প্রজাপতির দেশে

প্রজাপতির দেশে

বিশেষ রচনা এপ্রিল ২০১১

প্রজাপতি যখন ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় তখন কী দারুণ লাগে! তবে এরা কিন্তু এমনি এমনি এভাবে ঘুরে বেড়ায় না। মধুর লোভে। প্রজাপতি ফুল থেকে মধু পান করে। আর প্রজাপতি কিন্তু যখন-তখন দেখা পাওয়া যায় না। ঠাণ্ডায় প্রজাপতিরা উড়তেই পারে না। প্রজাপতির শরীরের তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপর

হলেই শুধু এরা উড়তে পারে। এ জন্যই শীতের সময় এবং ঠাণ্ডার দিনে এদের দেখা পাওয়া যায় না। বসন্তের শেষেই প্রজাপতির ডিম ফুটে ছানা বেরোয়।

প্রজাপতির জীবনচক্র

প্রজাপতির জন্ম কবে পোকামাকড়ের ফসিল দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আজ থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে পোকামাকড়ের জন্ম। ধরে নেয়া হয় লেপিডোপটেরা বর্গের প্রাণীদের (প্রজাপতি, মথ) জন্ম ১৪০ থেকে ২০০ মিলিয়ন বছর আগে। ঠিক একই সময় পৃথিবীতে জন্ম হয়েছিল প্রথম সপুষ্পক উদ্ভিদের। প্রজাপতির জীবনকাল প্রাণিজগতে সবচেয়ে কম আয়ু নিয়ে জন্মায় পতঙ্গ শ্রেণীর প্রাণী। কেউ দুই সপ্তাহ বাঁচে তো কেউ দুই বছর বাঁচে। আবহাওয়া ও খাদ্যের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে প্রজাপতির বেঁচে থাকার সময়টা। একটি পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি গড়ে দুই সপ্তাহ বাঁচলেও কোনো কোনো প্রজাতির প্রজাপতি, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার হেলিকোনিয়াস এরাটো, টাইগেটিস মারমেরিয়া এবং ইউরোপের গোনেপটেরিক্স আরহামনি নামের প্রজাপতি বাঁচে এক বছরের কিছু কম সময়। গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় একটি প্রজাপতির জীবনকাল হয় মাত্র তিন সপ্তাহের। আবার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে একটি প্রজাপতির এক থেকে দুই প্রজন্ম শেষ হয় মাত্র এক বছরের মধ্যে! অন্যদিকে মেরু অঞ্চলে কয়েক প্রজাতির প্রজাপতি আছে, যারা দুই বছর পর্যন্ত বাঁচে। নাম বাটারফ্লাই কিভাবে হলো

প্রজাপতির ইংরেজি নাম বাটারফ্লাই বলেই জানি। কিন্তু অনেক আগে তার আসল নাম ‘বাটারফ্লাই’ ছিল না, ‘ফ্লাটারবাই’ ছিল। এখন অবশ্য সবার কাছে সে বাটারফ্লাই নামেই পরিচিত। প্রজাপতি হলো মাছি প্রজাতির এক ধরনের পতঙ্গ। এদের গায়ের রঙ মাখনের মতো। অনেকের বিশ্বাস, মাখন রঙের মাছি অর্থাৎ বাটার-কালারড-ফ্লাই থেকেই বাটারফ্লাই শব্দটির জন্ম। প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় ‘বাটারফ্লাই’ শব্দটিকে বলা হতো ‘বাটারফ্লোয়েজ’। আবার প্রাচীন ডাচ ও জার্মান ভাষায় বলা হতো ‘বাটারফ্লিয়েজ’। সব শব্দের অর্থ কিন্তু একই- বাটারফ্লাই। জার্মান ভাষায় বাটারফ্লাইয়ের আরেক নাম হলো ‘মিলচদিয়েব’। এই শব্দটির ইংরেজি রূপ হলো ‘মিল্ক-থিফ’। বাংলা করলে দাঁড়ায় দুধ-চোর! কি অদ্ভুত নাম, তাই না? এমন নামের আসল ব্যাপার কি জানো? বাটারমিল্ক বা ঘোলের গন্ধ প্রজাপতির খুব প্রিয়। কোথাও ঘোলের গন্ধ পেলে ওরা সেখানে দলবেঁধে ছুটে যায়। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে পূর্ব ইউরোপের

অনেক এলাকায় একসময় প্রজাপতির চাষ করা হতো! শোনা যায়, প্রজাপতির খামার করার এ ব্রাউন বাটারফ্লাই

পদ্ধতি পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে এখনো চালু আছে। সে যা হোক, গায়ের রঙ মাখনের মতো কিংবা বাটারমিল্কের প্রতি ভীষণ টান থাকার কারণেই প্রজাপতির ইংরেজি নাম হয়েছে ‘বাটারফ্লাই’। প্রজাপতির কত নাম আমরা যে মাছি বা পতঙ্গকে প্রজাপতি নামে চিনি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার কিন্তু আরো অনেক নাম আছে। স্পেন ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে প্রজাপতিকে ডাকা হয় ‘ম্যারিপোসাস’ নামে। পর্তুগাল ও ব্রাজিলে ডাকা হয় ‘বরবোলেটাস’ নামে। ফ্রান্সে ‘প্যাপিললনস’, রাশিয়ায় ‘ব্যাবোচকা’, আমেরিকায় ‘টিটারনিগ’ ও নাইজেরিয়ায় ডাকা হয় ‘ওলুকওলোমবুকা’ নামে। নতুন প্রজাতির নামকরণ প্রাণিজগতে নতুন প্রজাতির কোনো প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গেলে সেটি কোন্ প্রজাতির তা জানার জন্য তার একটি নমুনা পাঠাতে হয় খ্যাতনামা কোনো শ্রেণীকরণবিদ বা ট্যাক্সোনমিস্টের কাছে। প্রজাপতির বেলায়ও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। খুঁজে পাওয়া প্রজাপতির ডানা, পা ও অ্যান্টেনা বা শুঁড়ের গঠন-কাঠামো পরীক্ষা করে শ্রেণীকরণবিদ খুব তাড়াতাড়ি নতুন প্রজাপতি কোন্ প্রজাতির, তার পরিবার এবং উপ-পরিবার কি সেটা বের করে ফেলেন। শুধু ডানার শিরা-উপশিরা পরীক্ষা করেও প্রজাতি নির্ণয় করা যায়। যদি দেখা যায়, নতুন পাওয়া প্রজাপতির শিরা-উপশিরার গঠন একক ধরনের তাহলে সেটাকে নতুন প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায়, নতুন পাওয়া প্রজাপতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য খুব পরিচিত কোনো প্রজাতির সঙ্গে অনেকটা মিলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সঠিক প্রজাতি নির্ণয় করার জন্য নমুনা অংশটির ব্যবচ্ছেদ করা হয় এবং পরিচিত প্রজাতিটির প্রজনন অঙ্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আবার মাইক্রোস্কোপিক বা আণুবীক্ষণিক পরীক্ষার মাধ্যমে ডানার গঠন এবং ডিএনএ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও প্রজাতি নির্ণয় করা যায়। যদি দেখা যায় প্রজাতিটি সত্যিই নতুন, তাহলে শ্রেণীকরণবিদ প্রজাপতিটির জন্য একটি লাতিন নাম ঠিক করে নতুন প্রজাতিটির বিশদ বিবরণ ও নামসহ খ্যাতনামা কোনো বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেন। যেভাবেই প্রজাতি নির্ণয় করা হোক না কেন, নতুন প্রজাতিটির নাম কি হবে সেটা ঠিক করা হয় কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন কোনো কোনো প্রজাতির নাম করা হয় গ্রিক দেবতাদের নামে, আবার যে জায়গায় নতুন প্রজাতিটি পাওয়া গেল সেই জায়গার নাম অনুসারেও নামকরণ করা হয়। কখনো কখনো বিখ্যাত কোনো শ্রেণীকরণবিদের নামেও নামকরণ করা হয়। নতুন প্রজাতিটির গায়ের বা ডানার রঙ অনুসারেও নামকরণ হয়ে থাকে। এমনকি নতুন প্রজাতিটি যে খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করে, সেই খাবারের নাম অনুসারেও নামকরণ করা হয়। প্রজাপতির ডিম

পারতপক্ষে নিজের এলাকার কয়েকটি নির্দিষ্ট গাছ ছাড়া এরা ডিম পাড়ে না। আবার কিছু প্রজাপতি একটা নির্দিষ্ট ধরনের গাছ ছাড়া অন্য কোনো গাছে ডিম পাড়ে না। গাছের পাতায়

মনার্ক বাটারফ্লাই

ডিমগুলো আঠার মতো লেগে থাকে। কয়েক সপ্তাহ পর তা থেকে জন্ম নেয় প্রজাপতির লার্ভা অর্থাৎ শুঁয়ো পোকা। এই শুঁয়ো পোকা জন্মের পর থেকে দিন-রাত খাবার খোঁজে আর খেয়েই কাটিয়ে দেয়। গাছগুলোই বা কম কিসে? প্রজাপতিকে তাদের পাতায় ডিম পাড়তে দেবে না। শুঁয়ো পোকা বের হয়ে শেষকালে সব পাতা খেয়ে সাবাড় করে দেবে, সে জন্য এক ধরনের আঙুর গাছের পাতা তাদের পিঠে একসঙ্গে বেশি ডিম পাড়ার জায়গা দিতে চায় না। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি ডিম হলে পাতার ওই অংশটা শুকিয়ে গিয়ে ডিমসহ মাটিতে পড়ে যায়। নিজের নাক কেটে হলেও পরের যাত্রা ভঙ্গ করা ছাড়া আর কী? আত্মরক্ষা শুঁয়ো পোকা থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে পরিণত হওয়ার মাঝের ধাপটি হলো পিউপা। এ পর্যায়ে এসে এরা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে পাতার নিচে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। পিউপা অবস্থায় টিকে থাকার জন্য কখনো কখনো মিত্রপক্ষ পিঁপড়ার সাহায্য নেয়। পিঁপড়া এদের অন্য পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, আর বিনিময়ে পিউপা এক ধরনের চিনির মতো মিষ্টি রস তৈরি করে, যা পিঁপড়ার প্রিয় খাদ্য। এ অবস্থা থেকে প্রজাপতিতে পরিণত হলেই সুন্দর পাখা গজায় ও মাথার কাছে থাকে দুটি শুঁড়। এগুলোর নাম অ্যান্টেনা, যেটি কাজে লাগায় স্পর্শ করতে বা স্বাদ-গন্ধ নেওয়ার জন্য। সুন্দর এ প্রাণীটির প্রতি কমবেশি সবাই আকৃষ্ট হয়, তাই নিজেকে রক্ষার জন্য একটু চালাকির আশ্রয় নেয়। প্রজাতিভেদে কারো কারো বিষও থাকে। তবে সবার তো আর সেটি নেই। তাই নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্য অদ্ভুত সব উপায় বের করে। নিরীহ প্রজাপতি কখনো রং-ঢং বদলে অবিকল বিষওয়ালা প্রজাপতির রূপ নেয়। তখন পারতপক্ষে তাকে আর ঘাঁটাতে আসে না শত্রুপক্ষ। একে বলে মিমিক্রি করা।

ডোরাকাটা ডানার এক ধরনের প্রজাপতি বসে থাকলে কোন্টা সামনের দিক আর কোন্টা পেছনের দিক- ঠিকমতো ঠাওর করা যায় না। বোকা বানানোর জন্য সামনের অ্যান্টেনার পেছনের দিকে ছোট লেজ থাকে। পাখি ভুল করে পেছন থেকে খেতে আসে। ততক্ষণে সে মাথা বাঁচিয়ে পগারপার। দক্ষিণ আমেরিকার এক ধরনের প্রজাপতি নিতান্ত ভালো মানুষটির মতো গাছের কাণ্ডে বসে থাকে। যেই না কেউ ধরতে গেল, অমনি ঘুরে উল্টোপাশে চলে যায়। মানুষটা ঘুরে ওপাশে যেতে যেতে সে আবার এপাশে চলে আসে। যতক্ষণ না মানুষটা ক্লান্ত হচ্ছে ততক্ষণই চলতে থাকে লুকোচুরি খেলা। এমনিতে সারা দিন একা একা ঘুরে বেড়ালেও বিশ্রামের সময়টায় সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়। যেখানে সব সময় বিশ্রাম নেয়, সেই জায়গাটা ভালোই মনে থাকে। সবাই একসঙ্গে বসে বিশ্রামের আরেকটা কারণও আছে। যদি কোনো পাখি একটাকে ধরে খেয়েও ফেলে তবে বিস্বাদ মনে হলে অন্যদের হয়তো ছুঁয়েও দেখবে না। এভাবে বেঁচে যেতে পারে অন্যরা। সেই অর্থে প্রজাপতির কান না থাকলেও ডানার নিচে ‘কানসদৃশ' পর্দা দেখা যায় যেটা উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ আলাদা করে চিনতে পারে। সব প্রজাতির কিন্তু আবার তা থাকে না। খাবারদাবার প্রজাপতি প্রধানত ফুল থেকে ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে। ওরা ফুল থেকে নলের মতো এক ধরনের মুখোপাঙ্গ বা প্রোবোসিস দিয়ে মধু চুষে খায়। কোনো কোনো প্রজাপতি আবার পরাগরেণু খায়। কোনো কোনো প্রজাপতি খায় গাছের রস, পচা ফল, এমনকি গোবরের রস। বালির মধ্যে আটকে থাকা খনিজ পানি, পাতায় জমে থাকা শিশির, শরবত, এমনকি মানুষের শরীরের ঘাম পর্যন্ত খায় প্রজাপতি। তবে যা-ই খাক, সেটা অবশ্যই তরল। ওদের বাচ্চারা একেবারে উল্টো। ওরা খায় কঠিন দ্রব্য, বিশেষ করে গাছের পাতা, এমনকি ফল কামড়ে খেয়ে ওরা বড় হয়। আর দক্ষিণ আমেরিকার প্রজাপতি মরা মাছ, ইকুয়েডরে মৃত সাপ ও ব্যাঙ এবং ভেনিজুয়েলায় বিষাক্ত টারানটুলার লাশ থেকে রস খেয়ে বাঁচে। কত প্রজাতির প্রজাপতির বাস পৃথিবীতে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া গেছে প্রায় ১৭ লাখ প্রজাতির প্রাণীর। তার মধ্যে প্রজাপতি ও মথের সংখ্যা দুই লাখ ৫৩ হাজার ৬৮০। অন্যদিকে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘বাটারফ্লাইজ অব মেক্সিকো অ্যান্ড ইউএসএ’ নামের একটি বইয়ে বলা হয়েছে, প্রজাপতি ও মথের সংখ্যা

প্রায় ১৪ হাজার ৭৫০। আবার ২০০৭ সালে প্রকাশিত এড্রিয়ান হসকিন্সের লেখা ‘ওয়ার্ল্ড বটারফ্লাই সেনসাস’ নামের বইয়ে প্রজাপতি ও মথের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৭ হাজার ৬৫৭। আসল কথা হলো, প্রজাপতি ও মথের মোট সংখ্যা

কত, এটা সঠিক করে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব

মনার্ক বাটারফ্লাই কালিমা লিম্বোর্গি

নয়। কারণ এর মধ্যে অনেক প্রজাতি যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে তেমনি অনেক নতুন প্রজাতির খোঁজও পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সব মিলিয়ে প্রজাপতি ও মথের প্রজাতির সংখ্যা ২১ হাজারের বেশি হবে না। গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় কেন বেশি দেখা যায় কোন্ প্রাণী পৃথিবীর কোন্ অঞ্চলে বেশি দেখা যাবে সেটা নির্ভর করে সেই প্রাণীটির জৈবিক অবস্থা এবং জলবায়ুর ওপর। যেমন পেরু নামের দেশটির কথাই ধরা যাক। পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে পেরুতে সবচেয়ে বেশি প্রজাতির প্রজাপতির দেখা পাওয়া যায়। কারণ এটা এমন একটি দেশ, যেখানে মরুভূমি যেমন আছে তেমনি আছে তৃণভূমি এবং মেঘ ও বৃষ্টিপ্রধান বনাঞ্চল। যে প্রজাতির জন্য যে ধরনের পরিবেশ ও খাবার দরকার তার সবই পাওয়া যায় পেরুতে। শুধু পেরু নয়, এ ধরনের পরিবেশ যেসব অঞ্চলে বিদ্যমান সেসব এলাকায়ই প্রজাপতি বেশি পাওয়া যায়। বসবাসের জন্য এ ধরনের পরিবেশ না পেলে প্রজাপতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনেকে তাই বেঁচে থাকার তাগিদে গ্রীষ্মপ্রধান ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পাড়ি জমায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যে প্রজাপতি একটা-দুটো নয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এমন প্রজাপতি আছে অনেক। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মনার্ক, টাইগার, লং টেইল্ড ব্লু ল্যাম্পিডিস এবং স্মল হোয়াইট পিয়েরিস র‌্যাপি। তবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যে প্রজাপতি, তার নাম পেইন্টেড লেডি ভ্যানেসা কারদুই। উত্তর আমেরিকার আলাস্কা থেকে মেক্সিকো এবং দক্ষিণের ক্যারিবিয়ান দ্বীপ থেকে ভেনিজুয়েলার সব জায়গায়ই এদের পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে এদের দেখা যেত ইউরোপ, এশিয়ার উষ্ণ এলাকা, আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, আরব এবং ভারত উপমহাদেশের শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত।

টাইগার বাটারফ্লাই

থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, বোর্নিও, সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও এদের দেখা পাওয়া যায়।    

প্রজাপতির বিশ্রাম

প্রজাপতি মাথা নিচু করে বিশ্রাম নেওয়ার বেশ কয়েকটি যুক্তি আছে। ওদের শত্রুর কোনো অভাব নেই। দুরন্ত বালক থেকে শুরু করে অনেক পোকামাকড়ই ওদের তাড়া করে ফেরে। ফলে ওরা কোথাও বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। যে কোনো সময় বিমানের বেগে উড়ে পালাতে হতে পারে জেনেই ওরা কোনো কিছুর ওপর বসার সময় মাথা নিচু করে ডানা পিঠের ওপর খাড়া করে রাখে। প্রজাপতি বেশির ভাগ সময় গাছের গুঁড়ির ওপর বসে। এ অবস্থায় ডানা দুটো পিঠের ওপর খাড়া করে রেখে মাথা নিচু করে রাখার কারণে নিচের দিকে কী হচ্ছে তার সব খবর রাখা যায়। তা ছাড়া এই ভঙ্গিতে বসার কারণে প্রজাপতির ডানা খুব সহজেই সূর্যের আলো শোষণ করে প্রজাপতিকে উষ্ণ হতে সাহায্য করে। বৃষ্টির সময় কোথায় যায়

বৃষ্টির সময় এভাবেই বিশ্রাম নেয় ওরা

রোদ ঝলমল দিনে এখানে-ওখানে অনেক প্রজাপতির দেখা মিললেও বৃষ্টির সময় ওদের কোথাও দেখা যায় না। আসলে বৃষ্টি আসার আগেই আশপাশের কোনো গাছের পাতার নিচে আশ্রয় নেয়! ভেজা ভেজা বাতাস কিংবা ঝড়ো বাতাস দেখলেই ওরা বুঝতে পারে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। তার আগেই ওরা গাছের পাতার নিচে আশ্রয় নেয়। বৃষ্টির সময় সব প্রজাপতিই যে গাছের পাতার নিচে আশ্রয় নেয় তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ অন্য প্রাণীর গর্তে গিয়েও আশ্রয় নেয়। যেমন পিকক নামের প্রজাপতি বৃষ্টি আসার কয়েক ঘণ্টা আগেই খরগোশের গর্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। আবার কেউ আছে গাছের খোড়লে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ ধরনের একটি প্রজাপতি হলো কম্মাস। অরেঞ্জ টিপ নামের প্রজাপতি লুকায় কোনো ফুলের পাপড়ির ভেতরে গিয়ে। ব্লুজ, ব্রাউন ও স্কিপার নামের প্রজাপতিরা লুকায় ঘন ঘাসের ভেতরে। যাযাবর প্রজাপতি প্রজাপতি খুবই দুর্বল আর ক্ষণজীবী প্রাণী। তার পরও যাযাবর পাখির মতো দূর থেকে দূরে উড়ে বেড়ানো এদের কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। অবশ্য যাযাবর পাখির মতো তারা যে জায়গা থেকে উড়ে আসে সেখানে আর ফিরে যেতে পারে না। নতুন জায়গায় এবং কখনো কখনো পথেই তাদের মৃত্যু হয়। বেঁচে থাকার জন্য সব সময় একটু ভালো পরিবেশের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। যেখানে পছন্দ হয় সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে। সবাই মিলে গড়ে তোলে বিশাল প্রজাপতি কলোনি। প্রাকৃতিক নানা বাধা যেমন বিশাল সাগর, মরুভূমি কিংবা সুউচ্চ পাহাড় চূড়ার কারণে ওদের অনেকেই দূরে কোথাও পাড়ি জমাতে পারে না। কারো কারো কাছে এসব কোনো বাধাই নয়। তারা ঠিকই সব বাধা ডিঙিয়ে নতুন জায়গায় গিয়ে বসতি গড়ে। যাযাবর প্রজাপতির মধ্যে বিখ্যাত হলো মনার্ক প্রজাপতি। প্রতিবছর কানাডা থেকে মেক্সিকোতে পাড়ি দেয় এরা। কত উঁচুতে উড়তে পারে সবচেয়ে বেশি উঁচুতে উড়তে পারা প্রজাপতির নাম স্যাটাইরিন প্যারালেসা নেপালিকা। এটার সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৮৩ সালে। নেপালের ‘সেই ফোকসুন্দ ন্যাশনাল পার্ক’-এর ১৪ হাজার ৮০০ ফুট ওপরে সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এ প্রজাপতিটির। আনকমপাহগ্রে ফ্রিটিলারি বোলোরিয়া ইমপ্রোবা অ্যাক্রোনেমা নামের আরেকটি প্রজাপতি জীবনের বেশির ভাগ সময় পার করে ভূমি থেকে প্রায় ১৪ হাজার ২০০ ফুট ওপরে। আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের সান জুয়ান পর্বতের চূড়ায় ওদের বসবাস। ওড়াউড়িতে পেইন্টেড লেডি ভানেসা কারদুই নামের প্রজাপতিও কম যায় না। যেখানেই থাকে সব সময় প্রায় ১৪ হাজার ফুট ওপর দিয়ে চলাফেরা করে! প্রজাপতির রঙ রঙ দিয়েই চেনা যায় প্রজাপতি। একেক প্রজাপতির একেক রঙ। রঙ মানে পাখায় পাখায় নানা রঙের নকশা। এক জাতের সঙ্গে অন্য জাতের প্রজাপতির রঙ ও নকশা কখনোই মেলে না, এমনকি একই প্রজাপতির পুরুষ ও স্ত্রী প্রজাপতির রঙের মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য থাকে। তা না হলে তো স্ত্রী ও পুরুষ চেনাই মুশকিল হয়ে যেত। তবে প্রজাপতিদের রঙের দরকার আছে। প্রজাপতিদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় ওই রঙ দিয়েই। রঙ দিয়েই একই প্রজাতির প্রজাপতিরা একে অপরকে চিনতে পারে। এমনকি কোনো কোনো প্রজাপতি রঙ দিয়েই শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে পাখার ওপরের পাশ ও নিচের পাশ কখনো একই রঙের হয় না। ওপরের পাশ হয় চকচকে এবং নিচের পাশ হয় ধূসর বা মলিন। সব প্রজাপতিরই চারটি পাখা থাকে। এরা এদের পেছনের পাতলা পাখা জোড়া সামনেরগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে রাখে। মাছের গায়ে যেমন আঁশ থাকে, প্রজাপতির পাখায়ও অমন শত-সহস্র আঁশ থাকে। তবে সেগুলো মাছের মতো শক্ত আর বড় নয়, রেশমের মতো কোমল আর ক্ষুদ্র। খালি চোখে সেসব আঁশের আকার-আকৃতি সহজে বোঝা যায় না। ইংরেজিতে এসব আঁশকে বলে স্কেল। প্রজাপতির রঙরহস্যের মূলে রয়েছে এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আঁশ। এসব আঁশ মেলানিন নামে এক ধরনের পিগমেন্ট বা রঞ্জক পদার্থ দ্বারা রঞ্জিত থাকায় তা পাখায় কালো ও বাদামি রঙ সৃষ্টি করে। কিন্তু লাল, নীল, সবুজ, হলুদ- এসব রঙ আসে কোথা থেকে? এগুলো কিন্তু

প্রজাপতির পাখার রঙিন কাজ

কোনো পিগমেন্ট দিয়ে হয় না। আঁশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশই এসব রঙের সৃষ্টি করে থাকে। আঁশের মধ্যে এক ধরনের আলোক স্ফটিক বা ফোটোনিক ক্রিস্টাল প্রকৃতি আছে। তাই সূর্যের আলো আঁশে পড়ামাত্রই আঁশের মাইক্রো-স্ট্রাকচারাল প্যাটার্নের অর্থাৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র  বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে আলোকরশ্মির এক বর্ণিল বিচ্ছুরণ ঘটে। আর তার প্রভাবেই আমরা নানা প্রজাপতিকে দেখি নানা রঙে। এসব আঁশ এতো সূক্ষ্ম, হালকা ও আলগা যে তুমি প্রজাপতির পাখায় আঙুল ছোঁয়ালেই সেগুলো গুঁড়োর মতো তোমার আঙুলে লেগে যাবে। আর তাতে নষ্ট হয়ে যাবে প্রজাপতির রঙ ও সৌন্দর্য। হয়তো ওকে আর চেনাই যাবে না। রঙিন ডানার কাজ

ইশ! এক্ষুনি ধরতে ইচ্ছে করছে

রঙিন প্রজাপতি দেখলে অনেকেই তার পিছু ধাওয়া করে। কিন্তু তাকে মুঠোবন্দি করা অত সহজ নয়, যত সহজ এক রঙা প্রজাপতি ধরা। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রজাপতির রঙিন ডানা চোখ হিসেবে কাজ করে! কেউ যখন তাকে ধরতে যায়, সে তা দেখতে পেয়েই উড়ে যায়। এ কারণেই সহজে ওদের নাগালে পাওয়া যায় না। প্রজাপতির ডানায় হরেক রঙের ছটা দেখে অনেক সময় পাখি ও অন্যান্য প্রাণী ভয় পায়। ভয়ে ওরা রঙিন প্রজাপতিকে ভুলেও ঘাঁটাতে চেষ্টা করে না। এক ধরনের প্রজাপতি আছে, যাদের ডানায় আয়নার মতো ছোট-বড় অসংখ্য চোখ থাকে। না, এই চোখ দিয়ে প্রজাপতি কিছু দেখতে পায় না। তবে ওরা যখন বুঝতে পারে কোনো প্রাণী তাদের আক্রমণ করতে আসছে, তখন ডানা মেলে আয়নার মতো রঙিন চোখে ভয় দেখায়। বেশির ভাগ সময় ওরা এভাবেই শত্রুর কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করে থাকে। অপকারী নাকি পরোপকারী? অধিকাংশ প্রজাপতি উপকার করে। প্রজাপতি ফুল থেকে ফুলে মধু আহরণের সময় পরাগায়ন ঘটিয়ে বীজ উৎপাদনে সাহায্য করে। তবে এর কীড়া অবস্থা ক্ষতিকর। কেননা এ দশায় কীড়া বিভিন্ন গাছ তথা ফসলের পাতা খেয়ে ক্ষতি করে। সবচেয়ে বড় ও ছোট

সবচেয়ে ছোট প্রজাপতি

সবচেয়ে বড় প্রজাপতি

বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রজাপতির নাম কুইন আলেক্সান্দ্রাস বার্ডউইং। এ প্রজাপতির পাখার বিস্তার প্রায় এক ফুট বা ৩০ সেন্টিমিটার। পাপুয়া নিউগিনির কদল বনে এদের দেখা যায়। আর বিশ্বের সবচেয়ে ছোট প্রজাপতি হচ্ছে ওয়েস্টার্ন পিগমি ব্লু। এদের আবাস আফ্রিকায়। এ প্রজাপতির পাখার বিস্তার আধা ইঞ্চিরও কম।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ