বাংলা ক্যালিগ্রাফি চর্চার শিল্পরূপ

বাংলা ক্যালিগ্রাফি চর্চার শিল্পরূপ

অনুশীলন মোহাম্মদ আবদুর রহীম আগস্ট ২০২৩

বন্ধুরা! তোমরা ইতোমধ্যেই জেনেছো, বাংলা ক্যালিগ্রাফি কীভাবে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা এখন এর শিল্পরূপ কেমন হতে পারে এবং এর সাথে সম্পর্কিত আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। অনেকের মনে প্রশ্ন উদয় হতে পারে, ক্যালিগ্রাফি আর হ্যান্ডরাইটিং বা হাতের লেখার ভেতর কী পার্থক্য আছে?

ক্যালিগ্রাফি, হ্যান্ডরাইটিং থেকে আলাদা এজন্য যে, ক্যালিগ্রাফি একই সাথে শিল্পতৃষ্ণা এবং আটপৌরে জীবনের প্রয়োজন মেটায়।

অন্যদিকে, হ্যান্ডরাইটিং হচ্ছে যোগাযোগ বা শুধু প্রয়োজনকে তুলে ধরে। নন্দন বা সৌন্দর্য সেখানে গৌণ।

ক্যালিগ্রাফি চর্চা করা হয় এর ভেতরের সৌন্দর্য এবং অন্তর্নিহিত শিল্পকে তুলে ধরতে।

ক্যালিগ্রাফি এবং হ্যান্ডরাইটিংয়ের মধ্যে আরেকটা মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, উপায় উপকরণের ভিন্নতা। ক্যালিগ্রাফি করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি কলম ব্যবহার করা হয়। আর সাধারণ লেখায় যেকোনো কলম হলেই চলে।

ক্যালিগ্রাফি করার জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম এবং পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। যেমন একটি লিপিতে অলঙ্কার ব্যবহার হয়, আবার দেখা যায় আরেকটি লিপিতে তা নিষিদ্ধ এবং আকার-আকৃতি একেক লিপির একেক রকম। বাংলা ট্র্যাডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতেও নিয়ম-নীতি রয়েছে এবং এতে মাথা তেরছা করে কাটা ক্যালিগ্রাফি কলম ব্যবহার হয়।

ক্যালিগ্রাফির লিপির মধ্যে এই বৈচিত্র্য এসেছে সংস্কৃতি, ধর্ম এবং শিল্পবোধের প্রাত্যহিক চর্চার মাধ্যমে।

বাংলা ক্যালিগ্রাফির ট্র্যাডিশনাল ধারা সাংখ্য-যোগ-তন্ত্রবাদী আমলে ধর্মীয় দেব-দেবী আশ্রিত থাকার কারণে তা গোপন তান্ত্রিক চর্চায় ব্যবহৃত হতো। এটির হরফ সুন্দর করার প্রয়াস পাল আমলের পুথিতে পাওয়া যায়। কিন্তু বহিরাগত কনৌজাগত সেনরা বাঙলা ভূখণ্ড দখল করে একে ভুতলিপি নাম দিয়ে বাংলা ভাষা ও লিপি ধ্বংস করে এবং সংস্কৃত ভাষা ও নাগরি লিপি প্রতিস্থাপন করে। ফলে বাংলা লিপি অন্ধকারে চলে যায়। ১২শতকে বখতিয়ার খলজি বাংলা ভূখণ্ড অত্যাচারী সেনদের হাত থেকে বিনা রক্তপাতে উদ্ধার করলে বাংলা ভাষা ও লিপি হৃত গৌরব ফিরে পায়। বাংলার স্বাধীন সুলতান ও মোগল আমলে মুসলমান এবং হিন্দু পুথি-লেখকদের প্রচেষ্টায় লিপির উন্নয়ন ও সংস্কার সাধিত হয়। পঞ্চাশটি বাংলা হরফকে উচ্চারণগত সুবিধার জন্য এবং আরবি হরফের সাথে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় করার উদ্দেশ্যে মাত্র আঠারোটি বাংলা হরফ চালু করে এবং এই আঠারোটি হরফ দিয়ে মুসলিম পুথি-লেখকরা পুথি রচনা করেছেন। এই হরফগুলোর মধ্যে তিনটি স্বরবর্ণ, যেমন-আ, ই, উ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ পনেরটি, যথা-ক, খ, গ, ছ, জ, ত, দ, ন, ফ, ব, ম, র, ল, স, হ।

১৮ শতকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ হওয়ার আগে ও পরে বাংলা লিপিকে সংস্কৃত লিপির আদলে লেখার ও প্রতিস্থাপন করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে গৌড়-বঙ্গ তথা রাঢ় ঘটি ব্রাহ্মণেরা। এজন্যও বাংলা লিপির উৎকর্ষতা আসেনি। এর আরো একটি কারণ হলো “ক-অক্ষর গোমাংস” থিউরি। আর্য ব্রাহ্মণেরা বাংলা লিপিকে গোমাংস অর্থাৎ গরুর গোশতের সাথে তুলনা করে একে অচ্ছ্যুত ঘোষণা করে। মুসলিম আমলে সংস্কৃত ভাষা ও নাগরি লিপি বাদ দিয়ে বাংলার মুসলমানরা এর উন্নয়ন ও সংস্কার করার ফলে ব্রাহ্মণেরা এই হীন ষড়যন্ত্র করে। আর ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বাংলা হরফকে পেছনের দিকে নিয়ে যায় এবং এর ক্যালিগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য ব্যাহত হয়।

পাকিস্তান আমলে বাংলা লিপির তেমন অগ্রগতি হয়নি, এমনকি শিল্পী-সাহিত্যিকরা যেমন এর প্রতি আদর-কদর নেননি, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি বরং বাংলা ভাষার প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ করা হয়েছে। এতে বাংলা ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নের কোনো হদিস পাওয়া যায় না।


প্রসঙ্গত খত থেকে দস্তখত

বাংলায় পেঁচানো বা স্ক্রিপ্ট আকারে নাম সই বা সিগন্যাচারকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি বলে মত দিয়েছেন একজন ইতিহাস গবেষক। তিনি বলেছেন, এটা তার আবিষ্কার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকগণ এটাকে তাদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করবেন বলে তিনি দাবি করেছেন। তিনি ‘নাম দস্তখত’কে সহি এবং ‘দস্তখত’কে শিল্পিত লিপিকলায় (Calligraphic System) অন্তর্ভুক্ত করেছেন। লিপিকলার বিকাশে দস্তখত একটি অনুকরণীয় মডেল এবং নান্দনিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দস্তখতকে ফ্রিহ্যান্ড শিল্প বিবেচনায় এক একটা শিল্পকর্ম এবং এর নির্মাতারা স্থূল অর্থে এক একজন শিল্পী বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। তিনি খত শব্দটি আরবি এবং একে শিল্পমণ্ডিত লিপিকলা বলেছেন। আর দস্ত শব্দটি ফারসি এবং এর অর্থ হাত বলেছেন। দস্তখতের অর্থ করেছেন সহি বা স্বাক্ষর।

এখানে মজার বিষয় হলো, আরবি এবং ফারসিতে স্বীকৃত ক্যালিগ্রাফারগণ একটি ক্যালিগ্রাফিক স্বাক্ষর ওস্তাদের কাছ থেকে পাস করার পর বা ইযাজা লাভের পর ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের নিচে দিয়ে থাকেন এবং সেখানে লেখা হয়, ‘কাতাবাহু আবদুল্লাহ/ওমর/নাম’। ‘কাতাবাহু’ শব্দটা শুধুমাত্র ইযাজা লাভের পরই দেওয়া যায়, অন্যথায় শুধু নাম সই করা যায়। এই বিষয়টাকে আরবিতে ‘তাওকি’ বলে। হাজার বছর ধরে এই সিলসিলা বা নিয়ম চলে আসছে। এটা ফারসি ক্যালিগ্রাফির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফার্সিতে ক্যালিগ্রাফিকে বলে ‘হুনারমান্দে খোশনবিশি’ বা ‘হুনারে খোশনবিশি’ আর কেতাবাত বা সাধারণ হস্তলিপিকে বলে ‘খতাতি’। আধুনিক ফার্সিতে সিগন্যাচারকে ‘আমেদা’ বা ‘নামে আমেদা’ বলে। দস্তখত শব্দটি আসলে প্রাচীন তুর্কি-আফগান-কুর্দি রুটের শব্দ। এর অর্থ ‘ক্যালিগ্রাফিক স্বাক্ষর’ নয়। তাহলে এসব অঞ্চলের ক্যালিগ্রাফির বই-পত্রে অবশ্যই থাকত এবং সেটা প্রচলিত হিসেবে এখনও পাওয়া যেত। কারণ ক্যালিগ্রাফিতে সিগন্যাচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন বাংলায় শুধু পেঁচিয়ে সিগন্যাচার দিলে সেটা ক্যালিগ্রাফি বলতে হবে, তা বিবেচ্য হতে পারে না। কারণ ঐ সিগন্যাচারের অধিকারীর স্বীকৃত বাংলা ক্যালিগ্রাফি শিল্পী বা ক্যালিগ্রাফার হিসেবে পরিচিতি থাকতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলাম কখনই ক্যালিগ্রাফার হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। আর আরবিতে খত অর্থ শুধু ক্যালিগ্রাফি নয়; লাইন, পথ, দাগ, রেখা, চিহ্ন ইত্যাদি অর্থও হয়। যেমন- আকাশপথকে বলে খত আল জাউবি। বিমান সংস্থার নাম যেমন-কাতার এয়ার লাইনসকে বলে খুতুত আল জাউবিয়া আল কাতারিয়া।


আরহামের পিকটোগ্রাফি :

আরহামুল হক চৌধুরী বাঙলা হরফকে নানান রকম পেঁচিয়ে বাঁকিয়ে যেকোনো বস্তু বা প্রাণীর চিত্র এঁকেছেন। তার কাজে প্রবাদ প্রবচন এসেছে চিত্রের অবয়ব তৈরিতে স্বাচ্ছন্দ্যরূপে। ছবির আবেদনের সাথে অবয়ব এবং টেক্সট মিলে একাকার হয়ে গেছে। এ ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কাজে ঐতিহ্যকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। যা কিছুটা নগর জীবনের বিলাসের ভেতর লোকশিল্প ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। এগুলোর মধ্যে হাতে আঁকা ও নকশা করা আসবাব, ভেষজ রঙ নিয়ে কাজ, উচ্ছিষ্ট লোহার ভাস্কর্য থেকে দেশীয় গাছের বনসাইও রয়েছে।

শিল্পীর ক্যালিগ্রাফি কাজে পুরনো বাংলা বচন ও স্লোক এর ব্যবহার করা হয়েছে এবং লেখাটি সেই প্রক্রিয়ায় একটি আদলে পরিণত করা হয়েছে। কাজগুলো ইরানি ‘তুগরা’ ঘরানার রীতিতে প্রভাবিত কিন্তু মূল প্রতিপাদ্য আদি বাঙ্গালিয়ানায় গ্রথিত। দেশীয় প্রবচন এবং আদল বাংলা ক্যালিগ্রাফিগুলোতে একটি বিশেষ বাংলা চরিত্র দিয়েছে।

সচেতনভাবে বাহুল্য বর্জন করে শুধুমাত্র বচনকে প্রাধান্য দিয়ে কাজগুলো করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ৫২কে মুখ্য করে ৫২টি নানান ধরনের কাগজে করা নতুন ক্যালিগ্রাফি কাজ তিনি করেছেন।


বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে কুরআনের অনুবাদ :

২০১৪ সালের রমজান মাসে পবিত্র কুরআনের ত্রিশ নম্বর পারার অনুবাদ বাংলা ক্যালিগ্রাফি করেন মোহাম্মদ বেলাল। এ কাজে তিনি আর্ট কাগজের ওপর তেরছা মাথার ক্যালিগ্রাফি ফ্লাট মার্কার ব্যবহার করেন।


প্রবাসে বাংলা ক্যালিগ্রাফি :

বাংলাদেশের মেয়ে সিলভিয়া রেশমিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড শহরে বাংলা ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করেন। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। সেখানে তাঁর সব ক’টি ছবি দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ক্রেতাদের মধ্যে তিনজন জাপানি তো রীতিমতো আবেগে আপ্লুত হয়ে যান। তাদের কাছে মনে হয়েছিল এই প্যাঁচানো বাংলা অক্ষরগুলো জাপানি অক্ষরের মতো, কিন্তু জাপানি নয়। এটা একটা ভিন্ন ভাষা কিন্তু ভিন্ন ভাষাকেও তাদের আপন মনে হয়েছিল।

বাংলা হরফে ক্যালিগ্রাফি ট্র্যাডিশনাল এবং পেইন্টিং, এই দুই ধারা একটি পর্যায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে উন্নতি করতে চাইলে বাংলার প্রাচীন পুথির লেখন বৈশিষ্ট্যকে আয়ত্ত ও যাচাই করতে হবে। এর নান্দনিক ও শিল্পরূপকে ধারণ করতে হলে হরফের আঙ্গিক কাঠামো, ক্যালিগ্রাফি কলমের সঠিক ব্যবহারকে আমাদের খুব খেয়াল করতে হবে। আশা করি তোমরা অনেক সুন্দর সুন্দর ক্যালিগ্রাফি করে বন্ধুদের মুগ্ধ করে দেবে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ