে মিষ্টিমুখ করিয়ে বুকে টেনে নেয়া, আপ্যায়ন করা এটাও ইসলামের সুমহান শিক্ষা। ঋণগ্রস্ত বক্তিকে সুযোগ দেওয়া, তার প্রতি দুর্ব্যবহার না করা, উল্টো তাকে মিষ্টিমুখ করানো অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি সামাজিক শিক্ষা। আর এই সংস্কৃতিই চর্চা হতো পহেলা বৈশাখকে ঘিরে।
যদিও আজ পহেলা বৈশাখ খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে শহুরে মানুষেরা অন্য মানুষকে বিরক্ত করে পালন করে থাকে। অথচ এই দিনটি ছিল মানুষকে আপন করে নেয়ার দিন, বন্ধুত্বের দিন, ঋণ পরিশোধের দিন।
আমরা আমাদের এমন গৌরবের দিনটি ভুলে এখন প্যাঁ পোঁ প্যাঁ পোঁ করে একে অপরকে বিরক্ত করে উৎসব পালন করে থাকি। এটি মোটেও কাম্য নয়। পহেলা বৈশাখ তার আপন মহিমায় ফিরে আসুক, ফিরে আসুক হালখাতার মতো সুন্দর সামাজিক ঋণপরিশোধের সংস্কৃতি, একে অপরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ভ্রাতৃত্ববন্ধনকে দৃঢ় করার সংস্কৃতি। তাতে আমাদের সামাজিক স¤পর্কগুলো যেমন সুদৃঢ় হবে, তেমনি বছরের এই দিনটিতে সকল পাওনা উদ্ধারের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরাও হবেন লাভবান, আর আমাদের দেশের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে দারুণভাবে। এই কামনায় সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ!
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ