বন্ধ হোক শিশু নির্যাতন    - মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

বন্ধ হোক শিশু নির্যাতন - মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

বিশেষ রচনা অক্টোবর ২০১৫

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। এদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতি। একটা পরিবারে শিশুরা যেমন বড় হয়ে ভবিষ্যতে পরিবারের হাল ধরে এবং বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটায়। একটা জাতির ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা ঠিক সে রকমই। ভবিষ্যতে বড় হয়ে তারা জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে এটাই সবার কামনা। তবে সে ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আগে তাদেরকে শরীর-স্বাস্থ্যে, জ্ঞান-গরিমায় ও মন-মননে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে উঠতে হবে। শিশুদের পক্ষে নিজে নিজে এভাবে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়, এ জন্য চাই বাবা-মা, পরিবারের সদস্যবর্গ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সহযোগিতা। শিশুদের ভালোভাবে বেড়ে ওঠার জন্য দরকার তাদের পরিমিত খাবার, খেলাধুলার সুব্যবস্থা, শিক্ষা-দীক্ষার জন্য ভালো স্কুল ও শিক্ষাকার্যক্রম এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য আইন ও তার বাস্তবায়ন। আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে নানা ঘাটতি তো রয়েছেই, এমনকি তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনেও রয়েছে অন্তরায়। আর এর সাথে ইদানীং যোগ হয়েছে শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন। আর তাতে জীবন যাচ্ছে অনেকের।
ইদানীং দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশু নির্যাতনের এমন কিছু লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে যা ভাষায় বর্ণনা করাও কঠিন। শরীর-স্বাস্থ্যে কচিপ্রাণ, বুদ্ধিতে অপরিণত এবং প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন শিশুরা সহজেই সমাজের বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন বড়দের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং প্রাণও হারাচ্ছে। শিশুরা সমাজে নির্যাতিত হয় নানাভাবে। পরিবারের কলহ, সামাজিক ঝগড়া-বিবাদ ও পিতা-মাতার সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে, দুশ্চরিত্র ও মানসিক বিকারগ্রস্ত বড়দের লালসার শিকার হয়ে, দারিদ্র্যের কারণে অন্যের বাসা-বাড়ি বা কলকারখানায় কাজ করতে গিয়ে এবং অপহরণের শিকার হয়ে শিশুরা প্রাণ হারায়। পাঠকদের অবগতির জন্য নিচে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো :
রাজন হত্যা : গত ৮ জুলাই চুরির অভিযোগে সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকার বাদেয়ালি গ্রামের সবজি বিক্রেতা শিশু সামিউল ইসলাম রাজনকে গাছের সাথে বেঁধে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মৃত্যুকালে শিশু সামিউল পানি খেতে চাইলেও তাকে তা দেয়া হয়নি। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাশে কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের শেখপাড়ায় এই ঘটনা ঘটে। লাশ গুম করার চেষ্টা চালানোর সময় জনতা আসামিদের ধরে ফেলে এবং ঘটনার মূল হোতা কামরুল ইসলাম পালিয়ে সৌদি আরবে চলে গেলে জনতা সেখানে তাকে ধরে পুলিশে দেয়। রাজনকে নির্যাতন করার সময় নির্যাতনকারীরা ভিডিওচিত্র ধারণ করে এবং ১২ জুলাই তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।
রাকিব হত্যা : গত ৩ আগস্ট খুলনার টুটপাড়ায় শরীফ মোটরসে শিশু রাকিবকে (১২) ধরে নিয়ে তার পায়ুপথে হাওয়ার নল ঢুকিয়ে পেটে বাতাস দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঐ গ্যারেজের কাজ ছেড়ে অন্য গ্যারেজে কাজ নেয়ার কারণে গ্যারেজ মালিক মোহাম্মদ শরীফ ও তার সহযোগী মিন্টু খান ক্ষিপ্ত হয়ে রাকিবকে হত্যা করে। ঘটনার সময় শরীফের মা বিউটি বেগম পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। পরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে এলাকার লোকজন শরীফ ও মিন্টুকে ধরে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে পুলিশ বিউটি বেগমকেও আটক করে।
রমযান হত্যা : লক্ষ্মীপুরে রমযান নামে ১২ বছরের এক শিশু শ্রমিককে তার দোকান মালিক রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। নিহত রমযান লক্ষ্মীপুর পৌরসভার উত্তর বাঞ্ছানগর গ্রামের কাজল ইসলামের ছেলে। জানা যায়, দোকান মালিক আলী গত ১০ আগস্ট শিশু রমযানের মাথায় দু’টি দুধের কার্টন তুলে দেয়। ভার সইতে না পারাই রমযানের মাথা থেকে কার্টন দু’টি পড়ে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দোকান মালিক আলী শাটারের রড দিয়ে শিশু রমযানকে মারধর করে। পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে রমযানকে প্রথমে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রহারের ৮ দিন পর তার মৃত্যু হয়।
জজের বাসায় শিশু নির্যাতন : সাতক্ষীরা জজ কোর্টের দেবহাটা আদালতের বিচারিক হাকিম ও তার স্ত্রী নাতাশার বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলে অবস্থিত তাদের বাসা থেকে গত ১৯ আগস্ট নির্যাতিত শিশু বিথিকে (১০) পুলিশ উদ্ধার করেছে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় পুলিশ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। বিথি ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড় আমিনিয়া গ্রামের গোলাম রসুলের মেয়ে। সে ঐ বিচারকের বাসায় কাজ করতো। উদ্ধারের সময় শিশুটির মাথার চুল কাটা ছিল এবং হাত, পিঠ ও নিতম্বে আগুনে পোড়াসহ একাধিক স্থানে ক্ষতের চিহ্ন রয়েছে। শিশুটি উদ্ধার পাওয়ার পর বলেছে, আমি আর ঐ বাসায় যাবো না। সেখানে গেলে ঐ বাসার খালা ও খালু আমাকে মেরে ফেলবে।
বাবা-মায়ের হাতে ঘুমন্ত শিশু খুন : বাঘেরহাট সদর উপজেলার চর চিংগুড়ি গ্রামে বাবা-মায়ের সাথে ঘুমিয়ে থাকা মিমরা আকতার নামে দেড় বছরের এক কন্যাশিশু খুন হয়েছে। এই খুনের জন্য বাবা-মা পরস্পরকে দায়ী করছে এবং পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করেছে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, বাবা রিয়াজ শেখ ভ্যানচালক এবং মা নাজমা গৃহিণী। তাদের উভয়েরই আগে অন্যত্র বিয়ে হয়েছিল এবং নতুন সংসারে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো ছিল না। উভয়ের দ্বন্দ্বের জেরে মেয়ে শিশুটি খুন হয়েছে।
এ ছাড়াও সমাজে নিত্যদিন শিশু হত্যার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। সম্প্রতি মাগুরায় দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে সুরাইয়া নামে এক কন্যাশিশু মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ হয়। ফলে তার অকাল জন্ম হয়। অতঃপর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে শিশুটি বাড়ি ফিরেছে। রাজধানীর হাজারীবাগে এক শিশু চুরির অভিযোগে এক ছাত্রনেতার প্রহারে নিহত হয়, পরে আরজু মিয়া নামে ঐ ছাত্রনেতা র‌্যাবের হাতে নিহত হয়।
ওপরের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক সামান্য চুরির অভিযোগে রাজনকে রড দিয়ে পিটিয়ে মারার সময় উল্লাস করেছে, শিশুটি মারা যাওয়ার আগে পানি খেতে চাইলে তাকে পানি দেয়নি। এই হত্যার দৃশ্য ভিডিও করে তারা ফেসবুকে পর্যন্ত পোস্ট করেছে। কতটা নিষ্ঠুর হলে যুবকরা ছোট ভায়ের বয়সী এ শিশুটিকে হত্যা করতে পারে।
রাকিব হত্যায় দেখা যায়, গ্যারেজ মালিক শরীফ তার দোকানের কাজ ছাড়ার অভিযোগে রাকিবের পায়ুপথে যখন বাতাস ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করে তখন তার মা বিউটি বেগম ঘটনাটি দেখেছেন এবং কোন রকম উচ্চবাচ্য করেননি। এখানে মাতৃত্বও এই অপরাধের প্রতিরোধক হয়নি। কাজ পছন্দ করে নেয়ার অধিকার যে কারো আছে, অতএব এখানে তাকে আঘাত করার কোন অধিকার শরীফের ছিল না। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে শরীফ এ অপরাধটি করেছে।
জজের বাসায় কাজের মেয়ে বিথি নির্যাতনের ঘটনায় দেখা যায়, যিনি বিচারের মানদন্ড নিয়ে তার পেশায় নিয়োজিত আছেন, তিনি নিজেও শিশুটিকে নির্যাতন করেছেন এবং তার স্ত্রীর এ রকম অপরাধকর্মে প্রতিবন্ধক হননি। সমাজের কারো কাছে এটা প্রত্যাশিত নয়।
মাগুরায় শিশু সুরাইয়ার মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় দেখা যায়, রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন মা ও গর্ভের শিশু। গুলিবর্ষণকারীরা বিবেকবান হলে এই ঘটনা এড়ানো যেতো। জানা যায়, জেনে বুঝেই এই অপরাধীরা শিশুটির মাকে গুলি করে।
পরিশেষে বলা যায়, আমাদের সমাজ এখনও শিশুর জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয়। কিন্তু কিভাবে এই বিশে^ শিশুদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়া যায়? এ নিয়ে ভাবতে হবে সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজপতিদের। বন্ধ করতে হবে সকল প্রকার শিশু নির্যাতন। তবে এ ক্ষেত্রে একেবারে সাদামাটাভাবে যা বলা যায় তাহলো মানুষের মধ্যে সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। এটা ঘটাতে হলে চাই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক বন্ধন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সর্বোপরি মানুষের মধ্যে শেষ বিচারক ও মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ব্যাপারে ভয় সৃষ্টি করা, কেননা আমাদের ছোট-বড় সকল কাজের জন্য মহান আল্লাহর কাছে একদিন জবাবদিহি করতে হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ