বর্ষা আমাদের প্রাণের স্পন্দন

বর্ষা আমাদের প্রাণের স্পন্দন

প্রচ্ছদ রচনা জুলাই ২০১৩

আহমদ মতিউর রহমান

জ্যৈষ্ঠ্যের মৌ ম্যে দিনগুলো শেষে কদম গাছের ফাঁক দিয়ে গুমোট আর মেঘলা আকাশ নিয়ে যে সময়টা আমাদের দেশে আসে তার পোশাকী নাম বর্ষাকাল। ষড়ঋতুর অন্যতম এই বর্ষা ঋতু যা বাংলাদেশের আবহাওয়া, পরিবেশ আর মনোজগতকে একেবারে বদলে দেয়। অধোর ধারায় বৃষ্টিস্নাত হয়ে সবুজ গাছগাছালিতে সুন্দর হয়ে ওঠে ধরিত্রী। তাই এই বর্ষা ঋতু নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের বন্দনা-বর্ণনার শেষ নেই যেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুল থেকে শুরু করে তার পরের কবি লেখকরা তো বটেই আগেকার কবি-লেখকরাও বর্ষার আবাহন করে গেছেন তাদের বহু কবিতা-গান-গল্পে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় আসে।... আষাঢ় নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা শিশু কবিতা সবার মুখে মুখে নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে ওগো আজ তোরা যাসনে গো যাসনে ঘরের বাহিরে। এটা ছোটদের জন্য রবীন্দ্রনাথের সাবধান বাণী। এটা বর্ষা ঋতুর সূচনায় গ্রামীণ জনপদের একটি চিত্র মাত্র। প্রবল বৃষ্টি শুরু হলে বাইরে গিয়ে ছেলেমেয়েরা আটকা পড়বে, অসুখ বাঁধাবে এটাই হয়তো কারণ। তো এই কবিতার মধ্য দিয়ে আমরা বর্ষা ঋতুর একটি চিত্র পাই। বর্ষাকাল বা বর্ষা ঋতুর কয়েকটি ইংরেজি প্রতিশব্দ আছে। এর একটি জধরহু ঝবধংড়হ। ছোটদের তো এ নিয়ে রচনা মুখস্থ করতে হয়, লিখতে হয়। এছাড়া গড়হংড়ড়হ, ডবঃ ঝবধংড়হ-ও বর্ষাকাল। গড়হংড়ড়হ ইংরেজিতে এসেছে পর্তুগিজ শব্দ গড়হপধড় থেকে। পর্তুগিজ ভাষায় এসেছে আরবি মওসুম বা মওসিম থেকে। এর অর্থ ঝবধংড়হ বা কাল। বাংলায় মওসুম শব্দ বহুল প্রচলিত। এর দ্বার কাল, সময় বা আবহাওয়া বোঝানো হয়। পর্তুগিজ গড়হপধড় শব্দটি ওলন্দাজ গড়হংঁহ থেকে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। এটাও এসেছে মূলত আরবি থেকে। ব্রিটিশ আমল থেকে বর্ষাকাল বোঝাতে গড়হংড়ড়হ শব্দের ববহার লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ আশপাশের দেশ বা অঞ্চলগুলোর মতো আধা উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকা ঝঁন-ঞৎড়ঢ়রপধষ তড়হব। উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় প্রধানত তটি ঋতু লক্ষণীয় ঐড়ঃ ঝঁসসবৎ বা প্রচণ্ড গরমের গ্রীষ্মকাল  মার্চ থেকে জুন (চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ), ঈড়ড়ষ জধরহু ঝবধংড়হ বা ঠাণ্ডা বর্ষাকাল  জুন থেকে অক্টোবর (আষাঢ় থেকে কার্তিক) ও ঈড়ড়ষ উৎু ডরহঃবৎ বা ঠাণ্ডা ও শুষ্ক শীতকাল  অক্টোবর থেকে মার্চ (অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন)। আমাদের দেশ ঋতুর দেশ হলেও প্রধানত গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতকালই চোখে পড়ার মতো, অনুভব করার মতো। শরৎ, হেমন্ত আর বসন্ত কখন আসে আর কখন যায় তেমনটা টেরই পাওয়া যায় না। আষাঢ় আর শ্রাবণ এই দুই মাস হচ্ছে ক্যালেন্ডারের বর্ষাকাল। কিন্তু বাস্তবে আষাঢ় আসার বহু আগে থেকেই চৈত্রে বৈশাখে কালবোশেখীর সাথে শুরু হয়ে যায় বৃষ্টির ছাট। জ্যৈষ্ঠে কখনো কখনো অঝোরে বর্ষার মতো ঝরতে থাকে বৃষ্টিÑ যা বর্ষার আগমনী বার্তা জানান দিয়ে যায়। এ বছর এমনটা ঘটেছেÑ জ্যৈষ্ঠে একটানা কয়েকদিনের বৃষ্টি বর্ষার মতোই পানি-কাদা মাখামাখিতে পরিণত করেছিল ধরাকে। তারপর আবার জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমÑ আম জাম কাঁঠাল পাকবার মরশুম। জ্যৈষ্ঠের দমফাটা গরম যেমন অস্বস্তিকর তার বিপরীতে আছে বাহারী ফলের সমাহারে মনভুলানো প্রকৃতি। এ সময়টায় বাজারে প্রায় সব ধরনের ফল পাওয়া যায়। কবির ভাষায় “পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ”। জ্যৈষ্ঠের মধুমাস পেরিয়ে গাছে গাছে কদম ফুল জানান দেয় আষাঢ় এসেছে, এসেছে বর্ষাঋতু। বলা হয়ে থাকে, ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশ। বছর ঘুরে ঘুরে ঋতু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নানা বৈচিত্র্য ধরা দেয়। শিশুরা এ থেকে মজা নিতে পারে। গ্রামে গাছে গাছে কদমের ডালে এর চমৎকার ফুল সবাইকে আকর্ষণ করে। শহরেও স্থানে স্থানে কদমের গাছ চোখে পড়ে। দূর থেকে বেশ সুন্দর লাগে পাতাসহ কদম ফুল। দেখতে টেনিস বলের মতো। কদম ফুলে রয়েছে তিনটি স্তর। ছোট ছোট দলগুলো থাকে দু’টি স্তরে। এগুলো উপড়ে ফেললে শেষ স্তরে মিলবে একটি টেবিল টেনিস বা পিং পং বলের চেয়ে সামান্য ছোট আকৃতির বল। বাহারী কদম ফুল শিশুদের খুবই আকর্ষণ করে। ইদানীং শহরের বড় স্কুলের গেটে পাতাসহ কদম ফুলের ডাল বিক্রি করতে দেখা যায়। গ্রামের ছেলেমেয়েরা অবশ্য এদিক থেকে সৌভাগ্যবান। তাদের এগুলো পয়সা খরচ করে কিনতে হয় না, গাছ থেকে পেড়ে নিলেই হলো। কদম গাছ বেশ উঁচু ও বড় বড় হয়। তাই এই ফুল পাড়া খুব সহজ কাজ নয়। কদম ফুলের হাওয়া খুবই স্বাস্থ্যকর। আর তাই গ্রামে বসতবাড়ির আঙিনায় চোখে পড়ে অজস্র কদম গাছ। এই কদম ফুলের হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ আছে। বর্ষার দূত এই কদম ফুল নানাভাবে আমাদের সাহিত্যে স্থান পেয়েছে কবিতা-গান ও গল্প-উপন্যাসে। শুধু কদম নয়, কেয়াও বর্ষার আগমনে প্রাণ ফিরে পায়। কেয়া ঝোপ বৃষ্টির পানি পেয়ে বেড়ে ওঠে এক সময়ে ফুলে সুশোভিত হয়। র্বষা ঋতু আসার সাথে সাথে সারাদেশে বৃক্ষ রোপণের ধুম পড়ে যায়। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ঘটা করে পালিত হয় বৃক্ষমেলা। বৃক্ষমেলা তো নয় আসলে গাছের চারার মেলা। সেখান থেকে বা নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করে লাগানো হয় বাগানে, সড়কের ধারে। এভাবে প্রকৃতি হয়ে ওঠে সবুজ। এই সময়ে বৃক্ষরোপণের অবশ্য কারণ আছে। গাছের চারা সবসময়েই রোপণ করা যায়, তবে বর্ষাকালে আবহাওয়া বৃষ্টিস্নাত থাকে বলে চারা লাগালে মরে যাওয়ার হার কম। অন্য সময়ে চারা লাগালে নিয়ম মতো সেচ দিতে হয়Ñ বর্ষায় যার তেমন প্রয়োজন হয় না। বৃষ্টি সেই অভাব পূরণ করে। আর প্রাকৃতিক নিয়মে এ সময়ে গাছগুলো লকলকিয়ে বেড়েও ওঠে তাড়াতাড়ি। এ সময়ে প্রত্যেকেরই উচিত অন্তত দু’টি করে চারা রোপণ করা। তাহলে গাছে গাছে সবুজ হয়ে উঠবে প্রকৃতি। আমরা পাবো আমাদের জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। আর এক একটি গাছ যে অক্সিজেনের কারখানা তা কে না জানে। বলছিলাম বর্ষাঋতুর কথা। এ সময়ে বৃষ্টির পানিতে এবং উজান থেকে নেমে আসা পানিতে খাল বিল সব তলিয়ে যেতে শুরু করে। নদীগুলো পানিতে ভরে যায়Ñ অনেক সময় উপচে পড়ে বন্যাও দেখা দেয়। বন্যা হয় আমাদের ক্ষতির কারণ। শ্রাবণ মাস যখন আসে তখন আমাদের দেমের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। গ্রামীণ জনপদ তখন বর্ষার পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। গ্রামীণ বাড়িগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে ওঠে। তখন চলাচলের বাহন হয় নৌকা। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগের মতো র্বষাকাল আর হয় না কারণ উজানে প্রতিবেশী দেশ বহু নদীর পানি আটকে দিয়েছে বাঁধ দিয়ে। ফলে বর্ষার সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। এরপরও ক্রমাগত বৃষ্টি আর নদীর পানির স্রোতধারা আমাদেরকে ভিন্ন একটি আমেজ এনে দেয়। বৃষ্টি আমাদের মনে ও মননে একটি নতুন অনুভূতি আনে। বৃষ্টি সবারই ভালো লাগে শিশু-কিশোর বয়সে তো বৃষ্টিতে ভিজতে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বৃষ্টি আমাদের প্রকৃতিকে যেমন ফলে ফসলে ভরিয়ে দেয় তেমনি আমাদের মন-মানসকেও স্পর্শ করে। বৃষ্টি নিয়ে আমাদের সাহিত্যে অজস্র কবিতা ও গান দেখা যায়। কবি ফররুখ আহমদের শিশু কবিতায় বৃষ্টি এসেছে নানাভাবে। একটি উদাহরণ “বিষ্টি নামে রিমঝিমিয়ে রিমঝিমিয়ে গাছের ডালে টিনের চালে বিষ্টি নামে হাওয়ার তালে বাদলা দিনের একটানা সুর বৃষ্টি নামে ঝুমুর ঝুমুর।” বর্ষায় আমনসহ বিভিন্ন ধরনের ধানের আবাদ করা হয়। এ সময় পাট গাছগুলো বড় হয়ে ওঠে। বর্ষার পানি পেয়ে পাটের আবাদ ভালো হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভালো পাট জন্মে। সেগুলো বর্ষা শেষে কেটে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে নিয়ে শুকাতে হয়। বর্ষার শেষে বৃষ্টি আবার পাট শুকাতে নানা দুর্ভোগÑ কিষাণ-কিষাণীকে এসব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এসব অর্থকরী ফসল ফলাতে হয়। ধান-পাট ছাড়া বর্ষা ঋতুতে নিচু জমিতে অন্য কোনো ফসল করা যায় না। ফলে সেগুলো খালি পড়ে থাকে। সে সব জমিতে বর্ষায় শাপলা ফোটে। এছাড়া বিল, দিঘি, পুষ্করিনীতেও শাপলা ফোটে। এগুলো অবশ্য বর্ষা শেষের চিত্র। তখন বাহ্যত বর্ষাকাল আর থাকে নাÑ এসে পড়ে শরৎ কাল। আষাঢ়-শ্রাবণ দু’মাস বর্ষাকাল হলেও বাংলাদেমের গ্রামাঞ্চলে এর পরেও বর্ষার প্রভাব থাকে। থাকে বৃষ্টিপাত। ফলে বর্ষা আর শরৎ যেন একাকার হয়ে যায়। হেমন্তে কার্তিক মাসে পানি সরে যাওয়ার পর ক্ষেত পাথার যখন আবার জেগে ওঠে তখনই আসলে বর্ষার প্রভাব শেষ হয় প্রকৃতি থেকে। বর্ষা প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে যায় যেমন তেমনি সামনের দিনগুলোকে চাকচিক্যময় করে যাওয়ার যতগুলো ধাপ আছে সবগুলোরই সে করে দিয়ে আর ফরে শ্রী হীন ফসল ফসলহীন প্রকৃতি আবার সবার জন্য বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। বর্ষায় জমিতে পলি পড়ার ফলে জমি উর্বরা শক্তি ফিরে পায় আবার ফসলের জন্য প্রস্তুত হয়। বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়। তবে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার কারণ বাতাসে মৌসুমী বায়ুর উপস্থিতি। সমুদ্র এলাকায় মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকে। বর্ষাকালে এই মৌসুমূ বায়ু আস্তে আস্তে সারা দেশে প্রভাব বিস্তার করে। মৌসুমী বায়ুর আগমনে জ্যৈষ্ঠের গুমোট গরমের ভাবটা কেটে গিয়ে প্রশান্তির একটা হাওয়া বয়ে যায়। আষাঢ়ে-শ্রাবণে অঝোর বর্ষণ গোটা পরিবেশটাকেই আরো প্রাণবন্ত করে তোলে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ