বন্ধুর জন্য

বন্ধুর জন্য

গল্প জুন ২০১৪

মৃধা আলাউদ্দিন

বর্ষা মৌসুমে তলনাটাকে মনে হয় একটা সুন্দর দ্বীপ অঞ্চল। একমাত্র খিলক্ষেত ছাড়া পায়ে চলা আর কোনো পথ থাকে না। কাঁচকুড়া, হর্দি, বাওযার যে যেখান থেকেই আসবে নৌকা, ট্রলার অথবা মাঝি নাও-গুদারায় আসতে হবে। শুকনো মৌসুমে ভাতিরা ও বাওয়ায় দিয়ে বাঁশের সাঁকো পাড় হয়ে আসা যায়। এখন বর্ষা মৌসুমে চারিদিকে পানি থৈ থৈ করছে। নৌকা, ট্রলার, বালুটানার ড্রেজার ও ছোট ছোট লঞ্চে ভরে আছে তলনার খাল-বিল, বালু নদী। ছোট্ট বন্ধুরা, এই তলনার পূর্ব দিকে আরেকটা অংশের নাম পূর্ব তলনা। আজ যার গল্প তোমাদের শোনাবো, পূর্ব তলনার পূর্ব দিকে কালীকুঠি, পারাবর্থা, ধামছির শাল-পিয়ালের বন। দক্ষিণে নতুন শহর পূর্বাচল। উত্তরে উলুখোলা বা হর্দি, পশ্চিমে মূল তলনা। তোমরা জানো কি না জানি না কিন্তু আমি জানি, পারাবর্থা ও ধামছির বনের পরিমাণ এখনো প্রায় বারো শ’ একর যা আজ থেকে সত্তর- আশি বছর আগে ছিলো তার ডাবলেরও ডাবল। তখন এখানে বাস করতো বাঘ, কুমির, মেছোবাঘ, লেমুর, বানর, শেয়াল, বনবিড়াল, সজারু, ভোঁদড়, গুইসাপ, সাপ, বনমোরগসহ নানা রকমের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর প্রাণী। কিন্তু সেখানে বর্তমানে এসবের আর কিছুই নেই। কালেভদ্রে দু-একটা শেয়াল, সজারু, কাঠবেড়ালি, গুইসাপ, সাপ ও বনমোরগের দেখা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় নানান রকমের পাখপাখালি, ময়না, টিয়া, ঘুঘু, মাছরাঙা, সাদাবক, কানিবক, বালিহাঁস ও পানকৌড়ি, নানান জাতের মৎস্যশিকারি পাখিসহ আরো কতো কী! যদিও বর্তমানে মানুষের নিষ্ঠুর নির্মম আচরণের কারণে তেমন কিছুই আর সেখানে দেখা যায় না। আবার যে একেবারে কিছুই নেই ঠিক তা-ও নয়; মাঝে মাঝে দু-একটা বনমোরগ, বনবিড়াল, বালিহাঁস ও পানকৌড়ির ওড়াওড়ি মানুষের নজর এড়ায় না। বন্ধুরা! তোমরা শোন! বিশেষভাবে আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোন, আজ যা দেখা যায় হয়তো একদিন এসব আর কিছুই দেখা যাবে না, থাকবে না বনের গাছপালা, পশু-পাখি। এক সময়ের এই গভীর বন, বনের পাশের নিচু জমি ও ধানক্ষেত, মানুষের বসতি সব সরকার অ্যাকওয়ার করে নিয়ে গেছে। যার বিশাল একটা অংশের নাম নতুন শহর পূর্বাচল। বন্ধুরা। আমরা ফিরে আসি পূর্ব তলনার জঙ্গলের কাছে। ঘন গভীর জঙ্গল। মাঝে মাঝে যেখানে সূর্যের আলো পর্যন্ত পড়ে না। সেই সেখানে ঘন গভীর জঙ্গলের কথাই আজ বলবো তোমাদের। এ জঙ্গলে বাস করতো এক বনমোরগ ও বিশাল বড় দিঘির কচুরিপানার মধ্যে এক বালিহাঁস। এই বালিহাঁস ও বনমোরগ-মুরগির কথাই বলবো। শোন, একবার বনমুরগির সবগুলো ডিম খেয়ে ফেলেছে কোথাকার কোন এক অভদ্র, নিষ্ঠুর শেয়াল। ডিমের জন্য কাঁদছে বনমুরগি। বালিহাঁসের ডিমও নেই। কে বা কারা যেন খেয়ে ফেলেছে তার তা দেয়া বাচ্চসমেত সুন্দর ডিম। বালিহাঁসও কাঁদছে। দু’জন এক বিশাল বটবৃক্ষের তলায় বসে কাঁদছে এবং একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে চেয়ে কাঁদছে। শেষ পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে তারা দু’জন কথা বললো, বন্ধু! তুমি কাঁদছো কেন? কে বা কারা যেন আমার ডিম নিয়ে গেছে। কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো বালিহাঁস। আমারো, আমারো ডিম নিয়ে গেছে। ঐ শেয়ালের বাচ্চা শেয়ালই হয়তো আমার ডিম নিয়ে গেছে। আর কেঁদো না। বললো বালিহাঁসÑ আমি আর কাঁদবো না। হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, কাঁদলে সমস্যার সমাধান হয় না। আমাদের ভাগ্যে যা আছে তাই হয়েছে। আমরা না কেঁদে চলো ঘরে ফিরে যাই। তুমি কখন কী খেয়েছো? বললো, বালিহাঁস আমি গতকাল থেকে কিছুই খাইনি। হ্যাঁ চলো আগে আমরা কিছু খেয়ে নিই। গভীর ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে বালিহাঁস ও বনমোরগ। বালিহাঁস ও বনমোরগ দু’জন যখন যেখানে যায় যদ্দূর সম্ভব একসাথে যায়। এক সাথে খায়। গাছে চড়ার সময়ও তারা এক সাথে গাছে চড়ে। বর্তমানে ঘুমের জায়গাও তারা একসাথে করে নিয়েছে। দু’জনের এক বাড়ি। এক ঘর। একদিন তারা ভোরবেলা খাবারের সন্ধানে বালু নদীর তীরে এসে খাবার খাচ্ছে। একজন নদীতে। অন্যজন নদীতীরে। মানুষের পায়ে চলা মেঠোপথের ধারে ধারে। হঠাৎ আড়চোখে দক্ষিণ দিকে চেয়ে বনমোরগ দেখে একজন লোভী ধীবর কচুরিপানা মাথায় নিয়ে আস্তে ধীরে, সাঁতার কেটে বালিহাঁসের দিকে যাচ্ছে। প্রায় কাছেই চলে এসেছিলো মাংসাশী লোভী ধীবর। তখন বনমোরগ কক কক করে উঠলো। খুব জোরে চিৎকার দিলো। বালিহাঁস বন্ধুর চিৎকারে কান খাড়া করতে গিয়ে প্রথমে দেখলো এক লোভী ধীবর তার একদম কাছে চলে এসেছে। প্রায় ধরেই ফেলবে তাকে। অমনি ডুব দিলো বালিহাঁস। এক ডুবে ওপারে খালের ধারে চলে এলো। তারপর মুখের খাবারটা গিলে দ্রুত আকাশে উড়াল দিলো। চলে এলো বন্ধু বনমোরগের কাছে। দু’জনের মুখেই সুন্দর হাসি ফুটে উঠলো এবং অল্পক্ষণ দু’জন কী যেন বলাবলি করে বনের দিকে হাঁটতে লাগলো। গভীর বন।

আরেক দিনের ঘটনা। আমাদের মনুষ্য সমাজে তখন ঈদের দিন। ঈদে তোমাদের মতো কচি ছোট ছেলেমেয়েদের খুশির আর সীমা পরিসীমা থাকে না। তারা প্রচুর আনন্দ করে। হইচই করে। নতুন পোশাক পরে। ভালো খায়। আনন্দে উদ্বেলিত হয় মানুষ। কচি সুন্দর ছেলেমেয়ে। আবার এর ব্যতিক্রমও ঘটে। অনেকের ঘরে খাবার থাকে না। ভালো কাপড় চোপড় থাকে না। তারা গরিব। তোমরা সবসময় গরিবদেরকে সাহায্য করবে। সাহায্যকারীকে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন দোজখ থেকে সাত খন্দক দূরে রাখবেন। এক খন্দক থেকে অন্য খন্দকের দূরত্ব হবে পাঁচ শ’ বছরের রাস্তা। ঈদের দিন কিছু দুষ্ট ছেলের দল বনের ধারে গেল। বনের কাঁচা, আধা-পাকা ফল ফলাদি ছিঁড়ে ফেলে দিলো। পাকা দু-একটা খেল। গাছের ডাল ভেঙে পাতা ছিঁড়ে খেলতে লাগলো। মনের বিরুদ্ধে আবোল-তাবোল খেলা। কেউ কেউ গাছে উঠে বানরের মতো ঝুলতে থাকলো। এরপর তারা আরো পূর্বে ধামছির বনের ধারে গেল। ফিরলো অনেক দেরি করে দুপুরের পরে। বন ছেড়ে লোকালয়ে যেতে আজ তাদের মন চাইছে না। তারা আবারও পূর্ব তলনার গভীর জঙ্গলে ঢুকলো। দেখা পেল একটি বনমোরগের যার বন্ধু বালিহাঁস। বালিহাঁস দূরে গাছের মগডালে বসে মনের সুখে একটা টাঁকি মাছ খাচ্ছিল। হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখে বন্ধু বনমোরগের খুব বিপদ। দুষ্ট ছেলের দল তাকে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে বনমোরগ হাঁফিয়ে উঠেছে। ছেলেরা ধরেই ফেলতো। কিন্তু একটা অজগরের জন্য রক্ষা পেল বনমোরগ। ছেলেরা ভয়ে আরেক দিকে গেল। সাপটা চলে যাবার পর তারা আবার বনমোরগের পিছু নিলো। মোরগ এখন প্রায় ক্লান্ত-শ্রান্ত। হাঁটতে পারে না। লতায় পাতায় জড়িয়ে যায় তার পা। আর অমনি গাছের মগডাল থেকে মাটিতে নেমে এলো বালিহাঁস। দুষ্ট ছেলেদের পাশ দিয়ে সে এমনভাবে হাঁটতে লাগলো, যেনো তাকে দেখে মনে হয় সে একটা ল্যাংড়া বালিহাঁস। সবাই মোরগ ছেড়ে দিয়ে বালিহাঁসের পিছু নিলো। বালিহাঁস কিছুক্ষণ উড়ে, কিছুক্ষণ হাঁটে। আবার ধপাস করে পড়ে যায় মাটিতে। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে বাচ্চাদের নিয়ে গেল অন্য দিকে। অন্য কোনো পথে। আহত বনমোরগের থেকে অনেক দূরে এবং একসময় আকাশে উড়াল দিলো বালিহাঁস। সে উড়ে চলে গেল দূরে। প্রাণে বেঁচে গেল বিপদগ্রস্ত বনমোরগ। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, একটু নিঃশ্বাস নিয়ে রাফে রাইন তার ছোট্ট বন্ধুদের আবারও বলতে লাগলো, আল্লাহ তায়ালার অনেক পছন্দনীয় কাজের মধ্যে একটি হলো বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা। বন্ধুরা। তোমরা কারো ক্ষতি না করে সাহায্য করবে। সাহায্যকারীকে আল্লাহ বড়ই পছন্দ করেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ