বর্ষবরণ নানা দেশে নানা সাজে

বর্ষবরণ নানা দেশে নানা সাজে

বিশেষ রচনা এপ্রিল ২০১১



নববর্ষ উদ্যাপন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। এটি প্রথম ব্যাবিলনে প্রায় চার হাজার বছর আগে উদ্যাপিত হয়। হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মের প্রায় ২০০০ বছর আগে বসন্ত শুরুর পর যেদিন আকাশে প্রথম নতুন চাঁদ উঠত সে দিনকে নতুন বর্ষের প্রথম দিন হিসেবে গণ্য করা হতো। বসন্তকে নতুন বছর হিসেবে বেছে নেয়ার কারণ ছিল, এ সময় মৌসুমের প্রথম ফসল বোনা হতো। ব্যাবিলনে নতুন বর্ষ উদ্যাপনের অনুষ্ঠান ১১ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হতো। এ সময় প্রতিদিনই আলাদা রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করা হতো। যার ফলে ১১ দিন ১১টি ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করে নেয়া হতো।

বছরের প্রথম নববর্ষ

পৃথিবীকে সময় অনুযায়ী বিভিন্ন টাইম জোনে ভাগ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী নববর্ষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে আরেক প্রান্তে পৌঁছে। ইংরেজি সন অনুযায়ী পৃথিবীর যে এলাকায় সবচেয়ে প্রথমে নববর্ষ পালন করা হয় তার অবস্থান ইন্টারন্যাশনাল ডেডলাইনের ঠিক পশ্চিমে। এ সময় ডেডলাইনের পূর্ব অংশ পশ্চিম থেকে ২৩ ঘণ্টা পিছিয়ে থাকে। মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র কিরিবাতির সর্বপূর্বের ক্যারোলিন আইল্যান্ড নামক এক জনবসতিহীন দ্বীপ পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রথমে নববর্ষ পেয়ে থাকে।

নানা দেশে নানা সাজে বর্ষবরণ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতি কিন্তু এক নয়। কিছু কিছু মিল থাকলেও নববর্ষের অনুষ্ঠানের সাথে যোগ হয় দেশীয় ঐতিহ্য। নববর্ষের কিছু প্রথা আছে অবাক করা এবং মজার।

গ্রেগোরিয়ান নববর্ষ

যেসব দেশে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়, তারা সাধারণত নববর্ষ পয়লা জানুয়ারিতে পালন করে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে, রোমান ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ থেকে। এর প্রভাব বছরের কয়েকটা মাসের ওপর দেখা যায়। ল্যাটিন ভাষায় সেপ্টেম্বরের অর্থ হচ্ছে সাত, অক্টোবর আট, নভেম্বর নয় এবং ডিসেম্বর দশ। সেই সময় রোমান সরকারের নতুন অধিবেশন শুরু হতো জানুয়ারি মাস থেকে। জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সালে এ ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন ঘটিয়ে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি করেন। এতে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালে মার্ক অ্যানটোনির কনসুল এক দফা পরিবর্তন ঘটানোর পর খ্রিষ্টপূর্ব ৮ সালে এম্পরর অপাসটাস সিজার আরেক দফা পরিবর্তন ঘটান। সর্বশেষ পোপ ১৩তম গ্রেগোরি ১৫৮২ সালে এই ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন ঘটিয়ে এর বর্তমান কাঠামোতে নিয়ে আসেন। এই পরিবর্তিত ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষের শুরু হয় ১ জানুয়ারি। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনটি মধ্যযুগে ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে পশ্চিমা সভ্যতার সম্প্রসারণের কারণে এখন ১ জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী নববর্ষ পালন করা হয়। সাম্প্রতিককালে নববর্ষ খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপন করা হয়। পৃথিবীর সব বড় বড় শহরে নববর্ষের আগ মুহূর্তে বিশাল সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে আতশবাজি ফাটিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়।\



ভারত

বহু ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির দেশ ভারতে সম্রাট আকবরের সময় যে নওরোজ উৎসব হতো তা সর্বভারতীয় উৎসবের মর্যাদা পায়নি। অনেকে ভারতীয় বর্ষবরণ উৎসবকে দিওয়ালি উৎসব বলে অভিহিত করেন। দিওয়ালি অর্থ দীপাবলি বা আলোর উৎসব। এটি হয় বিভিন্ন রাজ্য বা সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী। দিওয়ালি ধর্মীয় উৎসবও বটে। লক্ষ্মীপূজাসহ চলে দেবদেবীর স্মৃতিচারণ করার উদ্দেশে ভজনসঙ্গীত, কৃষ্ণকীর্তন ইত্যাদি। পাঞ্জাবে নববর্ষ উৎসব পরিচিত বৈশাখী নামে। নববর্ষে পুষ্পসজ্জা প্রায় সর্বভারতীয় রেওয়াজ, দক্ষিণ ভারতের অঞ্চলবিশেষের মজাদার খাবার ও পুষ্পাহার গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। তবে বর্তমানে ইংরেজি নববর্ষ পালন সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান উৎসব হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যে নতুন বছরে মধ্যরাতের পর যে পুরুষ প্রথম বাড়িতে পা দেয়, বলা হয় সে বাড়িতে সৌভাগ্য নিয়ে আসে। এ সময় পুরুষরা নিজেদের বাড়িতে টাকা, রুটি, কয়লা এবং অন্যান্য সামগ্রী উপহার হিসেবে নিয়ে আসে, যাতে করে সারা বছর পরিবারের সদস্যদের এসব জিনিসের কমতি না হয়। মধ্যরাতের পর বাড়িতে পা দেয়া প্রথম মানুষটি অবশ্যই সোনালি বা লাল চুলওয়ালা এবং মহিলা হতে পারবে না। বলা হয়, এতে করে বাড়িতে দুর্ভাগ্য আসে। লন্ডনে নববর্ষের আগ মুহূর্তে ট্রাফালগার স্কোয়ার এবং পিকাডেলি সার্কাসে বিশাল পরিসরে মানুষ সমবেত হয়। মধ্যরাতে বিগবেনের ধ্বনি শুনে এরা একত্রে নববর্ষকে বরণ করে নেয়।



যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের নববর্ষ উদ্যাপনের কেন্দ্রবিন্দু হয় টাইমস স্কোয়ার। এখানে নতুন বছর শুরু হওয়ার ১০ সেকেন্ড আগে এক বিশালাকার ক্রিস্টাল বল নেমে নতুন বর্ষের আগমনের কাউন্টডাউন শুরু করে। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিউ ইয়ার পার্টি যাতে প্রায় ৩০ লাখ লোক অংশগ্রহণ করে।

অস্ট্রেলিয়া

সিডনিতে নববর্ষ উপলক্ষে প্রায় ৮০ হাজার আতশবাজি ফোটানো হয় যা ১৫ লাখ লোক উপভোগ করে। গত বছর এটিই ছিল টেলিভিশনে সবচেয়ে বেশি দেখা অনুষ্ঠান।

ফ্রান্স

ফ্রান্সে নববর্ষের দিনটিকে জউর দে এটরের্নস বলে ডাকা হয়। এখানে নববর্ষ উদ্যাপন শুরু হয় ১ জানুয়ারি, যখন একজন অন্য জনকে বন্নে আনেস বলে অভিবাদন জানায়। এখানে নববর্ষ উদ্যাপন ছয় দিন ধরে চলে। এ সময় আইফেল টাওয়ারের পাশে আতশবাজি ফাটিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া হয়। ফরাসিরা থার্টি ফার্স্ট নাইটকে লা সেইন্ট-সিলভেস্ট্রে বলে ডাকে। এ দিন এক বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়, যার নাম লে রেভেলিয়ন ডি সেইন্ট সিলভেস্ট্রে। তখন ভালো ভালো খাবার যেমন - প্যানকেক আর হাঁস রান্না হয়। এ ছাড়াও এ দিন প্যালে ডে রইস নামের এক ধরনের কেক বানানো হয়। ফরাসিরা পৃথিবীর অন্য অনেক জায়গার মতোই বিশ্বাস করে, এ দিন ভালো খাবার দিয়ে নৈশভোজ করলে পরিবারের সবার জন্য নতুন বছরটা ভালো কাটবে।

হাঙ্গেরি

হাঙ্গেরিতে নববর্ষের দিন কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। এই কুশপুত্তলিকাকে “জ্যাক স্ট্র’ বলা হয়। আগের বছরে ঘটে যাওয়া সব দুর্ঘটনা এবং খারাপ কাজের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। এই কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে দুর্ভাগ্যকে ছুড়ে ফেলা হয়।



স্কটল্যান্ড

এ সময় সবাই নিজেদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে নতুন বছরের আগমনের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় বাড়ি পাক-পবিত্র রাখার জন্য জুনিপার গাছের ডাল পোড়ানো হয়, নববর্ষের দিন যে মানুষ প্রথম বাড়িতে পা রাখে সে-ই ওই বছর বাড়ির সদস্যদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। স্কটল্যান্ডের এডিনবরাইয়ে এ সময় যে নববর্ষ উৎসব হয় তা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নববর্ষ উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। চার দিনব্যাপী চলা এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে মানুষ আসে।



রাশিয়া

গ্রান্ডাফাডার ফ্রস্ট, যে সান্টাক্লসের লালের পরিবর্তে নীল সুট পরে, এ দিন শিশুদের মধ্যে খেলনা বিতরণ করে।

জার্মানি

এখানে মানুষ ঠাণ্ডা পানির মধ্যে তরল সিসার টুকরা ঠেলে দেয়। সিসার টুকরা যেরকম আকার বানায় তা দেখে ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা হয়। নববর্ষের আগে খাওয়া খাবারের কিছু অংশ মধ্যরাতের জন্য রেখে দেয়া হয়, যাতে করে নতুন বছর ঘরে পর্যাপ্ত খাবার থাকে।



চীন

পূর্ণিমার শুরুর দিন থেকে শুক্লপক্ষের পনের দিন উৎসব চলে নববর্ষ উপলক্ষে। পৃথিবীতে একমাত্র চীনারাই নববর্ষ পালন করে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী। নববর্ষের প্রথম দিনে তারা স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাকে তুষ্ট করে নানা উপাসনা-উপাচারে, দ্বিতীয় দিন পূর্ব পুরুষের মঙ্গল কামনা করা হয়। ‘ওয়েইলু’নামক বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয় এদিন। পক্ষব্যাপী আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের মধ্যে সপ্তম দিনটি পালিত হয় ‘শস্য দিবস’নামে।

জাপান

জাপানে নববর্ষের সময় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। খারাপ আত্মাকে দূরে রাখার জন্য এ সময় বাড়ির বাইরে দড়ি দিয়ে খড়ের টুকরো ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এটাকে তারা সুখ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখে। নতুন বর্ষ শুরু হওয়ার সাথে সাথে জাপানিরা হাসা শুরু করে, বলা হয় এতে করে নতুন বর্ষ সৌভাগ্য নিয়ে আসে।

ভিয়েতনাম

ভিয়েতনামে নববর্ষকে সংক্ষেপে ‘টেট’ শব্দে অভিহিত করা হয়। ভিয়েতনামিদের বিশ্বাস, ঈশ্বর ঘরে ঘরে বাস করেন। নববর্ষে বেড়াতে যান স্বর্গে। সেখানে বসে মর্ত্যরে লোক কী করছে, তা খতিয়ে দেখেন। বলা হয়, কার্প মাছের পিঠে চড়ে ঈশ্বর ভ্রমণেও বের হন। এ বিশ্বাসে অনেকে নদী বা পুকুরে কার্প মাছ ছাড়েন।

আর্জেন্টিনা

আর্জেন্টিনায় নববর্ষের আগের দিন রাত্রে পরিবারের সব সদস্য একত্রে খাবার টেবিলে বসে আহার করে। ভোর পর্যন্ত চলে নানা অনুষ্ঠান। নববর্ষের প্রথম দিন নদী বা পুকুরে সাঁতার কেটে তারা নববর্ষ উদযাপন করে।

ব্রাজিল

ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো সমুদ্রসৈকতে নববর্ষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটি হয়। এর অন্যতম আকর্ষণ চোখ ধাঁধানো আতশবাজির প্রদর্শনী। এ দিন অনেক লোকই সাদা পোশাক পরিধান করে। সমুদ্রে সাতটি ডুব দিলে এবং সাতটি ফুল ছুড়ে দিয়ে তারা মনে করে বছরটি খুব ভালো কাটবে। এ উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় দুই মিলিয়ন পর্যটক যোগ দেয়।

কোরিয়া

কোরিয়াতে নববর্ষ শুরুর সময় কেউ ঘুমায় না। এ সময় ঘুমালে নাকি চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়! রাত ১২টা বাজার সাথে সাথে টিভিতে ৩৩ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। কোরিয়ার ৩৩ বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটি করা হয়। কোরিয়াতে প্রায় সবাই সূর্যোদয় দেখে। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার সময় একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানায়।



মেক্সিকো

মেক্সিকোতেও ১২টা বাজার সাথে সাথে ১২ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। এ সময় প্রতি ঘণ্টাধ্বনির সাথে একটি করে আঙুর খাওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে এ সময় যা কামনা করা হয়, তাই পূরণ হয়।

বাংলা নববর্ষ

বঙ্গদেশে (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) বছরের শুরু বৈশাখের প্রথম দিন। কবে থেকে এর প্রচলন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। বেশিরভাগ পণ্ডিতের মতে, বাংলা সাল চালু হয় সম্ভবত আরবি নয়শ’হিজরির দিকে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দু’জন মুসলিম শাসকের নাম। একজন বাংলার সুলতান হোসেন শাহ, অন্যজন মোঘল সম্রাট আকবর। ৯০৩ হিজরি অর্থাৎ ৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন শাহের রাজত্বের শুরু। তখন থেকেই হিজরি বা চান্দ্র বছর অনুসারে নতুন করে বঙ্গাব্দের সূচনা। অনেকের মতে, বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। মতান্তরে, বাংলা সাল সম্পর্কে যে হস্তলিপি পাওয়া গেছে তা প্রমাণ করে বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের ঘটনা আরও আগের। তবে বেশিরভাগ পণ্ডিতের মতেই, হোসেন শাহই বাংলা সালের প্রকৃত প্রবর্তক। আকবরের সময় তা পেয়েছে শাসনতান্ত্রিক সালের মর্যাদা। তিনি প্রজা ও কৃষকদের মধ্যে ঋণ বিতরণ, খাজনা আদায় এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে কার্যকর করেন।

প্রাচীন বাংলায় বছরের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। ‘অগ্র’ মানে শ্রেষ্ঠ, ‘হায়ণ’ অর্থ ‘ব্রীহি’ বা ধান জন্মানোর সময়। দু’য়ে মিলে অগ্রহায়ণ। কালে অগ্রহায়ণের জায়গা দখল করেছে বৈশাখ। এখন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন অর্থাৎ জাতীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত নববর্ষ দিবস।

বাংলা নববর্ষ পালন আমাদের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক দিক। বহুমাত্রিক লোকাচার যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। নববর্ষে শুধু নতুন করে সাজগোজই দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে না, উপহার-উপচারের হুল্লোড় ছড়িয়ে পড়ে এ পাড়া থেকে ও-পাড়ায়। পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে প্রাচীন অনুষ্ঠান ‘হালখাতা মহরত’। ব্যবসায়ীদের কাছে দিবসটির তাৎপর্য অনেক। নতুন বছরে নতুন করে লাভ-লোকসানের খতিয়ান। নববর্ষের আরেক দিক মেলা-খেলা। মেলার সেই গ্রামীণ জৌলুস এখন আর নেই। বটের ছায়া নেই নদী তীরে, নেই গাঙপাড়ের শোভা-সৌন্দর্য। আজকাল মেলা বসে পাকা রাস্তার ধারে কিংবা শহরে, যার অনেকটাই প্রাণহীন।



নববর্ষের আরেক উৎসব প্রথম বৈশাখে জমিতে ‘হাল দেয়া’। তাও একালে একেবারেই আয়োজনহীন হয়ে উঠেছে। তবে আবৃত্তি, আলোচনা, গণমাধ্যমে বিশেষ আয়োজন এখন সুপ্ত হয়ে যায়নি। যাত্রা, পালাগান, বাউল, কীর্তন আগের মতো না জমলেও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। পহেলা বৈশাখের ভোজ একটি অপরিহার্য আয়োজন। অঞ্চলবিশেষে নানা জাতের খাবারও চালু আছে। শহরে ‘পান্তা-ইলিশ’ ভোজের ব্যবস্থা হয় প্রতি বছর। বর্ষবরণের আরেক দিক পাহাড়ি আদিবাসীদের বৈসাবি বা বিজু মেলা। জানা যায়, বৈসাবি নামের উৎপত্তি হয়েছে ত্রিপুরা আদিবাসীদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমাদের ‘বিজু’র আদ্যাক্ষর নিয়ে। এখন দশ ভাষাভাষী তেরো আদিবাসী সম্প্রদায় মিলে পালন করে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি। আদিবাসী সাঁওতাল, গারো সমাজেও জাঁকজমকের সঙ্গে বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়। এদিন তীর-ধনুক নিয়ে জঙ্গলে শিকার করতে যাওয়া সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ।

বিভিন্ন ভাষায় নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তা

নতুন বছরে শুভেচ্ছা জানাতে বাংলায় ‘শুভ নববর্ষ’বলা হয়। আর ইংরেজিতে বলা হয় ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। একইভাবে বিশ্বের অন্যান্য ভাষাতেও শুভেচ্ছা বিনিময়ে রয়েছে ভিন্নতা। এখানে আরো কিছু ভাষায় নতুন বছরের শুভেচ্ছাবার্তা তোমাদের জানানো হলো। এখন তুমি চাইলে বিদেশী ভাষায় কাউকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে মজা করতে পারো।

আরবি : কুল আম আনতুম সালিমুন

চাইনিজ : চু সেন তান

ফ্রেঞ্চ : বন্নে আন্নি

জার্মান : প্রোসিট নেউজার

হিন্দি : নয়া সাল মোবারক

রাশিয়ান : এস নোভিম গুদুম

স্প্যানিশ : ফেলিজ আনো নিউভো

উর্দু : খোশ আমদেদ নয়া সাল

ডাচ : গুল্লুকিগ নাইয়ো যার

ইতালিয়ান : বুয়োন কাপোডান্নো

পর্তুগিজ : ফেলিজ আনো নিউভো

ভিয়েতনামিজ : চুং চুক তান জুয়ান

টার্কিশ : ইয়েনি ইয়েলিনিজ কুটলু ওলসান

জাপানিজ : আকেমাশিতে ওমেডেতু গোজাইমাসু

সুইডিশ : গট নিট আর



নববর্ষে মানুষের চিরন্তন অভিলাষ শান্তি ও স্বস্তিপূর্ণ আরেকটি বছর। এদিনে অতীতের দুঃখ-গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুনভাবে জীবন শুরু করার স্বপ্ন রচনা করেন সবাই। সেই প্রাণাবেগই যেন ধরা পড়ে নববর্ষ পালনের বহুমাত্রিক আয়োজনে। সব কিছুর মূলে সেই একই বিষয়- শান্তিপূর্ণ জীবন আর সমৃদ্ধ আগামী। এ আকাঙ্ক্ষা বিশ্বজনীন, সর্বজনীন। যেন একটি ইচ্ছেই প্রতিভাত হাজারো পাণে - সুখ চাই, শান্তি চাই, জীবন সুখময় হোক, ঋদ্ধ হোক জাতির মনন, সংসার দিগন্তে দেখা দিক অমলিন সুবর্ণ রেখা- আগামী বসন্তের শেষ দিবসের মধ্যরাত নাগাদ। তারপর ফের সেই বৈশাখ আবাহন- এসো, এসো হে বৈশাখ।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ