প্রকৃত বন্ধু

প্রকৃত বন্ধু

গল্প ডিসেম্বর ২০১২

মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম

টিং ... টিং ... বেজে উঠলো কলিং বেল। দরজা খুললো মিজান। তামিম এসেছে, তার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড। কুশল বিনিময় শেষে তামিমকে ঘরে এনে বসালো মিজান। ‘বল কী খাবি?’ মিজানের প্রশ্ন। ‘খাওয়া-দাওয়া পরে,’ তামিম বললো। ‘আগে বল তোর কাছে নতুন কোনো গল্পের বই আছে?’ ‘আছে, তিনটা, গত পরশু কিনেছি।’ ‘দিতে পারবি?’ ‘ওহ্ শিওর জাস্ট ২ মিনিট।’ মিজান উঠে গেল। একটু পর ট্রে-তে করে ২ গ্লাস শরবত আনলো। ‘নে খা, আমি বই আনছি।’ আবার বেরিয়ে গেল সে, এবার বই ৩টি নিয়ে এলো। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বই ৩টা নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলো তামিম। বললো, ‘তিনটাই নেব।’ ‘নো প্রবলেম।’ এমন সময় আবার বেজে উঠলো কলিং বেল। ‘দাঁড়া আসছি।’ দরজা খুলেই মিজান দেখতে পেল রুম্মানকে। ‘আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছিস? আয় ভেতরে আয়’, মিজান বললো। তামিম বসে বসে শুনছে মিজানের কথা। তবে সে বুঝতে পারছে না দরজায় কে। মিজানের কোনো বন্ধুই তো ওর অপরিচিত নয়। এমন সময় ছেলেটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো মিজান। ওকে দেখেই চমকে উঠলো তামিম। ছেলেটাও। তামিমকে বললো মিজানÑ ‘ও রুম্মান, ওর সাথে আমার প্রায় এক মাস ধরে পরিচয়। স্যরি দোস্ত তোর সাথে আগে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি।’ কৈফিয়তের সুরে বললো মিজান, ‘ও হ্যাঁ রুম্মান, ও হলো তামিম, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।’ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে তামিমের সাথে হ্যান্ডশেক করলো ছেলেটি। ‘আমি তাহলে এখন আসি দোস্ত’, তামিম বললো। ‘ওকে ভালো থাকিস।’ কথাগুলো বলতে বলতে তামিমকে বিদায় জানালো মিজান। পরদিন মিজানের সাথে দেখা হতেই তামিম প্রশ্ন করলো, ‘কাল রুম্মান কেন গিয়েছিল তোদের বাসায়?’ ‘ও, রুম্মান! ওর কিছু টাকার খুব প্রয়োজন ছিল সে জন্য।’ ‘আর তুই ওকে টাকা দিলি?’ কপাল কুঁচকে জানতে চাইলো তামিম। ‘হ্যাঁ।’ ‘দোস্ত, তোকে একটা কথা বলা দরকার।’ তামিমের চিন্তিত কণ্ঠস্বর। ‘তুই হয়তো রুম্মানের ব্যাপারে ভালো করে কিছু জানতে পারিসনি। আমি তাকে খুব চিনি। ছেলেটি খুব খারাপ। আমি নিজে একদিন ওকে ছিনতাই করতে দেখেছি; সেদিন সে গণপিটুনি থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে।’ তামিমের কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেল মিজানের, ‘সত্যি?’ ‘অবশ্যই দোস্ত, আমি মিথ্যা বলতে যাবো কেন?’ ‘তাও ঠিক, আচ্ছা তুই শিওরতো’, মিজানের কণ্ঠে অবিশ্বাস। ‘আরে বললাম না নিজে ওকে ছিনতাই করতে দেখেছি,’ জোর দিয়ে বললো তামিম। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে সেদিনের মতো বিদায় নিলো তামিম। মিজান আর রুম্মান বসে আছে সোফায়। কথা বলতে বলতে হঠাৎ মিজান বললো ‘রুম্মান একটা কথা বলি?’ ‘বল।’ ‘শুনলাম...’ থেমে গেল ও, ইতস্তত করছে। ‘বল না কী বলবি, থেমে গেলি কেন?’ ‘না, শুনলাম, ত্ইু নাকি ছিনতাইকারী, তুই নাকি আরো কী সব খারাপ কাজ করিসÑ এসব কি সত্যি নাকি? প্লিজ আমার সাথে মিথ্যা কথা বলিস না।’ শুনে চমকে উঠলো রুম্মান। পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। মিজানের হাত ধরে বিশ্বাসের সুরে বললো সে, ‘তোকে ছুঁয়ে বলছি দোস্ত, আমি এসব কিছ্ইু করি না, কিন্তু এসব তোকে কে বললো?’ ‘যেই বলুক না কেন, আমি শুধু জানতে চাই এসব সত্যি কি না?’ ‘না দোস্ত, এক ফোঁটাও না, একদম ডাহা মিথ্যা কথা।’ রুম্মানের মুখের দিকে একদৃষ্টে কতক্ষণ চেয়ে থাকলো মিজান। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। মনে হলো না মিথ্যা বলছে। বললো, ‘আচ্ছা তাহলে ঠিক আছে।’ এ নিয়ে আর কোনো কথা বলল না ও। রুম্মানও না। আরও খানিকক্ষণ কথা বলে বিদায় নিল রুম্মান। রুম্মান তার পাড়ার বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। একটা টঙ দোকানে বসে চা খাচ্ছে ওরা। ‘শোনো তোমরা,’ বললো রুম্মান, ‘মিজান আমার ব্যাপারে সব জেনে ফেলেছে। অনেক ভেবে আমি বুঝেছি কে ওকে এসব বলেছে?’ ‘কে?’ জিজ্ঞেস করল একজন। ‘মিজানের ফ্রেন্ড। ছেলেটার নাম তামিম। ওই যে চশমাওয়ালা।’ ‘ওকে বসিয়ে দেব নাকি?’ ‘না না, এটা উচিত হবে না। শোন আমি একটা পরিকল্পনা করেছি। এর ফলে মিজানকে বিশ্বাস করানো যাবে, তামিমকেও মিথ্যাবাদী বানানো যাবে। না হয়, যদি আমরা তামিমের ওপর হাত তুলি, তো সে নিশ্চিত মিজানকে সব বলে দেবে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।’ ‘হুমম.... তা পরিকল্পনাটা কী?’ ‘শোনো তাহলে ...’ রুম্মান সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তার পরিকল্পনা বুঝাতে লাগলো। মিজান স্যারের বাসা থেকে বাড়ি ফিরছে। এমন সময় সে তার বাড়ির পাশে গোলমাল দেখতে পেল। রাস্তা পার হতেই সে দেখলো রুম্মানকে কতগুলো ছেলে মারছে। ‘আহ উহ ’এমনি আর্তনাদ করে যাচ্ছে ও। ‘শালা আমাদের জ্ঞান দিতে আসে। যা এটা আমাদের এলাকা। এখানে আমাদের যা ইচ্ছা তাই করবো।’ মিজানকে আসতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে ছেলেটা রাস্তায় পড়ে থাকা রুম্মানকে সজোরে এক লাথি মারলো। অসংখ্য লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছে। কিন্তু কারো মুখে টুঁ শব্দ নেই। ছেলেগুলো চলে গেল। মিজান এগিয়ে যাবার আগেই আরেকটি ছেলে রুম্মানকে তুলে ধরলো। তার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ালো রুম্মান। ঠোঁটের কোনায় রক্ত ঝড়ছে। ধুলো বালি লেগে আছে কাপড়ে। ‘ব্যাপার কী রুম্মান? ওরা করা?’ প্রশ্ন মিজানের। রুম্মান কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। লোকজন সব আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। রুম্মানের সাথের ছেলেটি বললো, ‘আর বল না ভাই, ওই ছেলেগুলো প্রতিদিন স্কুলের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। রুম্মান এতে বাধা দেয়। আজ ওরা ওর ওপর হাত তুললো। কাল কী করবে কে জানে!’ মিজান ইতোমধ্যে তার বাসার ফটকের সামনে এসে পড়েছে। ছেলেটার কাঁধে ভর দিয়ে চলে যেতে লাগলো রুম্মান। মিজান সেদিকে তাকিয়ে থাকলো অপলক। পরদিন ক্লাস শেষে ফেরার পথে মিজান তামিমকে বললো, ‘তামিম, তুই আমার সাথে মিথ্যা বললি? রুম্মান খারাপ ছেলে না। হয় তুই ভুল দেখেছিস, না হয় কেউ তোকে ভুল বলেছে।’ ‘না দোস্ত, আমি একটুও মিথ্যা বলিনি। বিশ্বাস কর। সত্যিই ঐ ছেলেটা ...’ কথা শেষ করতে পারলো না তামিম। একটা কণ্ঠ শোনা গেল, ‘মিজান!’ ‘দাঁড়া আসছি।’ রুম্মানকে দেখে বললো মিজান। রুম্মানের সাথে মিজান কিছু কথা বললো। তারপর ফিরে এসে তামিমকে বললো, ‘তামিম তুই যা আমি আজ রুম্মানের সাথে এক জায়গায় যাবো।’ ‘কোথায়?’ ‘এই সামনেই ... যা তো,’ বিরক্ত কণ্ঠে কথাটা বলেই গটমট করে হেঁটে চলে গেল মিজান। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তামিম। তার প্রিয় বন্ধু খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে খারাপ হয়ে যাবে আর সে তা এভাবে দেখবে? অসম্ভব, কখনো না। ভাবতে লাগলো সে। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি চলে এলো। হ্যাঁ এতেই কাজ হবে, মিজানের মাকেই বলতে হবে। বাসায় গিয়ে খেয়ে দেয়ে ইউনিফর্ম পাল্টে মিজানের বাসায় গেল ও। জানলো মিজান ঘরে এসে কিছু না খেয়েই চলে গেছে। মিজানের মাকে সব খুলে বলল ও। ‘তামিম তোকে আমি কত ভাল বন্ধু মনে করতাম আর তুই কি না আমার মাকে বলেছিস আমি খারাপ ছেলেদের সাথে মিশি। ছি! তামিম ছি! তুই আমার বন্ধু এ কথা ভাবতেও আমার ঘৃণা হয়।’ ফোঁস করে কথা ক’টি বললো মিজান। ‘কিন্তু দোস্ত ...’ কিছু একটা বলতে চাইলো তামিম। ‘দোস্ত? আমি কারো দোস্ত না। যা তোর সাথে আজ থেকে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সাথে আর কখখনো কোনো কথা বলবি না, আমার বাসায়ও যাবি না। ব্যস গুডবাই...’ লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে চলে গেল মিজান। সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো তামিম। এমন দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও সে প্রস্তুত ছিলো না। দু’দিন পর। পাগলের মতো হাঁটছে মিজান। তার বাবা অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। অপারেশনের প্রয়োজন। এ মুহূর্তে অনেক টাকা দরকার। কিন্তু এখন ওদের এতো টাকা নেই। বাবার বন্ধুদের কাছ থেকে ইতোমধ্যেই সে অনেক টাকা ধার করেছে। আর সামান্য ক’টা টাকা হলেই অপারেশনটা হয়ে যায়। এমতাবস্থায় চোখে অন্ধকার দেখছে মিজান। হঠাৎ একটা দোকানের সামনে রুম্মানকে দেখতে পেল সে। কতগুলো ছেলের সাথে হাসতে হাসতে কথা বলছে। আর ওর হাতে টাকার একটা বান্ডিলও দেখল, আশ্বান্বিত হলো মিজান। এমন বিপদে রুম্মানই পারে তাকে সাহায্য করতে। খানিকটা এগিয়ে ডাক দিল সে, ‘রুম্মান!’ ‘কী হয়েছে রে?’ প্রশ্ন করলো রুম্মান, ‘তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’ ‘দোস্ত, আমার বাবা অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। অপারেশনের জন্য অনেক টাকার দরকার। আমাকে একটু সাহায্য কর না দোস্ত।’ মিজানের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই হাতের টাকাগুলো তাড়াহুড়া করে পকেটে ঢুকালো রুম্মান। চোখে মুখে অপ্রস্তুত ভাব। কোন মতে জবাব দিল, ‘আমার কাছে টাকা নেই।’ হতবাক হয়ে গেলো মিজান। রুম্মান এত বড় মিথ্যা কথা বললো! ‘এই না দেখলাম তোর হাতে অনেক টাকা!’ বললো ও। ‘ও, ওগুলো? ওগুলো ... তো ... তো..’ তোতলাতে লাগলো ও। ‘মানে ওদের টাকা তাই না রে?’ সাথের ছেলেদের দেখালো মিজান। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ,’ সায় দিলো ছেলেগুলো। ‘ওগুলোতো ছিনতাইয়ের টাকা, ওরা দেবে কিভাবে ভায়া?’ এমন সময় কথাগুলো বলে ফেললো দোকানদার। ‘এত কষ্ট করে ছিনতাই করেছে আর তোমাকে দিয়ে দেবে তাই কি হয়?’ ‘কী? আমরা ছিনতাইকারী?’ দোকানদারের দিকে তেড়ে গেল রুম্মান। ‘তা নয়তো কী? ওগুলো কিসের টাকা? আমরা বুঝি না মনে করেছো?’ পিছিয়ে গিয়ে সমান তেজে বললো দোকানদার লোকটা। ‘তবেরে শালা...’ ‘থামো রুম্মান,’ এবার বললো মিজান, ‘তুমি কী তা আমি বুঝে ফেলেছি। ছি! এত খারাপ কেউ হয়। এ বয়সেই ছিনতাই করো?’ ‘করেছি, বেশ করেছি তাতে তোর কী?’ বললো রুম্মান। ‘এই ব্যাটাকে ধর।’ দোকানদারকে দেখালো ও। কয়েকজন লোকটাকে ধরে টেনে বের করে আনলো। মাটিতে ফেলে মারতে লাগল যত খুশি। চেঁচাতে লাগলো লোকটা, ‘বাঁচাও!’ বাধা দিতে গেল মিজান। কিন্তু রুম্মানের ঘুষি খেয়ে নাক ফেটে গেল তার। তারপর দোকানদারকে ছেড়ে তার ওপর হামলে পড়লো সবাই। রাস্তায় দাঁড়ানো লোকজন এসব দেখেও কিছু বলছিল না কেউ। এমন সময় কেউ একজন বললো, ‘তোমরা কী দেখছ ভীরু কাপুরুষের দল?’ সাথে সাথে মানুষজন সবাই ক্ষেপে গেল। হামলা করলো রুম্মানদের ওপর। গণপিটুনি থেকে বাঁচতে দু’জন কোনো মতে হোন্ডায় চড়ে ভাগলো। বাকিদের তাড়িয়ে নিয়ে গেলো লোকজন অন্যদিকে। মিজান অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তার পাশে কেউ হাঁটু গেড়ে বসলো, ডাকলো ‘মিজান’ বলে। অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর। চোখ খুললো ও। তামিমকে ওর পাশে দেখতে পেলো। ‘চল দোস্ত তোর বাবার অপারেশনের টাকা জোগাড় হয়েছে, আর তোরও এখন চিকিৎসা প্রয়োজন। ওঠ।’ ওকে ধরে উঠালো তামিম। তামিমের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ালো ও। দোকানদার লোকটার তেমন কিছু হয়নি। সে উঠে ধুলা ঝেড়ে বললো, ‘আমিও আসি তোমাদের সাথে?’ ‘নো, থ্যাংকস ব্রাদার।’ তামিমের জবাব। একটা রিকশা ডাকলো তামিম। মিজানকে নিয়ে উঠলো রিকশায়। মিজান বললো, ‘তামিম আমায় মাফ কর দোস্ত, আমি তোকে ভুল বুঝেছিলাম। আসলে তুই-ই আমার প্রকৃত বন্ধু।’ ‘থাক দোস্ত। আমারই উচিত হয়নি আন্টিকে ব্যাপারটা বলা। বাদ দে ওসব। এবার চল ক্লিনিকে। আঙ্কেলের অপারেশন শুরু হতে আর আধঘণ্টা বাকি।’ ‘থ্যাংক ইউ বন্ধু।’ ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম ডিয়ার।’ রিকশা ছুটে চললো গন্তব্যে। আর স্নিগ্ধ বিকেলের সোনালি আলোয় ওদের দু’জনের মন যেন মিশে গেল দিগন্তের সাথে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ