প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ

প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ

স্মরণ অক্টোবর ২০১৩

ডা. মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম

অবিভক্ত ভারতে যেসব জনদরদী মনীষী ও জনপ্রিয় নেতা এ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো বিস্তারে আজীবন সংগ্রাম ও ত্যাগ কুরবানি স্বীকার করেছেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৯) তাঁদের  মধ্যে অন্যতম। ব্রিটিশ বিরোধী আজাদী আন্দোলনের সক্রিয় সিপাহসালার, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল, সমাজ সংস্কারক, জ্ঞানতাপস, রাজনীতিক, শিশু সাহিত্যিক, বিশ্বপর্যটক, স্বার্থক অনুবাদক, মানুষের কল্যাণে আজীবন নিবেদিত, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, সাবেক এমএনএ, বাংলাভাষাপ্রেমী ও একুশে পদক বিজয়ী সাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। শিক্ষা-দীক্ষায় বঞ্চিত বাংলার গণ-মানুষের করুণ ছবি তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল। অতি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শাসিত ও শোষিত বাংলায় শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া বাংলা ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে উন্নতির পথে পরিচালনা করতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন। তাইতো তিনি এগিয়ে আসেন কঠিন সংগ্রামে। শিক্ষার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সমাজকল্যাণ ও শিক্ষা বিস্তারকে জীবনের প্রধান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি একজন সুসাহিত্যিক হিসেবেও দেশ এবং জাতির খেদমত করেছেন। টাঙ্গাইলের করটিয়া সাদত কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, ঢাকার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা একাডেমীর অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারির দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার স্থপতি, স্বাপ্নিক ও রূপকার প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। ইবরাহীম খাঁর ডাক নাম ছিল খাজা মিয়া। ‘খাজা’ ছদ্মনামে তাঁর কিছু রচনাও প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। এ মহান কর্মবীর ১৮৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার অন্তর্গত বিরামদি (বর্তমান শাবাজনগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম খাঁর পিতা শাবাজ খাঁ ফশলান্দী হতে বিরামদি গ্রামে এসে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত। মাতা রতœা খানম। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ। ইবরাহীম খাঁ ফশলান্দীর পাঠশালা থেকে নিম্নপ্রাইমারি এবং লেকের পাড়া পাঠশালা থেকে উচ্চপ্রাইমারি পাস করেন। ১৯০৭ সালে পিংলা হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে ঐ স্কুল হতে ১৯১২ সালে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পাস করেন। তিনি ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ হতে আইএ এবং ১৯১৬ সালে কলকাতার সেন্ট পালস কলেজ হতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (অনার্স), ১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ১৯২৩ সালে আইন শাস্ত্রে ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯১৭ সালের ১ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বড় বালাশিয়া গ্রামের রইছ মমতাজ উদ্দীন খাঁর ছোট মেয়ে আনজুমন নেছার সঙ্গে ইবরাহীম খাঁর বিয়ে হয়। কর্মজীবনে ইবরাহীম খাঁ ১৯১৯ সালের ১৮ নভেম্বর করটিয়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। ১৯২৩ সালের মাঝামাঝি শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে ময়মনসিংহ শহরে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে আটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া)-এর সৌজন্যে ‘সাদত কলেজ’ প্রতিষ্ঠায় হাত দেন। ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। একটানা ২২ বছর (১৯২৬-১৯৪৮) তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অবিভক্ত বাংলা ও আসামে সাদত কলেজ মুসলিম প্রতিষ্ঠিত প্রথম কলেজ এবং ইবরাহীম খাঁ ছিলেন প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল। ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর সরকারের আমন্ত্রণে তিনি পূর্ব বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৩ সালের ১৪ জুলাই অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ভূঞাপুরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের সহযোগিতায় বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৬  থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রাদেশিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন ইবরাহীম খাঁ। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনে (১৯২০-১৯২২) সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইবরাহীম খাঁ  রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায়, ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান গণপরিষদ এবং ১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পার্লামেন্টে তিনি একজন রসিক বক্তা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী নীতির প্রতিবাদে ‘সিতারায়ে খিদমাত’ উপাধি বর্জন করেন। একজন গবেষক ও কৃতী লেখক হিসেবে ইবরাহীম খাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি বিভিন্ন লেখায় মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের কথা বলেছেন। অন্ধ গোঁড়ামীর প্রশ্রয় দিতেন না তিনি কখনো। ইসলাম সম্পর্কে তাঁর সঠিক ও গভীর জ্ঞান থেকে এ স্বচ্ছ ধারণা জন্ম নিয়েছিল। সাহিত্যের জগতে তাঁকে জাতিগঠন ও সামাজিক পুনর্গঠন সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা ও কর্মপ্রচেষ্টার পথ প্রদর্শক হতে হয়েছে। কেউ কোনোদিন যাদের কথা ভাবেনি, সে চির অবহেলিত, অধিকার বঞ্চিত, সাধারণ মানুষের মনের কথা তিনি লিখে গেছেন। শুধু লেখেননিÑ হৃদয়ের রক্তে কলম ডুবিয়ে ডুবিয়ে সৃষ্টি করেছেনÑ জহুর ধোপা, ক্ষান্তমাসী, মতিয়া, নসর, গঙ্গারাম চৌকিদার প্রভৃতি চরিত্র। নিম্নস্তরের ও অতি সাধারণ চরিত্রগুলি সৃষ্টি করে এই মহান লেখক মানবিকতার মর্মকথা অকপটে স্বীকার করে গেছেন। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৮০। এর  মধ্যে ১০টির মত নাটক ও বিশখানা শিশু সাহিত্য। এছাড়া আছে গল্প, উপন্যাস, ইসলামী সাহিত্য ও ভ্রমণকাহিনী। তাঁর লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হচ্ছেÑ কামাল পাশা (১৯২৭), আনোয়ার পাশা (১৯৩৯), ঋণ পরিশোধ (১৯৫৫), আলু বোখারা (১৯৬০), ইস্তাম্বুল যাত্রীর পাত্র (১৯৫৪), বাতায়ন (১৯৬৭, ব্যাঘ্র মামা (১৯৫১) এবং বেদুইনদের দেশে (১৯৫৬)। তাঁর স্মৃতিকথা ‘বাতায়ন’ সমকালীন মুসলিম সমাজের জীবন চিত্রের এক বিশ্বস্ত দলিল হিসেবে বিবেচিত। তিনি ব্রিটিশ আমলে ‘খান সাহেব’ ও ‘খান বাহাদুর’ এবং পাকিস্তান আমলে সিতরা ই ইমতিয়াজ, তমঘায়ে কায়েদে আম লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে একুশে পদক পান। ১৯৭৭ সালে কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিশ তাঁকে গণসংবর্ধনা দেয়। ইবরাহীম খাঁ বলতেন, আমাদের শপথ একটাই, আমরা আমাদের ঐতিহ্যের চেতনাকে উচ্চকিতকরণে জ্ঞানের মশালকে করব আরো প্রজ্বলিত। আমাদের শপথ, সাধনা ও সংগ্রাম শুধু এই বিষয়কেই কেন্দ্র করে যা ছিল চাঁদ মিয়ার স্বপ্ন। ইবরাহীম খাঁ উচ্চারণ করেছেন নিজকণ্ঠে : দেহ বিভু এই রব করটিয়ার বুকে জাগিয়ে উঠুক বঙ্গের আলীগড়। খ্যাতনামা কলম সৈনিক, সুসাহিত্যিক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ১৯৭৯ সালের ২৯ মার্চ ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। টাঙ্গাইলে ভূঞাপুরে তাঁর স্বগ্রামে প্রিন্সিúাল ইবরাহীম খাঁ চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ