বসন্ত আসে রাজার সাজে -কামরুল আলম
বিশেষ রচনা ফেব্রুয়ারি ২০১৬
বছর ঘুরে আবার এলো বসন্ত। বসন্ত মানে ঋতুর রাজা। নিশ্চয়ই তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে বসন্তকে ঋতুর রাজা বলা হয় কেন? হ্যাঁ, রাজাই বটে। বসন্তকালে বাংলাদেশের প্রকৃতিটা রাজকীয় রূপে সাজে। কনকনে ঠান্ডা ঋতু শীতের পরেই আগমন ঘটে বসন্তের। তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো শীতকালে গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়ে। গাছগাছালির দিকে তাকালে কেমন যেন মরা মরা ভাব লক্ষ্য করা যায়। সেই মরা ভাবটা কাটাতেই বসন্ত আসে। গাছে নতুন পাতা গজায়, সবুজে সবুজে ছেয়ে যায় চারদিক। নানা রঙের ফুলে ফুলে ভরে ওঠে গাছগাছালি। পাখিরা গান গায় মনের আনন্দে। কোকিলের কুহু কুহু গানে নেচে ওঠে কবিমন। তাইতো মনের আনন্দে ছড়াকার ছড়া কাটেন এভাবেÑ ‘‘বসন্তকাল যখন আসে মন চলে যায় দূরে কুহু কুহু কোকিল যেথায় ডাকে মধুর সুরে।’’ এই যে এত আনন্দ। এত এত ফুলপাখিদের মেলা বসে যে ঋতুতে, সেটাই তো আমাদের সবার চেনা ঋতুরাজ বসন্ত। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ছয়টি ঋতুর দেশ। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি দুই মাসে এক একটি ঋতু হয়। সে হিসেবে ফাল্গুন ও চৈত্র এ দুই মাসকে বসন্তকাল বলে। অবশ্য ঋতুর এ প্রকারভেদ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছয়টি ঋতু নেই। অবাক হচ্ছো বন্ধুরা! অবাক হবারই কথা বটে। আমাদের দেশে যেখানে ছয় ঋতু, সেখানে অন্যান্য দেশে মাত্র তিনটি ঋতু! প্রকৃতিও ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্নভাবে সাজে। যেমন ধরো রাশিয়ায় শীতকালে বৃষ্টি হয়। ঠিক আমাদের বিপরীত, তাই না? সেসব দেশে বৃষ্টি থেকে বরফ জমে প্রকৃতিটা এত বেশি ঠান্ডা হয় যে পাখিরা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে না। তাই তো তারা দলবেঁধে ছুটে যায় অন্যত্র। আসে আমাদের দেশেও। এবার মিলে গেল তো? ভাবছিলে বুঝি ভাইয়া বানিয়ে বানিয়ে বলছে। শীতকালে আবার বৃষ্টি হবে কিভাবে? আল্লাহতায়ালা এই আকাশ ও পৃথিবীসহ সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সাজিয়ে দিয়েছেন প্রকৃতির এই অপরূপ সাজ। একবার চিন্তা করে দেখ তো ইয়া লম্বা নারকেল গাছের মাথায় ছোট ছোট ডাব বা নারকেলের ভেতরে পানযোগ্য সুমিষ্ট পানি কোথা থেকে আসে? এটা কিভাবে সম্ভব হয়? যে আল্লাহ এত নিখুঁতভাবে এসব সাজিয়েছেন তাঁর জন্য শীতকালে বৃষ্টি দেওয়াটা কোনো ব্যাপারই না। বসন্তের প্রথম দিনে বলা হয়ে থাকে ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত। কারণ বসন্ত হচ্ছে ফুল ফোটার কাল। বসন্তকালে নানা রঙের ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় গাছগাছালি। লাল ফুল, নীল ফুল, হলুদ ফুল, গোলাপি ফুল, বেগুনি ফুল, ঘিয়ে ফুল, আকাশি ফুল, কমলা ফুল, সাদা ফুলসহ কত নাম না জানা বাহারি রঙের ফুল ফোটে বসন্তে। বসন্তের ফুল মানেই রঙের মেলা। যেমন ধরো টকটকে লাল শিমুল ফুল। বসন্তের ফুল হিসেবে পরিচিত হলেও শীতের শেষ দিকেই চলে আসে গাছের ডালে ডালে। শিমুল কেবল মানুষকে নয়, পাখিদেরও আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। বনের আগুন নামে পরিচিত পলাশ ফুলও বসন্তের ফুল হিসেবে পরিচিত। নজরকাড়া এ ফুলটি গাছের শাখায় শাখায় ধরিয়ে দেয় কমলা রঙের আগুন! গাঁদা ফুলের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় ঋতুরাজ বসন্তে। হলুদ, সাদা, সোনালি ও মেরুনসহ নানা রঙের গাঁদা ফুল থাকলেও আমাদের দেশে কেবল হলুদ ও কমলা রঙের গাঁদা ফুলই বেশি দেখা যায়। বসন্তকাল এলে বাগানে বাগানে হরেক রঙের ডালিয়া ফুল বাড়ির চিত্রটাকেই পাল্টে দেয়। শীতের মাঝামাঝিতে ফোটে চন্দ্রমল্লিকা ফুল যা বসন্তের রূপকে সজ্জিত করে তোলে। কৃষ্ণচূড়া, মাধবীলতা, সন্ধ্যামালতিসহ নানান ফুলে সত্যি প্রকৃতিটা সাজে রাজার সাজে। চাঁপা ফুলও বসন্তকালেই বেশি ফোটে। এ সময় কাঁঠালি চাঁপার সুবাসে ভরে ওঠে বাংলাদেশের বাতাস। বিশেষ করে রাতের বেলায় ফুলটি সুগন্ধ ছড়ায়। কাঁঠালি চাঁপার রঙেরও একটি মজা আছে। ফুলটি প্রথমে সবুজ থাকে। পরে হলুদ রঙ ধারণ করে। হলদে হবার পর ফুলটি থেকে সুগন্ধও বের হয়। গাছের ডালের মাথায় থোকায় থোকায় দোলনচাঁপা দেখা যায় বসন্তের ভর দুপুরে। বসন্তকালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। গুনগুনিয়ে গান পর্যন্ত গায় অনেকেই। আমগাছে বোল আসে বসন্তেই। লিচু গাছগুলোও ফলবতী হয়ে ওঠে এ সময়। যব, গম, সরিষা ইত্যাদি শস্যে মাঠে মাঠে ছড়ায় নতুন শোভা। বাংলাদেশের প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। প্রতিটি ঋতুরই সৌন্দর্য আছে। কিন্তু বসন্তের প্রকৃতি সত্যি উপমাহীন। তাইতো বসন্তকে বলা হয় ঋতুর রাজা। প্রিয় কবি মোশাররফ হোসেন খানের একটি কবিতায় বসন্তকাল চিত্রিত হয়েছে এভাবে- “গাছে গাছে কি যে শোভা আমের মুকুল বসন্তের রঙে সাজে নদীর দু’কূল। রাত আরও গভীর হলে পরীদের ডানায় ভরে ওঠে পদ্মপুকুর কানায় কানায়। পিক-পাপিয়া ডাকে পাখি সকাল দুপুর রানীর বেশে নামলো সে দু’পায়ে নূপুর। নূপুরের বাজনা শুনে সুদূরের মাঠ জেগে ওঠে ঝিঁঝিদের জোছনার হাট। রাত পোহালে ফরসা হলে আচানক ভোর রাজপুত আলতো করে দেয় খুলে দোর। বাসন ভরা পিঠাপুলি দারুণ পাপর ভাজা ঘোড়ায় চড়ে দখিন হাওয়ায় আসে ঋতুর রাজা ॥” শীতকালে যেমন শীতের বুড়ির সন্ধান পাওয়া যায়, বসন্তে তেমন কোন কাল্পনিক চরিত্রকে খুঁজতে হয় না। অবশ্য বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুনে শীত শীত ভাব থেকে যায়। এ মাসে শীতের পোশাক শরীর থেকে পুরোপুরি ছেড়ে দেয়া যায় না। ধীরে ধীরে শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে ওঠে বসন্ত। তাই তো কবি বলেনÑ ‘‘শীত চলে শীত চলে যায় বসন্তকাল আসে ফুল পাখি আর প্রজাপতি বসন্তে খুব হাসে। কৃষ্ণচূড়া পলাশ শিমুল ফোটে গাছের ডালে শুকনো ডালে সবুজ পাতা গজায় নতুন তালে। বসন্তে যে আমের মুকুল নতুন করে ফোটে গুনগুনিয়ে গান ধরে যায় রাখাল ছেলের ঠোঁটে। কুহু কুহু কুহু কুহু গায় কোকিলে গান ঋতুর রাজা বসন্তটা আল্লাহতায়ালার দান।’’ বনে বনে প্রজাপতি খেলা করে, কোকিল ডাকে কুহু কুহু গান। বসন্তের আগমনে মানুষের মনেও প্রকৃতির মতোই যেন পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। প্রকৃতি ধারণ করে রূপ-লাবণ্যে ভরা মনোহর পরিবেশ আর মানুষের মনে জাগে আনন্দের জোয়ার। শীতের রিক্ততা ভুলিয়ে আগুনঝরা ফাগুন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবন রাঙাতে বসন্ত আসে। বসন্ত আসে রাজার সাজে।
আরও পড়ুন...