ফিচার

ফিচার

ফিচার অক্টোবর ২০১০

মৌমাছির অজানা কথা




মৌমাছি সত্যিই এক আশ্চর্য প্রাণী। এরা নিজেরাই বাড়ি তৈরি করে। এবং সেটাকে রীতিমত প্রাসাদই বলা যায়। এই প্রাসাদের কিন্তু একটা নাম আছে। একে বলে মৌচাক (Bee Hive)। মৌমাছিরা এটি তৈরি করে শীত বা অত্যধিক গরম থেকে নিজেদের বাঁচাতে, খাবার জমা রাখতে এবং থাকার জন্য স্থায়ী আশ্রয় হিসেবে। এক একটি মৌচাকে প্রায় ২০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ পর্যন্ত মৌমাছি থাকে। আর তোমরা সবাই তো জানোই এরা খুবই পরিশ্রমী, পরোপকারী ও সামাজিক প্রাণী।
পৃথিবীতে প্রায় ২০,০০০ প্রজাতির মৌমাছি আছে। এদের কেউ একা থাকে আবার কেউ বা থাকে দলবদ্ধভাবে। কেউ প্রচুর মধু জমা করে আবার কেউ একেবারেই করে না। কেউ বা উদ্দাম, পোষ না মানা, ঘুরে বেড়ায় বনে-বাদাড়ে। আবার কেউ কেউ থাকে মানুষের পোষ মেনে। কী অবাক কাণ্ড, তাই না? মৌমাছি আবার পোষ মানবে কিভাবে? কিছু কিছু প্রজাতি কিন্তু আছে, যাদেরকে মানুষ পোষ মানাতে পেরেছে। আরা এই পোষ মানা মৌমাছিদেরকে নিয়েই মৌচাষীরা তৈরি করে মৌ-খামার। বাজারের বেশিরভাগ মধুই কিন্তু আসে এসব খামার থেকে।
অবাক ব্যাপার হচ্ছে এদের মধ্যেও মানুষের মতো শ্রেণীবিভাগ আছে। আছে এক এক শ্রেণীর এক এক ধরনের কাজ।
মৌমাছিদের প্রধানত তিনটি শ্রেণী আছে- রাণী মৌমাছি, রাজা মৌমাছি এবং কর্র্মী মৌমাছি। একটি মৌচাকে এতোগুলো মৌমাছির মধ্যে রাণী থাকে কেবলমাত্র একটি। আর রাজা! তোমরা তো জানো যে একটি দেশে কেবল একজনই রাজা থাকেন। কিন্তু মৌমাছিদের রাজা থাকে কয়েকশো, আর বাকিরা সব কর্র্মী। অবাক হচ্ছো তোমরা? বন্ধুরা, ওদের সমাজটাই যে এ রকমের।
রাণী একজন হলেও সেই কিন্তু মৌচাকের সর্র্বময় কর্র্ত্রী। সবাই তার কথা মেনে চলে। আকারেও এরা অন্যদের চেয়ে বড় হয়, প্রায় ১.৮ থেকে ২.২ সেন্টিমিটার। ডিম ফুটে বেরও হয় তাড়াতাড়ি। মাত্র ১৬ দিনের মাথায় পূর্ণাঙ্গ রাণী ডিম থেকে বের হয়ে আসে। রাণী মৌমাছির কাজ হচ্ছে মৌচাকের বাকি কর্র্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা আর ডিম পাড়া। প্রতিদিন এরা প্রায় ১০০০টিরও বেশি ডিম পেড়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো রাণী ডিম পাড়ে হুল দিয়ে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। মৌমাছিরা হুল দিয়ে আত্মরক্ষাও করে, আবার ডিমও পাড়ে। একটি রাণী মৌমাছি বাঁচেও বেশিদিন, প্রায় চার থেকে সাত বছর। আমাদের কাছে বিষয়টি তেমন কিছু না হলেও ওদের কাছে অনেক কিছু। কারণ, একটি রাজা মৌমাছি বাঁচে মাত্র কয়েকদিন আর একটি কর্র্মী মৌমাছি বাঁচে বড়জোর কয়েক সপ্তাহ মাত্র। একটি মৌচাকে রাণী মৌমাছি থাকে মাত্র একটি। তবে যদি ডিম ফুটে কোনো নতুন রাণী মৌমাছির জন্ম হয়েই যায় সেক্ষেত্রে মৌচাকটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মানে হলো, আগের রাণী মৌমাছি পুরনো কিছু কর্র্মী নিয়ে নতুন চাক বানিয়ে সেখানে চলে যায়।
রাজা মৌমাছিরা ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ হতে সময় নেয় ২৪ দিন। এরা হলো সব কুঁড়ের বাদশাহ। কোনো কাজ করে না, সারাদিন শুধু খায় দায় আর ঘুরে বেড়ায়। বসে বসে খায় বলেই এরা কর্মীদের চেয়ে একটু বড় আকারের হয়, প্রায় ১.৫ থেকে ১.৭ সেন্টিমিটার। রাজা মৌমাছির চোখ আবার অন্যদের থেকে বড় হয়। এটি দিয়েই রাজার সঙ্গে পার্থক্য করা হয় কর্মী মৌমাছির। তবে শুধু বসে বসে খায় বলে, যখন খাবার থাকে না তখন কিন্তু এদের তাড়িয়ে দেয় কর্মী মৌমাছিরা। আরেকটা মজার কথা হলো, রাজা মৌমাছির হুল নেই। তার পরেও বিপদে পড়লে এরা হুল ফোটাতে ছুটে যায় ভোঁ ভোঁ করে। মানে ভয় দেখায় আর কি! যারা চেনে না কোন্টা রাজা মৌমাছি আর কোন্টা কর্মী মৌমাছি, তারা তো ভয় পাবেই।

মৌচাকের যত ধরনের কাজ আছে, তার সবই করে কর্মী মৌমাছি। যেমন ধর, মৌচাকের ঘর (Cell)গুলো পরিষ্কার করা, বাচ্চাদের খাবার দেয়া, মৌচাক তৈরি করা, মধু জমা করা এমনকি মৌচাক রক্ষা করার দায়িত্বও কিন্তু এদের। কর্মী মৌমছিরা আকারে সবচেয়ে ছোট, প্রায় ১.২ থেকে ১.৫ সেন্টিমিটার। ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ হতে এরা সময় নেয় মোটামুটি ২১ দিন। আর পূর্ণাঙ্গ হতে না হতেই কাজে লেগে পড়ে এরা। কর্মীদের প্রথম কাজ হলো মৌচাক মানে ওদের সেই প্রাসাদটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। তারপর করতে হয় বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ। এরপরে আসে মধু সংগ্রহ করে তা জমা করা। এমনকি মৌচাকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করাটিও এই কর্মী মৌমাছিরই কাজ। এরা পাখা দিয়ে বাতাস করে মৌচাকের তাপমাত্রা বাড়াতে বা কমাতে পারে। এভাবে এরা মৌচাকের তাপমাত্রা সবসময়ই ৩৪০ সেলসিয়াস-এর কাছাকাছি রাখে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিটা ওরা আগে থেকেই জানে।
সবচে’ অভিজ্ঞ কর্মীরা থাকে রক্ষণাবেক্ষণ বা গার্র্ডের দায়িত্বে। এরা চাকের চারদিকে ঘোরাঘুরি করে আর মৌচাকের ওপর নজর রাখে। যদি অন্য কোনো মৌচাকের মৌমাছি এসে মধু চুরি করে বা যদি ডাকাত আসে তাদেরকে আটকানোটাই ওদের কাজ। ভাবছো নিশ্চয়ই, মৌমাছিদের মধ্যে আবার ডাকাতও আছে নাকি? হ্যাঁ, তাতো আছেই। আমাদের সমাজের মতো ভালো মন্দ মৌমাছিদের সমাজেও আছে; মৌমাছিদেরও ডাকাত আছে। এরা হল ভীমরুল বা বোলতা। এরা নিজেরা ভবিষ্যতের জন্য কিছু জমা করে না। শুধু মৌমাছির উপর ডাকাতি করেই চলে। গার্র্ড মৌমাছিরাও কিন্তু কম যায় না, ডাকাতি করতে এলেই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের উপর। তখন তারা নিজের জীবনটিরও পরোয়া করে না।
এমনিতে কিন্তু মৌমাছিরা খুবই শান্তিপ্রিয়। বিনা কারণে এরা কাউকেই বিরক্ত করে না। শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্যই এরা হুল ফোঁটায়। তাছাড়া নয়। কারণ কর্মী মৌমাছিরা মাত্র একবারই হুল ফোঁটাতে পারে। এদের হুলের গঠন অনেকটা বড়শির মতো। মানে মাথাটা কাঁটাওয়ালা। একবার কোথাও ফোঁটালে তা আর বের করে নিতে পারে না। হুল ফোঁটানোর পরে ওই কর্মী মৌমাছিটা সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। রাণী মৌমাছিদের হুল আবার সোজা এবং লম্বা। যা প্রধানত ডিম পাড়তেই তারা ব্যবহার করে।
তবে পৃথিবীতে হুল ছাড়াও মৌমাছি আছে। এরকম প্রায় ১৪টি প্রজাতির মৌমাছি আছে এই পৃথিবীতে। এদের পাওয়া যাবে অস্ট্রেলিয়ায়। হুল নেই বলে সেখানকার লোকজন এদের বেজায় ভালোবাসে। আর এদের মধুর স্বাদও একটু অন্যরকম, টক-মিষ্টি, সঙ্গে হালকা লেবুর গন্ধ। তবে এরা মধু জমা করে খুবই কম।
মৌমাছিই যে আমাদের মধু দেয়, সেটা কে না জানে। তবে জানার বিষয় হলো মাত্র ১ পাউন্ড (১ পাউন্ড = ০.৪৫৩৬ কেজি প্রায়) মধু জমা করতে এদেরকে প্রায় ৯০,০০০ কিলোমিটার পথ উড়তে হয় আর ১,০০,০০০ এরও বেশি ফুলে যেতে হয় এই মধুর সংগ্রহে। ভাবো একবার! কী পরিমাণ পরিশ্রম করে তবেই না মৌমাছিরা মধু জমা করে। মজার ব্যাপার হলো, এরা এদের মৌচাক থেকে ২ কিলোমিটারের বেশি দূরে কখনই যায় না। এর বেশি যেতে পারে, তবে ফিরে আসতে পারে না, পথ ভুলে যায়। সেজন্য মৌচাকের আশেপাশে থেকেই এরা এতটা পথ পাড়ি দেয়। অর্থাৎ বার বার যাওয়া আসা করে তবেই এই মধু তারা নিয়ে আসে।

মৌমাছি কিন্তু মধু জমা করে রাখে তাদের বাচ্চাদের খাবার আর ভবিষ্যতের জন্য। জেনে রাখো, মৌমাছিরা কিন্তু রুটিও বানায়। এদের প্রধান খাবার হচ্ছে পরাগরেণু আর মধু। এ দু’টো মিশিয়ে এরা যে খাবারটা বাচ্চাদের খাওয়ায় তাকে মৌ-রুটি (Bee-Bread) বলে। যখন এই পরাগরেণু আর মধু পাওয়া যায় না তখনই এদের খাবারের অভাব দেখা দেয়। যেহেতু পরাগরেণু আর মধু দু’টোই পাওয়া যায় ফুল থেকে, তাই ফুল যখন কম ফোটে তখনই এদের খাবার কম থাকে।
মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে নিয়ে এসে একটা ঘরে জমা করে। সে সময় মধু কাঁচা থাকে। মানে হলো, মধুতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। পরে কর্মী মৌমাছিরা ডানা দিয়ে বাতাস করে পানির পরিমাণ কমিয়ে ফেলে। এতে মধু অনেকদিন ভালো থাকে। এক সময় যখন ঘরটা পূর্র্ণ হয়ে যায় তখন এরা মধুর ঘরটাকে মোমের ঢাকনা দিয়ে আটকে দেয়, যেন বাইরে থেকে ভেতরে ময়লা না পড়ে। এভাবে যতদিন পাওয়া যায় ততদিন পর্র্যন্ত এরা মধু জমা করতেই থাকে।
মৌমাছিদের নিজস্ব সমাজ আছে। আছে নিজস্ব নিয়মনীতি। এই নিয়মনীতি মেনেই তারা চলে। কখনোই তারা তাদের সমাজের কোনো নিয়ম ভাঙে না। শুধু তাই নয়, মৌমাছিদের মধ্যে আছে পরিশ্রম করার মানসিকতা। তবে আমরা কিন্তু মৌমাছিদের কাছ থেকে মধু ছাড়া আরোও অনেক কিছুই পাই। চলো এবার শুনি সেসবের কথা।
মোম : মৌচাক তৈরিতে ব্যবহৃত তো হয়ই আবার মোম থেকে আমাদের জন্য ওষুধও তৈরি হয়।
রয়্যাল-জেলি : মৌমাছিদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার। রাণীদের বেশিদিন ধরে খাওয়ানো হয়। আর অন্যদের কম। আমাদের জন্য এটি ঔষধ তৈরিতে কাজে লাগে। খুব কম পরিমাণে পাওয়া যায় বলে এর দামও অনেক বেশি।
প্রপোলিস : এক ধরনের আঠা, যা মৌচাকের ঘরগুলোকে এক সঙ্গে ধরে রাখে। এটির জীবাণু-বিরোধী গুণ আছে। আমাদের কাছে এর ঔষধিমূল্য অনেক।
মৌমাছির বিষ : হুল ফুটিয়ে এই বিষের ব্যবহার করে মৌমাছিরা। এর জন্যই হুল ফোটানো জায়গাটায় জ্বালা-পোড়া হয়। এরও ঔষধি গুণ অনেক বেশি।
মৌমাছিদের সম্পর্কে এখনও আসল কথাটা কিন্তু বলাই হয়নি। মৌমাছিরা তো মধু সংগ্রহ করতে এক ফুল থেকে আরেকটি ফুলে যায়। এভাবে অনেক ফুলে ঘুরে ঘুরেই তারা মধু সংগ্রহ করে। স্বাভাবিক কারণেই তারা শরীরের সঙ্গে এক ফুলের পরাগরেণু বহন করে নিয়ে যায় অন্য ফুলে। এভাবেই হয় পরাগায়ন। পরাগায়ন ছাড়া উদ্ভিদ বংশবিস্তার করতে পারে না। বেশিরভাগ গাছেরই ফল, বীজ কিছুই হতো না পরাগায়ন ছাড়া। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনের জন্য পরাগায়ন জরুরি। এক কথায় বলা সম্ভব যে পরাগায়ন ছাড়া কোনো কিছুই উৎপন্ন হতো না। এই পরাগায়নেই সাহায্য করে মৌমাছি।

মাসুম কবির
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ