পাখি শিকার

পাখি শিকার

গল্প মে ২০১২

আলমগীর হোসেন ফারুক..

সূর্যটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। রক্তিম আলোয় শাহিনের মুখটা কিছুটা রাঙা। হাতে রাখা গুলতিটা নড়াচড়া করতে ভালোই লাগে তার। সাইকেলের বলটিউব দিয়ে বানানো এই গুলতি দিয়ে আজ পর্যন্ত সে অনেক পাখি শিকার করেছে। তার মধ্যে বেশির ভাগই কোয়েল আর বক। মাছরাঙাও রয়েছে কয়েকটা। সবাই বলে তার হাতে নাকি জাদু আছে। কিন্তু সে জাদুতে বিশ্বাসী নয়। বিশ্বাসী কেবল পরিশ্রমে। আর এই সফলতার একমাত্র সঙ্গী তার প্রিয় বন্ধু জনি।
জনি সবার চেয়ে একদম আলাদা, এটা শাহিনের বিশ্বাস। কেননা অন্য আট-দশটা ছেলের মতো জনি নয়। অবশ্য জনি নিজেও জানে না সে কিসে ব্যতিক্রম। একমাত্র শাহিনই তাকে ব্যতিক্রমী ছেলে বলে ডাকে। শাহিনের পাখি শিকারের একমাত্র সঙ্গী জনি আজ নেই। দ্বিতীয় কাউকে পেলে শাহিনের ভালো হতো। কিন্তু শাহিন মনের মত কাউকে খুঁজে পেল না। তাই সে গুলতি নাড়তে নাড়তেই ভাবতে লাগলো কী করা যায়। বুলেট হিসেবে তার কাছে রয়েছে অনেক মার্বেল। সে মার্বেলগুলো গুনে দেখল। ৬০টা মার্বেল রয়েছে। আজকে এইগুলো দিয়ে চালানো যাবে। বর্তমানে সবকিছুর মত মার্বেলের দামও চড়া। এক টাকায় ৬টা। মানে ১০ টাকা পুঁজি। অবশ্য একটা শিকার করতে পারলেই দাম উঠে যাবে ভাবল শাহিন। সজীবকে আসতে দেখে শাহিন কিছুটা আনন্দিত। কারণ সজীব কথা শোনার মত ছেলে। সজীবের মুখে হাসিÑ ভাইয়া, আজ পাখি শিকার করবেন না?
ভাবছি ভালো সঙ্গী হিসেবে কাকে নেয়া যায়।
আমি যাবো আপনার সাথে।
তুই যাবি? আসিসট্যান্ট হিসেবে মানাচ্ছে না।
সজীবের মুখটা কালো হয়ে যায়। তা লক্ষ করে শাহিন বলল, তোকে নিতে পারি এক শর্তে। বেশি পাকামি করতে যাবি না।
আচ্ছা, যাবো না।
সজীবের মুখে আনন্দের ঝিলিক। শাহিন সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সজীবের হাতে দিয়ে বলল, চল।
সজীব সুবোধ বালকের মত শাহিনের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল যে করেই হোক এই মহান কর্ম তাকে রপ্ত করতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে তারা নেওয়াজের ডগিতে এসে পৌঁছালো। এই ডগির মাঝখানে রয়েছে বিশাল পুকুর। এই পুকুরকে বুড়ির পুকুর বলে লোকজন ডাকে। পুকুরের চারপাশে রয়েছে অনেক ধরনের গাছ। আর এই সকল গাছে বসে হরেক রকমের পাখি। পাখির উদ্দেশ্য হচ্ছে পুকুর থেকে মাছ খাওয়া আর গাছের পোকামাকড়। অবশ্য এই পুকুরটাকে পাখিদের মিলনমেলা বললেও ভুল হবে না।
শাহিন সন্তর্পণে এগোতে থাকল। তার পিছু পিছু সজীব। সামনে একটা খেঁজুরগাছ। তার মাথায় রসের হাঁড়ি ঝুলছে। একটা পাখি হাঁড়ির ওপর বসে মনের সুখে খেঁজুরের রস খাচ্ছে। শাহিন ধীরে ধীরে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। সজীবকে ঝোপের ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখল যাতে পাখির কানে কোনো শব্দ না যায়। শাহিন তার গুলতিটাকে উঁচু করে আস্তে আস্তে টানতে লাগল। চোখ ট্যারা করে পাখিটাকে নিশানা করল। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিল। মার্বেল গিয়ে আঘাত করল রসের হাঁড়ি। সাথে সাথে পাখিটি উড়াল দিল। রস পড়ে শাহিনের জামা ভিজে গেল। আর তা দেখে সজীব হাসতে হাসতে ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এল। শাহিন একটু লজ্জা পেল। সে তার লজ্জাকে ঢাকার জন্য সজীবকে ধমক দিয়ে বলল, তুই একটা কুফা, তোকে আনাটাই উচিত হয়নি।
নিমিষেই সজীবের হাসি ম্লান হয়ে গেল। শাহিন আরেকটা মার্বেল নিয়ে আগের মত ধীর পায়ে এগোতে থাকল। মন খারাপ করে সজীবও তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। আবার আনন্দ লাগল এই ভেবে যে গুরুর ধমক খাওয়া কোনো লজ্জার ব্যাপার না। ধমক না খেলে শিখবে কী করে? শাহিন তার নিজস্ব ভাবনায় এগিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে সজীবের দিকে দু-একবার তাকাচ্ছে। এতে সজীবের খুব গর্ববোধ হচ্ছে। যত কিছুই হোক তারও গুরুত্ব রয়েছে এখানে। শাহিন জামগাছের দিকে হাঁটতে লাগল কারণ জামগাছে একটা কোয়েল বসে আছে। শাহিন দ্রুত গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল। আর সজীবকে চুপ থাকার জন্য নির্দেশ দিল। সজীবও কথামত চুপ থাকল। শাহিন কোয়েলকে লক্ষ্য করে মার্বেল ছুড়ল। কিন্তু একটুর জন্য পাখির গায়ে লাগল না। শাহিন দাঁতে দাঁত ঘষলো। ইশ, একটুর জন্য পারলাম না!
পাখিটি উড়াল না দিয়ে একটু নড়ে উঠল। বেচারা হয়তো বুঝতে পারল না কী ঘটতে যাচ্ছে। শাহিন দ্রুত গুলতিটাকে তৈরি করল। আবারও কোয়েলকে উদ্দেশ করে মার্বেল ছুড়ল। এবার কোয়েলের পালকের মধ্যে পড়ল। কোয়েল উড়াল দিয়ে তার প্রাণ বাঁচালো। শাহিন আবারও দাঁতে দাঁত ঘষলো। পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতার মধ্যে থাকে অন্যরকম ভালো লাগা, অনরকম আনন্দ। শাহিন আবারও একটা মার্বেল হাতে নিলো। ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখল। গুলতির মধ্যে এটাকে সঠিকভাবে স্থাপন করল। সামনে একটা কড়ইগাছ। গাছটা অনেক বড়। কড়ইগাছের মগডালে বসে আছে একটা মাছরাঙা। অবশ্য মাছরাঙা বেশি বড় নয়, মাঝারি ধরনের। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। এত দূরে যে মার্বেল মাছরাঙাটির গায়ে পড়া মুশকিল। তবুও সে আশা ছাড়তে নারাজ। মাছরাঙাটিকে মারার জন্য সবরকম প্রস্তুতি সে শেষ করল। এবার মাছরাঙাটিকে লক্ষ্য করে মার্বেল ছুড়ল। এবার সে সফল হলো। মার্বেলটি একেবারেই মাছরাঙার বুকে গিয়ে আঘাত করল। সাথে সাথে মাছরাঙা নিচে পড়ে ছটফট করতে লাগল। শাহিন দৌড়ে এসে মাছরাঙাকে ধরল। সজীবও তার পিছু পিছু দৌড়ে এলো। শাহিন সজীবের হাতে থাকা ছুরিটা হাতে নিল। দু’জন মিলে আল্লাহু আকবার বলে জবাই করল। সজীব তার হাতে রাখা ব্যাগে এটাকে চালান করে দিল। শাহিনের মুখে তৃপ্তির হাসি। সে গর্ব সহকারে সজীবের দিকে তাকালো। সজীবও তার সদুত্তর দিল হাসি দিয়ে। দু’জনে আবারও যাত্রা শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে চলে এল। পুকুরের ভেতর রাখা বাঁশঝাড়ে একটা বক বসে আছে। শাহিন বকটিকে দেখে দৌড়ে এলো। বকটি আপন মনে মাছ সন্ধানে ব্যস্ত। শাহিন বকটিকে উদ্দেশ্য করে মার্বেল ছুড়ল। মার্বেল গিয়ে পানিতে পড়ল। বকটি সাথে সাথে উড়াল দিয়ে পগার পার।
বিকেলের আলোটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। রক্তিম সূর্যটা ডুবি ডুবি। চিন্তার ছাপ দেখা দিলো শাহিনের মুখে। আর একটা পাখি মারতে পারলে ভালো হতো। শাহিন হাঁটা শুরু করল। ভাবল যেতে যেতে যদি দু-একটা দেখা যায়। সজীব পড়ল মহা বিপদে। বিপদের কারণ, কথা না বলা। এভাবে চুপ করে কতক্ষণ থাকা যায়। সজীব শাহিনের দিকে একবার তাকালো। শাহিন এর অর্থ বুঝতে পারল কি না সজীব জানে না। শাহিনই মুখ খুলল। চল ফেরা যাক। যেতে যেতে যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে মারা যাবে।
ঠিক আছে ভাইয়া।
সজীব খুশি হলেও তা বাইরে প্রকাশ করল না। শাহিনের পেছন পেছন হাঁটতে থাকল আর শাহিনকে ধন্যবাদ দিল। সামনেই একটা জামরুল গাছ। আর জামরুল গাছেই থাকে কোয়েল। শাহিন আস্তে আস্তে জামরুল গাছের নিচে দাঁড়ালো। গাছের ওপর-নিচ একবার দৃষ্টি দিল। তিনটা কোয়েল বসে আছে। অনুমান করল হাত বিশেক ওপরে হবে। চুপচাপ থেকে গুলতিটাকে তৈরি করে নিল। সজীবের দিকে একবার তাকালো। সজীব হাসল। কোয়েলের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চোখ টেরা করে দেখে বুঝে মার্বেল ছুড়ল। এবার সে বিফল নয়। মার্বেলটি গিয়ে আঘাত করল কোয়েলের পায়ে। সাথে সাথে কোয়েল মাটিতে পড়ে উঠার জন্য লাফালাফি শুরু করল। শাহিন দৌড়ে গিয়ে কোয়েলকে ধরে ফেলল। কোয়েল উড়াল দেয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খুব বীরত্বের সঙ্গেই শাহিন এগিয়ে চলছে।
এভাবে শাহিন কখনো জনি কখনো সজীবকে নিয়ে পাখি শিকারে বের হতো। আর নিয়ে আসত তিনটা, চারটা করে পাখি। এভাবে চলতে থাকে শাহিন, জনি, সজীবের পাখির শিকার। এই নিয়ে গ্রামে একটা শোরগোল পড়ে গেল। সবাই শাহিনের প্রশংসা করতে লাগল। শাহিন বীরত্বের সঙ্গে সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলে। আস্তে আস্তে সে ক্রিকেট, ফুটবল, গোল্লাছুট খেলায় সুনাম কুড়াতে শুরু করল। গ্রামে গ্রামে খেলা হলে তার ডাক পড়ত। শাহিনের দুরন্তপনা দেখে তার মা হোসনে আরা বেগম খুশি হলেও তার চিন্তার শেষ নেই। কারণ তার আদরের শাহিন লেখাপড়া করছে না। সারাদিন খেলাধুলা করে কাটিয়ে দিলে তো ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
একদিন তিনি হাঁটতে হাঁটতে ফারুক স্যারের বাড়িতে এলেন। ফারুক স্যার তাদের গ্রামের কলেজের শিক্ষক। বেশ ভালো লোক। স্যারকে দেখে হোসনে আরা বেগম ঘোমটা টেনে দিলেন। স্যার ঘরের সিঁড়িতে বসে বই পড়ছেন। হোসনে আরা বেগম স্যারের সামনে দাঁড়ানো মাত্রই স্যার সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। হোসনে আরা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে কেন এলেন তার বর্ণনা দিলেন স্যারের কাছে। স্যার সব কিছু শুনে বললেন, ঠিক আছে শাহিনকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমি যা বলার বলে দেবো, দেখবেন আপনার ছেলে আবার স্কুলে যাবে। হোসনে আরা বেগম স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে এসে শাহিনকে বললেন, ফারুক স্যার তোকে যেতে বলেছেন।
শাহিন কোনো কথা না বাড়িয়ে তার গুলতিটা নিয়ে বের হলো। তার সঙ্গী হিসেবে রয়েছে জনি। আজ তাদের উদ্দেশ্য বুড়ির পুকুর নয়। তারা যাবে উত্তরের ডগি। এই ডগিতে অতিথি পাখিরা মনের আনন্দে মাছ শিকার করে। এদের মারতে হলে বড় কোনো গাছে উঠতে হবে ভাবল শাহিন। পাশাপাশি থাকলে এরা কাছে আসে না। আর তাই শাহিন আর জনি কড়ইগাছের মগডালে উঠল। কিন্তু সমস্যা হলো যদি পাখি পড়ে তাহলে গাছ থেকে নামতে নামতে পাখি মরে যেতে পারে। আবার মানুষ দেখলে পাখিগুলো কাছে আসবে না। খুব চিন্তার কথা। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল জনিকে নিচে রাখবে আর শাহিন থাকবে গাছে। পাখি পড়া মাত্রই জনি নিয়ে আসবে। আর শাহিন দ্রুত গাছ থেকে নেমে যাবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক জনিকে পাঠিয়ে দেয়া হলো নিচে। শাহিন খুব সতর্কতার সাথে গুলতি তৈরি করে গাছের ওপর বসে রইল। মিনিট বিশেক অতিবাহিত হওয়ার পর পাখিগুলো তীরে আসতে শুরু করল। শাহিন মনোযোগ সহকারে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। আস্তে আস্তে পাখিগুলো শাহিনের আয়ত্তে চলে এলো। শাহিন দেরি না করে মারার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল। বলটিউবকে খুব জোরে টেনে অনেক লম্বা করে ছেড়ে দিলো। সাথে সাথে মার্বেল গিয়ে পড়ল একটি পাখির মাথায়। বাকি পাখিগুলো উড়াল দিয়ে চলে গেলো। জনি দ্রুত নেমে পাখিটিকে ধরে নিয়ে এল। মাটিতে রাখা মাত্রই পাখিটি মাথা আছাড় দিতে শুরু করল। এর মধ্যে শাহিন গাছ থেকে নেমে গেলো। দৌড়ে এসে পাখিটাকে ধরল। দু’জন মিলে দ্রুত জবাই করল। শাহিন আবারও পাখি ধরার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল। জনিও আগের মত লুঙ্গি দিয়ে মাথা ঢেকে রাখল। আবারও পাখিগুলো নিকটে আসতে শুরু করল। নিকটে আসা মাত্রই শাহিন আগের মত মার্বেল ছুড়ল। কিন্তু এবার সে বিফল। পাখিগুলো উড়ে চলে গেলো। জনির মনটা আনন্দে নেচে উঠল। এই প্রথম জনি অনুভব করল পালিয়ে বাঁচার আনন্দ। পাখি উড়ে যাওয়াটাই তার কাছে আনন্দ হয়ে ধরা দিলো। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাওয়া। এইরকম যদি কোনো হিংস্র প্রাণী তাদের এখন আক্রমণ করে তাহলে তাদেরকেও এভাবে পালিয়ে যেতে হবে। আর ধরা খেলেই ঘাড় মটকে দেবে। জনি তাদের আর হিংস্র প্রাণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পেল না। জনির মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। সে কী করবে ভেবে পেল না। মন থেকে সকল ভাবনাকে সরাতে করতে থাকল যুদ্ধ।
কিছুক্ষণ পর জনির মাথাব্যথা শুরু হলো। মাথা থেকে লুঙ্গি নামিয়ে জনি দাঁড়িয়ে গেল। শাহিনের মুখটা লাল হয়ে উঠল। জনিকে ধমক দিয়ে বলল, তুই দাঁড়ালি কেন?
মাথা ব্যথা করছে।
তাহলে চলে যা।
আমার খুব মাথা ব্যথা করছে একা যেতে পারব না।
আচ্ছা আমি নামছি।
শাহিন গাছ থেকে দ্রুত নেমে জনিকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। জনির আম্মু, শাহিনের আম্মু কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে ছুটে আসেন। শাহিন সব কিছু খুলে বলল। হোসনে আরা বেগম শাহিনকে ধমক দিয়ে বললেন, তোর কারণে জনির আজ এই অবস্থা। তাড়াতাড়ি ডাক্তার নিয়ে আয়।
শাহিন মায়ের আদেশ পেয়ে দ্রুত চলে যায়। সবাই জনিকে ধরে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয়। শাহিন কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার নিয়ে আসে। ডাক্তার জনিকে দেখে বললেন, কোনো সমস্যা নেই। এই ওষুধগুলো খেলে আল্লাহর রহমতে ঠিক হয়ে যাবে। জনির আম্মুর কান্না থামে। জনিকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকেন। পরম মমতায় জনি মায়ের বুকে মুখ লুকায়।
জনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু তার মন থেকে পাখির মাথা ঘোরানোর দৃশ্য সরাতে পারে না। এই দৃশ্য সরানোর জন্য সে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও বারবার একই দৃশ্য ভেসে ওঠে। সে কাউকে বলতে পারে না, বোঝাতে পারে না। কাউকে বলার জন্য তার মনটা আকুলি বিকুলি করে। সে শাহিনের সাথে এতো পাখি শিকার করল কিন্তু কোনো দিন এইরকম হয়নি। সে মনে মনে পণ করল আর কোনো দিন পাখি শিকারে যাবে না। বারবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকল। এভাবে কয়েকটা দিন গত হয়। কিন্তু জনি কোনোভাবেই তার মন থেকে এই দৃশ্য সরাতে পারল না। জনি ধীরে ধীরে সব দৃশ্য ভুলতে থাকল। এক সময় সত্যি সত্যি সে সব ভুলে গেল।
শাহিনও আর পাখি শিকারে যাচ্ছে না। কারণ, হোসনে আরা বেগম ছেলেকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে ছাড়লেন। সারাদিন পুকুর ঘাটে বসে থেকেই শাহিনের সময় কাটতে লাগল। কিন্তু এতে শাহিন মনের দিক থেকে তৃপ্ত নয়। ফারুক স্যারের কথা মনে পড়তেই হাঁটতে হাঁটতে স্যারের বাসায় এল। স্যার একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন। শাহিন স্যারের সামনে এসে সালাম দিলে স্যার সালামের উত্তর দিয়ে শাহিনকে বসতে বললেন। শাহিন বাধ্য ছেলের মতো স্যারের সামনে বসল। স্যার বই বন্ধ করে শাহিনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। শাহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কেমন আছো?
জি স্যার ভালো। শাহিনের কথা জড়িয়ে আসে।
তুমি খুব ভালো ছেলে। আমি জানি। তবে দুষ্টুমিটা একটু বেশি কর।
শাহিন নড়ে চড়ে উঠল। স্যারের দিকে একবার তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
তুমি আমার দিকে তাকাও। যদি আমার দিকে না তাকাও তাহলে আমার কথা শুনবে কী করে?
শাহিন স্যারের দিকে তাকায়।
তুমি পাখির শিকার কর ভাবো কারও ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্তু তুমি তোমার নিজের ক্ষতি নিজেই করছ। পশু-পাখি সব কিছুই আমাদের উপকারে আসে। যদি পশু-পাখি বিলীন হয়ে যায় তাহলে প্রকৃতির অস্তিত্ব বলে কিছুই থাকবে না। আর প্রকৃতি যদি না থাকে তাহলে আমরা অক্সিজেন পাবো না। আর এতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলশ্র“তিতে আমরা মৃত্যুবরণ করব। এভাবে দিন দিন আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী থেকে পাখির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ফলে অতি সহজে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আর এই দূষণের শিকার হচ্ছি আমরা। এতে নষ্ট হচ্ছে আমাদের জীবন। শুনেছি তুমি লেখাপড়া করছ না। এতে কার ক্ষতি হচ্ছে তুমি জানো? নিজের ক্ষতি তুমি নিজেই করছ। শিক্ষা ছাড়া একটা মানুষ অন্ধকারে ডুবে থাকা ছাড়া আর কিছু নয়। আর তুমি সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছ। শুনেছি তুমি ছাত্র হিসেবে ভালো। আশা করি তুমি আবার আগের মতো স্কুলে যাবে। পড়াশোনায় মনোযোগ দেবে। তোমার মায়ের আশা পূরণ করবে। খেলাধুলা করবে তবে সেটা সময় বুঝে শুনে করবে। তুমি কোন ক্লাসে পড়তে?
ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ে আর স্কুলে যাইনি।
তুমি আবার ক্লাস সেভেনে ভর্তি হবে।
জি স্যার।
শাহিন যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। স্যার আবার তাকে ডাকলেন। শাহিনের বুক কেঁপে ওঠে। না জানি স্যার আবার কী বলেন। ভয়ে ভয়ে শাহিন স্যারের সামনে এসে দাঁড়ায়। স্যার শাহিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, মায়ের কথামত চলবে।
শাহিন স্যারকে সালাম দিয়ে বিদায় নেয়। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে তার জীবন সাজানোর কথা। একটা সুন্দর স্বপ্ন। একটা সুন্দর সকাল। একটা সুন্দর আগামী।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ