ফোঁস -তমসুর হোসেন

ফোঁস -তমসুর হোসেন

গল্প আগস্ট ২০২০

এক জঙ্গলে ছিল একটা সরল সহজ সাপ। সাপটা জঙ্গলে ভয়ে ভয়ে থাকতো। কারণ ওই জঙ্গলে বাস করতো অনেকগুলো ভয়ঙ্কর বেজি। বেজিরা সাপটাকে দেখামাত্র তাড়া করতো। বেজির ভয়ে সাপটা খালের ভেতর লুকিয়ে দিন কাটাতো। সে ঠিকমত খাবার জোগাড় করতে পারতো না। না খেয়ে খেয়ে সে কাহিল হয়ে পড়লো। ওই জঙ্গলে সে কোন সাথি জোগাড় করতে পারলো না। কতো দিন সে বেজিদের অত্যাচার সহ্য করে বাস করবে। অগত্যা সে ওই জঙ্গল ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে মনস্থ করলো। একদিন সকালে সূর্য ওঠার আগে দূরের এক পাহাড়ের দিকে যাত্রা করলো সে। দুপুরে সে একটা বিলের ধারে এসে পৌঁছলো। বিলের চারপাশটা বেশ নিরিবিলি এবং ছোট ছোট গাছপালায় ঢাকা। অনেকটা পথ হেঁটে এসে সাপটা খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলো। বিলের মধ্যে ছিল অনেক মাছ আর পানিব্যাঙ। সময়টা ছিল অগ্রহায়ণের শেষ। পানিব্যাঙেরা বিলের পাড়ে লাফিয়ে বেড়ায়। সাপটা মনের সুখে পানিব্যাঙ খেয়ে নরম ঘাসে গা এলিয়ে মিষ্টি রোদে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে জেগে সে পাহাড়ের দিকে যাবে। বিলের ওপর ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছিলো একটা সোনালি চিল। চিলটা ছোঁ মেরে সাপকে নিয়ে আকাশে উড়াল দিলো। সাপটা চিলের নখর থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু চিলের নখ থেকে নিজেকে মুক্ত করা সহজ কথা নয়। আকাশের শূন্যে চললো চিল আর সাপের জড়াজড়ি। সাপটাও কম যায় না। সে তার শরীর দিয়ে চিলটাকে পেঁচিয়ে ধরলো। অবস্থা খারাপ দেখে চিল সাপটাকে ছেড়ে দিলো। চিলের নখর থেকে খুলে সাপ অনেক ওপর থেকে মাঠের শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়লো। খোলা মাঠে সাপ মরার মতো পড়ে থাকলো।

ওই মাঠের পথ ধরে এক দরবেশ তার খানকার দিকে যাচ্ছিলো। সাপটার করুণ দশা দেখে তার মনে দয়া হলো। সে তাকে নিয়ে খানকায় চলে গেলো। দরবেশের সেবাযতেœ সাপটা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলো। সাপটার প্রতি দরবেশের অনুকম্পা দেখে তার ভক্তরাও ওর প্রতি সব সময় খেয়াল রাখতো। যার ফলে খানকার সবখানে সে নিঃশঙ্কচিত্তে ঘুরে বেড়াতো। দরবেশের প্রতি সাপটা খুবই অনুগত হয়ে উঠলো। তার কথা ছাড়া সে কখনই খানকার বাইরে বের হতো না। খানকায় লোকের খুব সমাগম হতো। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন খানকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতো। সাপটা এদের মাঝে চলতে গিয়ে অসুবিধার সৃষ্টি করতো। লোকেরা ওকে দেখে ভয়ে অস্থির হয়ে পড়তো। সে যদিও কাউকে কামড় দিতো না কিন্তু মানুষ ওর ভয়ে খানকায় আসতে ভয় পেতো। অবশেষে একদিন সবকিছু বিবেচনা করে দরবেশ তাকে খানকা থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে আদেশ করলো। কোন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়ে তাকে স্বাধীনভাবে বাস করার উৎসাহ দান করলো দরবেশ। পরিশেষে তাকে বললো সে যেন কোন মানুষকে দংশন না করে।
মনের দুঃখে সাপ দরবেশের খানকা থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালো। কোথায় যাবে সে। বন্যজীবন তার ভালো লাগে না। খানকার পরিপাটি দালান বিস্তীর্ণ উঠোন আর পরিচ্ছন্ন বাগান তার ভালো লাগে। সেখানে সকাল সন্ধ্যায় নামাজের পর সমস্বরে জিকির হয়। বড় বড় ডেকচিতে করে খাবার তৈরি করে লোকদের খাওয়ানো হয়। একটা মায়াময় সংঘাতহীন পরিবেশ। যেখান থেকে তার মন একদম চলে যেতে চায় না। দিনরাত খানকার চারপাশে ঘুরে বেড়ায় সে। যদি দরবেশ তাকে ডেকে নেয়। যদি তাকে খানকার পাশে থাকার অনুমতি দেয়। এই আশায় সে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারলো দরবেশ কোনদিনই তাকে ডাকবে না তখন একটা ইক্ষু খেতের ভেতরে গিয়ে নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকলো।
বিকেলবেলা খেতের মালিক ঘাস কাটতে এসে সাপটাকে দড়ি মনে করে ঘাসের বোঝা বেঁধে বাড়ি চলে গেল। এমন শক্ত গিঁট দিয়ে সে বোঝা বাঁধলো যে সাপের কোমর ভেঙে গেলো। বাড়িতে গিয়ে ঘাসের বোঝা খুলে সে গরুকে খেতে দিলো। তাকে এমনভাবে দূরে নিক্ষেপ করলো যে তার জীবন যায় যায় অবস্থা। সারারাত সে ব্যথার চোটে কুঁকিয়ে কুঁকিয়ে কেঁদে কাটালো।
সেখান থেকে বের হয়ে সাপটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার দরবেশের খানকায় চলে গেলো। দরবেশের কাছে কেঁদে কেঁদে তার দুঃখের কথা বললো। সে বললো, দরবেশ তাকে কাউকে দংশন করতে নিষেধ না করলে ইক্ষুখেতের মালিক তার হাত থেকে কোনোক্রমে নিস্তার পেতো না। ঘটনা শুনে দরবেশ খুব কষ্ট পেলো। সাপটার এতো ক্ষতি হয়েছে তবু ছোবল দেয়নি এ জন্য ধন্যবাদ দিলো। ঔষধ খাওয়ায়ে তাকে সুস্থ করে তুললো দরবেশ। তারপর নরম কণ্ঠে বললো ওকে- দংশন করতে নিষেধ করা হয়েছে বটে কিন্তু ফণা তুলে ফোঁস করতে বারণ তো করা হয়নি। একবার ফোঁস করলে খেতের মালিক পালিয়ে যেতে হুঁশ পেতো না।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ