পিশাচ কাহিনী -গোলাম রাব্বি রাকিব
তোমাদের গল্প জুলাই ২০২০
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা থেমে গেলো। সামনের দিকে কয়েকটা মেয়ে বসেছে। ওরা চিৎকার করে উঠলো। আমি হেডফোনটা ঘাড়ে নামিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। জানালার পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক আনমনে বললেন- ‘কী হলো?’ আমি উত্তর দিতে যাবো, ঠিক তখনই লোডশেডিং। বাসের ভেতর সব আলো নিভে গেলো। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। পাশের ভদ্রলোক এবার মোবাইলের আলো জ্বাললেন। দেখলাম ১১.৫০ চগ বাজে। তিনি আবার বললেন- ‘কী হলো?’ কী যে হলো, সেটা তো আমারও জিজ্ঞাসা। কিন্তু সেটা কে জানাবে? ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে জেনে আসতে- ঘটনা কী। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ভারী একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো দূর থেকে- “আপনারা যার যার স্থানে বসে থাকুন। কেউ নড়বেন না। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এক্ষুনি কারেন্ট চলে আসবে। গাড়ির পিছনের একটা চাকা কোনো কারণে ড্যামেজ হয়েছে। ওটা পাল্টাতে কিছুক্ষণ সময় লাগবে, এরপরই গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে। যাত্রাকালীন এই সাময়িক গোলযোগের কারণে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” কথার হেরফের হলো না। কারেন্ট তখনই চলে এলো। বাসের ভেতরটাও শান্ত হলো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। কিন্তু গুমোট অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখলাম না। আস্তে আস্তে দৃষ্টি সয়ে এলে বুঝলাম, বাইরে ঘন জঙ্গল। বড় বড় গাছের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। - ‘জানেন? এই পথে না পিশাচ আছে।’ আমি বিরক্ত হয়ে পাশের লোকটার দিকে তাকালাম। আধ বয়স্ক লোক। তবে সুপুরুষ। চোখের মাঝে এক ধরনের মায়া আছে। শুরু থেকেই লোকটা চেষ্টা করছেন আড্ডা জমাতে। কিন্তু কানে হেডফোন থাকায় সুবিধা করতে পারেননি। এবার সুযোগ পেয়েই ঢিল ছুড়েছেন। অবশ্য আমারও এখন সময় কাটানো দরকার। গান শুনতে আর ভালো লাগছে না। ঘুমাবো, তারও সায় পাচ্ছি না। বাস থেমে আছে, কখন কী হয়, ঠিক নেই। শুধু শুধু বোর হওয়ার থেকে তাই আড্ডা দেওয়াই ভালো বোধ হয়। আমি বললাম- ‘সত্য বলছেন? এখানে আসলেই পিশাচ আছে, আই মিন ভূত?’ - ‘হুম!’ - ‘তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং তো! আপনি জানলেন কিভাবে?’ লোকটি গর্বভরে বললেন- ‘এ পথে আমার প্রায়ই যাতায়াত হয়। সেভাবেই জেনেছি।’ - ‘ও! আপনি কখনো দেখেছেন?’ - ‘আরে ধুর! আমি দেখবো কোত্থেকে? ওসব তো লোকমুখে শোনা কাহিনী। বলতে পারেন লোককাহিনী।’ - ‘আপনি বিশ্বাস করেন এসব?’ ভদ্রলোক হাই চাপতে চাপতে বললেন- ‘আরে নাহ্! আপনি দেখছি মজার লোক। ওসব আমি বিশ্বাস করতে যাবো কেন? ওসব তো কুসংস্কার। তবে .... গভীরভাবে ভাবলে একটু খটকা লাগে।’ আমি বললাম- ‘তাই? সেটা কী রকম?’ - ‘প্রতি মাসেই এ রাস্তায় একটা না একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়। এবং আবশ্যকভাবে কয়েকজন জীবনও হারায়।’ আমি বিরক্ত হয়ে বললাম- ‘সে তো বাংলাদেশের সবখানেই হয়। প্রতিদিনই ঘটে কোথাও না কোথাও।’ ভদ্রলোক মুচকি হাসলেন। বললেন- ‘এ জন্যই তো বললাম-কুসংস্কার। ওসব আমি বিশ্বাস করি না।’ এরপর কিছুক্ষণ কোনো কথা হলো না। হঠাৎ আমি বললাম- ‘আচ্ছা থাকুন, আমি একটু ঘুরে আসি। বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না।’ ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন- ‘আরে! কোথায় যাচ্ছেন?’ - ‘আপনার পিশাচটাকে নিজ চোখে দেখে আসি।’ লোকটি হা হা করে হাসতে লাগলেন। বললেন- ‘আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে দিলে তো! এতো রাতে ওরা আপনাকে গাড়ি থেকে একা ছেড়ে দেবে ভেবেছেন?’ আমি অবজ্ঞার হাসি হেসে পকেট থেকে অফিসের আইডি কার্ডটি বের করে দেখালাম। লোকটি পুরো থ বনে গেলেন। বললেন- ‘আপনি সাংবাদিক? হা হা! এতক্ষণ তাহলে খালুর কাছে মামার বাড়ির গল্প করছিলাম? ভালো মজা তো!’ আমি মুচকি হেসে সিট থেকে উঠে আসছিলাম, ভদ্রলোক আমার হাত ধরে টান দিলেন। বললেন- ‘দাঁড়ান! আমাকেও নিয়ে যান। আমিও ঘুরে আসি বাইরে থেকে। একা আমার ভালো লাগবে না।’ আমি ব্যাকপ্যাক’টা ঠিক করতে করতে বললাম- ‘আসুন। আপনি এলে ভালোই লাগবে।’ বাইরে এসে দেখলাম, ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর মশাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন। হেল্পার ছোকড়াটা বাসের নিচে শুয়ে আছে। চাকা খুলছে। আমি বললাম- ‘কতক্ষণ লাগবে ঠিক হতে?’ ড্রাইভার লোকটিকে কেন যেন বড় চিন্তিত মনে হলো। তিনি হতাশ গলায় বললেন- ‘স্যার বোঝা যাচ্ছে না। ঘণ্টা দেড়েক লাগবে কমপক্ষে। ইঞ্জিনটাতেও একটু সমস্যা হয়েছে।’ আমি হাসলাম। অন্ধকারে আমার রহস্যময় হাসিটা কেউ দেখলো না। বাসকে পিছনে ফেলে আমরা সামনে এগোচ্ছি। আমি আর সেই ভদ্রলোক। আগে মনে হয়েছিল, দু’পাশে ঘন জঙ্গল। কিন্তু এখন দেখছি, জঙ্গল অত ঘন না। গাছপালা যথেষ্ট হালকা। তবে গাছের পাতাগুলো ইয়া বড় বড়। হালকা বাতাস বইছে। সেই বাতাসে হালকা শীত শীত অনুভব হচ্ছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে বারোটা বাজে। আকাশে মেঘ। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদটা তাতে ঢাকা পড়ে আছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এলাম। ভদ্রলোক হঠাৎ বলে উঠলেন- ‘ভাই, অনেক তো এলাম। এবার চলেন ফেরা যাক। আমার যেন কেমন ভয় ভয় করছে।’ আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। বললাম- ‘আপনি নাকি কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না?’ তিনি বললেন- ‘আসলে তা না! পরিবেশটা যেন কেমন ছমছমে। শীতের কাপড় নিয়ে আসা উচিত ছিল। বাতাসে ঠাণ্ডা লাগছে।’ আমি এবার টান দিয়ে আমার জ্যাকেটটা খুলে ফেললাম। স্যান্ডো গেঞ্জির আড়ালে গায়ের পশমগুলো আমার বাতাসে উড়তে লাগলো। বললাম- ‘এই নিন, পরুন।’ ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। ততক্ষণে মেঘ সরে গিয়ে জ্যোৎ¯œায় ভরে উঠেছে চারদিক। চাঁদের আলোয় আমার বিকট ছায়া গিয়ে পড়েছে দূরে। সেই ছায়া কোনো মানুষের নয়। অচেনা কোনো বন্য পশুর। আজ সে বহুদিন পর শিকার পেয়েছে। রক্তের নেশায় বুঁদ হয়ে বুক চাপড়াচ্ছে। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির তাতে কোনো ভাবান্তর নেই। তার অপলক দৃষ্টি বড় অবাক হয়ে দেখছে পিশাচ রূপধারী আমাকে।
আরও পড়ুন...