পাহাড়ের কোলে ছেলেবেলা

পাহাড়ের কোলে ছেলেবেলা

ভ্রমণ জুলাই ২০১৫

জুবাইদা গুলশান আরা#

আমি আজ বলবো পাহাড়ি শহর কাসিয়ংয়ের কথা। আমার আব্বা ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তাকে সরকারি দায়িত্ব নিয়ে অনেক জায়গায় যেতে হতো। আমি তখনও পড়াশুনায় এ-বি-সি-ডি’র পাতা পাড়ি দিতে শুরু করিনি। আমার ছোট দা আর দাদা ছিলেন পিঠাপিঠি। এর মধ্যেই ডাক এলো পাহাড়ের দেশে যাবার। আমরা স্কুলে পড়তে যাবো। হিমালয় পর্বতের সঙ্গে কাসিয়ং, কালিম্পৎ, দার্জিলিং এই তিনটি শহরের নাম ছিলো খুব বিখ্যাত। তো সেই ছুটির দিনগুলোয় আমরা যখন কলকাতা থেকে যাত্রা করেছি, আমরা দুই ভাই আর আমি। তখন সব কিছু অচেনা, সব কিছুই নতুন। আমার যত দূর মনে পড়ছে, তখন ছিলো আসাম-বাংলা রেলওয়ে। যাত্রাপথ পেরিয়ে ঝিকঝিক ঝুকঝুক করে যাত্রা শুরু করেছিলাম রাতের বেলায়। একটা লম্বা পথ পাড়ি। আমার প্রথম দূরদেশে যাত্রা। সারা রাত্রি ট্রেন জার্নি করে আমরা পৌঁছাই তিন দরিয়া লুপ বলে একটা বিচিত্র রেললাইনের ওপর দিয়ে। পাহাড়ি পথে চলার সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্য ছোট আকারের রেললাইন বসানো হয়েছে। দেখতে খানিকটা ঘোড়ার খুরের মতো। তো সারা রাতের দৌড়ের পালা শেষ করে খুব ভোরে আমরা পৌঁছাই ঘুম নামে ইস্টিশনে। মা যখন আমাকে বললেন ওঠ বাবা, দ্যাখ এ ইস্টিশনের নাম ঘুম। ওমা ঘুম নামে ইস্টিশন? আমি তড়বড় করে উঠে বসি। ট্রেন থামার সময় খুব নিচু স্পিডে চলার আয়োজন হচ্ছে। আসলেই ট্রেনটি ছোট ছোট বগি দিয়ে তৈরি। ইঞ্জিনটাও যেন ঠিক ছবির মতো। বড় বড় লোহার রডে তৈরি একটা খাঁচার মতো সামনেটা, কপালের ওপরে আলোর লাল জ্বল জ্বলে বাল্ব। pa2
আমার কিন্তু ভারী অবাক লেগেছিলে। জায়গার নাম যদি ঘুম হয়, তবে লোকজন এত ব্যস্ত হয়ে ওঠানামা করছে কেন? সবাই হেসে উঠলো, আর জিনিসপত্র নামাতে ব্যস্ত হলো।
কাসিয়ংয়ে আমাদের বাংলোটা একটা পাহাড়ের ঢালের নিচে। সাদা রঙের কাঠের বাংলো। ঘরগুলো বেশ বড় বড়। দেয়াল ঘেঁষে ফায়ার প্লেস অর্থাৎ অগ্নিস্থলীর কাঠের টুকরো কেটে কেটে ফায়ার প্লেস দিয়ে আগুন জ্বেলে দিলে ঠান্ডা হিম ঘরগুলো আস্তে আস্তে গরম হয়ে ওঠে। মস্ত বড় ঘরগুলো আংশিক কার্পেট দিয়ে মোড়া। বাড়ির সামনে পেছনে বড় বড় পাইন গাছা আর কাঠবাদামের গাছ। দু’জন চাপরাশি আব্বার কাজের জন্য বরাদ্দ আছে। ওরা বাড়িতে পৌঁছানোর পর এসে সালাম জানালো। ওদের একজন ধন বাহাদুর, অন্যজন মন বাহাদুর। ওদের থাকার ঘরটা পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি, একেবারে ছবির মতো। বাড়ির সামনে নানা রকম সবজি লাগানো। আমাদের বাংলো বাড়ির পেছনে বিরাট এক রান্নাঘর। জিনিসপত্র রাখার বিরাট কাঠের আলমারি। ঘরটা যেন একটা ফুটবল খেলার মাঠ।
বাইরেই পাথরের ঢিবি, তার ওপরে ঝর ঝর করে ঝরে পড়ছে একটা ছোট্ট ঝরনা, একেবারে হাতে আঁকা ছবি যেন।
আমাদের তো স্কুলে যাওয়া ছিলো না। তবে বেড়ানোর জায়গারও অভাব ছিলো না। রোজ সকালে উঠে খাকি হাফ প্যান্ট, বুশ কার্ট আর গরম জামা পরে ভাইয়েরা বাইরে যেতো চাপরাশিদের সাথে, শহরের নানা দিক দেখতে। আমি যেহেতু সবার ছোটো তাই আম্মা আমাকে একলা ছাড়তেন না। আমাকেও পোশাক পরিয়ে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। কাছাকাছি পোস্ট অফিসের কর্মকর্তার স্ত্রী ছাড়াও আরো দু-একজন বাঙালি অফিসার তাদের পরিবার নিয়ে থাকতেন। সেখান থেকে উনারা এসে আমাদের সঙ্গে করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন। এমনিতে কাসিয়ং শহরটি ছিলো পাহাড়ের ধাপে তৈরি। এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে যেতে হলে পাহাড়ের ধাপ কেটে তৈরি করা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হাতো। গাড়ি ঘোড়া চলাচল করতো নিয়ম মেনে। শহরে মালপত্র আনা-নেয়ার জন্য পাহাড়িরা কপালে চওড়া পট্টি বেঁধে পিঠের ওপরে ভারী বোঝা, লাকড়ি এসব নিয়ে চলাচল করতো। এমনকি ছোট ছেলেমেয়েদেরও এভাবে আনতো। পাহাড়ি মানুষ খুব পরিশ্রমী। সৎ ও হাসিখুশি হয়। রোপওয়ে নামে একটি পদ্ধতিতে কল কারখানায় বড় বড় মালপত্র আনা নেয়া করা হতো।pa3
মোটা মোটা তারে তৈরি, মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে রোপওয়ে। দেখে আমার দু’ভাই মহাখুশি। ফলে পরদিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দু’ভাই বাড়ির পাশের খোলা জায়গায় দড়ি বেঁধে রোপওয়ে বানাতে চললো। পারুক না পারুক। মজা খুব, তাতে সন্দেহ নেই। রোজ সকালে দুধওয়ালী আসতো। তার গা ভরা গয়না। বিশাল এক জোড়া কানের দুল পরে, গলাভর্তি পাথর। রূপা ও কাঠ দিয়ে তৈরি এক ঝোপা গলার মালা। এসব ওদের প্রাচীন ঐতিহ্য। আমরা অবাক হলে খালি হাসতো, হাসতে হাসতে দুধ দিয়ে চলে যেতো। ধন বাহাদুর আর মন বাহাদুরের দু’টি ছেলে ছিলো, যারা একেবারে চীনা পুতুলের মতো মিষ্টি আর সুন্দর। সকাল বিকেল বাড়ির সামনে খেলে বেড়ায়। হাসি মুখে দৌড়ে বেড়ায়। অফিস থেকে মালি এসে নানা রঙের ফুল দিয়ে যায়।
কাসিয়ংয়ের সাধারণ আবহাওয়া হলো রোদ্দুর আর মেঘের মিলেমিশে তৈরি। খুব জোরে ঠান্ডা কনকনে বাতাস, তাই সবাইকে সারাক্ষণ ভারী পোশাক পরে থাকতে হতো। জানালার বাইরে কুয়াশার মতো জমে থাকে শীতের বাতাস। একদিন হঠাৎ করে আমি বড় বড় কাচের জানালা আলোর জন্য খুলে দিয়েছি, ঝপাৎ করে ভেজা মেঘের দলা হু-উয়া করে ঢুকে পড়লো। আর কাঠের মেঝে, মাটিতে পাতা কার্পেট ভিজে গেল। আসলে, একেক দেশের একেক কান্ড। দূরবীন যন্ত্র ছিলো শহরের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। দীর্ঘ একটি মঞ্চ। গোল করে বসানো সুন্দর একটি স্তম্ভ ছিলো সেখানে। লম্বা করে দূরবীন বসানো। যেদিকে ইচ্ছে ঘুরিয়ে দেখা যায়। গোটা শহরে ছড়িয়ে দেয়া আকাশ ভরা চন্দ্র-তারা। সেই সঙ্গে ছোটো এই পাহাড়ি শহরের বৈশিষ্ট্যে ভরা মনোমুগ্ধকর চিত্রমালার সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। একদিন এলো এক প্রচন্ড ঝড়। যাকে বলে পাহাড়ি ঝড়, চার দিকে অন্ধকার করে, পাতা কুটো উড়িয়ে, বড় বড় গাছের মাথায় ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে এলো বৃষ্টি। আমরা সব ঘরের মধ্যে মায়ের কাছে বসে থাকি। ঘরের বাইরে থেকে উঠে আসে ঝড় আর বৃষ্টির খ্যাপানি। মন বাহাদুর বড় ডোম লাগানো তেলের ল্যাম্প রেখে দেয় বড় টেবিলটার ওপরে। বলে যায়Ñ ‘লাল টিন লালুচু ডর নাই। অর্থাৎ লুণ্ঠন এনেছি ভয় নেই।’ ওখানকার ঝড়ের চেহারা মনে হলে এখনও ভয় লাগে। আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই মস্ত বড় একটা ঝরনা নদীর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ঝড়ের পরে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার বুকে ফেনা তোলা চেহারা দেখে ভয়ে আমরা আঁতকে উঠি। কি রকম বদলে গেছে ঝরনার চেহারা। ধন বাহাদুর আমাদের বাইরেরটা দেখালো। কি ভীষণ ছাই রঙের মেঘেরা গোল পাকিয়ে ভেসে যাচ্ছে যেন রাগী দৈত্য। আমরা সবাই চুপ করে বসে বসে দেখছি। কারো মুখে কথা নেই। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর ঝড় থামলো। মুখ বের করে দেখি দরজার বাইরে শিলা পড়ে গোটা জায়গাটা সাদা হয়ে গেছে। মন বাহাদুর একটা কোদাল নিয়ে শিলাগুলো সরিয়ে ফেলছে। শিশুরা গনগনে আগুন জ্বলা চুল্লির তাপে বসে আরামে ওম নিচ্ছে। সবসময় যেমন, সেদিনও তেমনই শেষ রাত করে ফিরলেন আব্বা। বিকেলে পাহাড়ি এলাকায় তারাও পড়েছিলেন ঝড়ের পাল্লায়। কষ্ট করে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে ফিরতে পেরেছেন। আব্বার বিপদ আর কষ্টের জন্য তাকে সবাই ধন্যবাদ জানাতো।
স্কুলে আমরা তখন কাসিয়ং দাওহিল রেসিডেনসিয়াল স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমাদের একদম ভালো লাগছিলো না। কারণ বাঙালির সংখ্যা ছিলো অল্প। আমাদের বড় ভাইয়েরা সবাই কলকাতায় ইংরেজি স্কুলে পড়ছিলেন। তাদের কথা ভেবেও শেষ অবধি কাসিয়ংয়ের দিনগুলো যেন ক্রমশ ফুুরিয়ে আসছিলো। বলা যায় কাসিয়ং আমাদের শৈশবকালে বেড়ানোর চমৎকার এক স্মৃতি। pa4
আসলে কাসিয়ং নামে ছোটো এক পাহাড়ি শহরের স্মৃতি আমার ছেলেবেলার অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বড় হয়ে পৃথিবীর অনেক বড় বড় দেশ আর ছোট-বড় দেশ ঘোরার সুযোগ পেয়েছি। পৃথিবীর সব দেশই নিজস্ব দিক থেকে সুন্দর মনে রাখার মতো। তবুও আমার কেন যেন ঐ ছোটো পাহাড়ি শহরটার ছবি ফিরে আসে বারবার। স্বপ্ন যেন আমাকে সেই বাংলো বাড়ি আর সুন্দর বিকেলগুলোর দিকে হাত ধরে নিয়ে যায়। আমি যেন অপেক্ষা করে থাকি, সেই লালটিং (লণ্ঠন) হাতে ধন বাহাদুর কখন এসে দাঁড়াবে। মনের খুশিতে আমি হাসতে হাসতে আমাদের বাড়িটার বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়াই আর হাসতে হাসতে গিয়ে দরজায় টোকা দিই।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ