প্রাণ ফিরুক মাঠে -আবু আবদুল্লাহ

প্রাণ ফিরুক মাঠে -আবু আবদুল্লাহ

বিশেষ রচনা জুলাই ২০২০

এই লেখা যখন লিখছি ততদিনে ক্রীড়াঙ্গনে কিছুটা আশার আলো ফুটতে শুরু করেছে। নিকশ কালো অন্ধকার সরিয়ে কিছুটা হলেও আলোর রেখা দেখা দিয়েছে। এর আগে টানা প্রায় তিন মাস বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন ছিলো প্রাণহীন। রেফারির বাঁশি বাজেনি, গো...ল বলে ভাষ্যকারের উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা যায়নি। ছিল না বোলার-ফিল্ডারদের ‘হাউ ওয়াজ দ্যাট’ চিৎকার। ছিলো না গ্যালারির দর্শক গর্জন। টেলিভিশনে ছিলো না লাইভ খেলা সম্প্রচার। শুধু ক্রীড়াঙ্গন নয়, পুরো বিশ্বব্যবস্থাই থমকে গিয়েছিল করোনাভাইরাসের মহামারীতে। প্রতিদিন অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষ আর লাশের সংখ্যা গোনাই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে বড় খবর। তবে এটি যেহেতু খেলার পাতা, আমরা তাই শুধু ক্রীড়াঙ্গনের বিষয়গুলোই নিয়ে আলোচনা করবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রীড়াঙ্গনে এমন দুর্যোগ আর আসেনি। একসাথে সব খেলাধুলা বন্ধ হয়ে যাওয়া আগে কখনো দেখেননি এখনকার দর্শকরা। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই সংক্রামক ব্যাধি সেটাই দেখালো বিশ্বকে। চীন থেকে করোনাভাইরাস ইউরোপে আঘাত হানার পরই সারা বিশ্ব আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে করোনা আঘাত হানে ক্রীড়াঙ্গনে। হাইপ্রোফাইল খেলোয়াড়দের মাঝে ইতালীয় ক্লাব জুভেন্টাস ও ইতালি জাতীয় দলের ডিফেন্ডার দানিয়েল রোগানি প্রথম আক্রান্ত হন করোনাভাইরাসে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোসহ ক্লাবটির সব খেলোয়াড়কে পাঠানো হয় হোম কোয়ারেন্টিনে; কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। কয়েকদিন পর ব্লেস মাতুইদির শরীরে পাওয়া যায় এই ভাইরাস। তবে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে জুভেন্টাসের আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার পাওলো দিবালাকে। চতুর্থবার টেস্ট করেও দিবালার শরীরে করোনা পাওয়া যায়। পঞ্চমবারে গিয়ে তিনি করোনা নেগেটিভ হন। প্রায় এক মাস করোনার সাথে লড়াই করেছেন দিবালা। তবে শেষ পর্যন্ত করোনাকে কিকআউট করতে পেরেছেন সেটিই স্বস্তির খবর। ইতালীয় ফুটবল লিগ ‘সিরি আ’ ততদিনে স্থগিত হয়ে গেছে।
তবে ক্রীড়াঙ্গনে করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে মার্চের ১৩ তারিখে। ততদিনে ইতালির পর ইংল্যান্ড ও স্পেনেও হানা দিয়েছে করোনা মহামারী। ওই দিন খবর আসে ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব আর্সেনাল এফসির কোচ মিকেল আর্তেতা ও চেলসির স্ট্রাইকার হাডসন ওডিও করোনা পজিটিভ। এই খবরটিতেই মূলত ক্রীড়াঙ্গনের কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। তখন শ্রীলঙ্কা সফরে ছিলো ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল। লঙ্কান বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের প্রস্তুতি ম্যাচ চলছিলো গলে স্টেডিয়ামে; কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচের দ্বিতীয় দিন খেলার মাঝপথেই মাঠ ছেড়ে হোটেলে ফেরে ইংল্যান্ড দল। সেখান থেকে সোজা বিমানবন্দরে গিয়ে ইংল্যান্ডের বিমানে ওঠে জো রুটের দল।
সেদিনই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল স্থগিতের ঘোষণা দেয় লিগ কর্তৃপক্ষ। ওদিকে ভারত সফররত দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের একটি ম্যাচ খেলেই সিরিজ বাতিল করে দেশে ফেরে। পিছিয়ে দেওয়া হয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) বিদেশী ক্রিকেটারদের ছুটি দেওয়া হয়। দুই-তিন দিন পরে অবশ্য আইপিএল, পিএসএল দুটোই স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তী কয়েক দিনে সারা বিশ্বের সব ক্রীড়া ইভেন্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। নিউজিল্যান্ড দল দেশে ফিরে যায় অস্ট্রেলিয়া থেকে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল, মহিলা ফুটবল লিগসহ সব খেলা স্থগিত হয়ে যায়। স্থগিত হয় টাইগারদের পাকিস্তান সফর।
তবে মে মাসের মাঝামাঝিতে এসে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির আভাস দেখা দেয়। টানা লকডাউনে ইউরোপে কমে আসে সংক্রমণের হার (যদিও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে তখনও বাড়তে থাকে)। সংক্রমণ কমে আসায় আশাবাদী হয় ইউরোপের ক্রীড়াঙ্গন। তারচেয়েও বড় কথা মানুষ বুঝতে পারে যে, এই করোনাভাইরাসের সাথে মানিয়ে চলা শিখতে হবে তাদেরকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়ে দেয়, করোনাভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব নয়। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চললেও সেটি অনেক সময় সাপেক্ষ; কিন্তু ততদিন তো আর জনজীবন লকডাউন করে রাখা সম্ভব নয়। তাতে ধসে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। তাই করোনাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রেখে জীবনযাত্রা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নেয় সবাই। ক্রীড়াঙ্গনের কর্মকর্তারাও সেটি উপলব্ধি করেন।
এরপর সবার আগে মাঠে গড়ায় জার্মানির সর্বোচ্চ ফুটবল লিগ বুন্দেসলিগা। তবে অনেক বিধিনিষেধের বেড়াজালে শুরু হয় লিগ। খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ ও কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের করোনা টেস্ট করানো হয়। অনুশীলনে নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। মাঠে দর্শকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। অর্থাৎ খালি গ্যালারিতেই শুরু হয় বুন্দেসলিগা। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি দর্শক দুই মাস পর টিভিতে লাইভ খেলা দেখার সুযোগ পান।
জার্মানির লিগ শুরু হওয়া দেখে আশাবাদী হয় ইংল্যান্ড ও স্পেনের ফুটবল কর্তৃপক্ষ। শুরুতে খেলোয়াড়দের পৃথক অনুশীলন, এরপর ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ অনুশীলনের অনুমতি দেওয়া হয়। জুনের মাঝামাঝি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও স্প্যানিশ লা লিগা শুরুর তারিখ ঠিক করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ঘরোয়া ক্রিকেট শুরুর পরিকল্পনা হয়। আর আগস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার তারিখ ঘোষণা করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। পাকিস্তান দল ইংল্যান্ড সফরের পরিকল্পনা করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডের সাথে সিরিজ খেলার আলোচনা শুরু করে। সব কিছু মিলে তাই ক্রীড়াঙ্গনে আশার আলো দেখা দেয়। করোনাকে এড়িয়েই খেলা মাঠে ফেরানোর বিষয়ে উদ্যোগী হন ক্রীড়াঙ্গনের কর্মকর্তারা। দর্শকরাও দেখতে শুরু করেন আশার আলো। শুরুতে অবশ্য সব খেলাই দর্শকশূন্য গ্যালারিতে হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।
দর্শকহীন গ্যালারি মানে প্রাণহীন ক্রীড়া আসর। কারণ দর্শকরাই খেলার প্রাণ। যাদের উদ্দেশে খেলা হবে তারাই যদি গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে প্রিয় দলের পক্ষে চিৎকার করে গলা ফাটাতে না পারেন, প্রিয় তারকাদের উৎসাহ দিতে না পারেন- তবে সেই খেলা নিষ্প্রাণ। তবে করোনা মহামারীকে তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ ধরে নিয়েই মাঠে খেলা ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। দর্শকরা তবুও তো ঘরে বসে টিভিতে খেলা উপভোগ করতে পারবেন! তাতে কিছুটা হলেও তো তৃপ্তি পাওয়ার সুযোগ থাকবে। এই লেখা তোমাদের হাতে পৌঁছতে পৌঁছতে করোনাকে পেছনে ফেলে যেন পুরো মাত্রায় শুরু হয় সব ক্রীড়া ইভেন্ট। প্রাণ ফিরে আসুক মাঠে, সেটাই প্রত্যাশা।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ