বাংলা হরফে ক্যালিগ্রাফি

বাংলা হরফে ক্যালিগ্রাফি

অনুশীলন মোহাম্মদ আবদুর রহীম জুন ২০২৩

বন্ধুরা! ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে মোটামুটি তোমাদের একটা ধারণা হয়ে গেছে। আজ আমরা তোমাদেরকে বাংলা হরফে কীভাবে ক্যালিগ্রাফি করা হয় এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করব। তোমরা জানো, ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে লেখার সময় এর কৌণিক দিকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে লেখা ডান থেকে বাম দিকে যায়, যেমন আরবি, সেটার কলমের কৌণিক দিক ডান দিকে এবং হরফের মোটা চিকনও তেমনি হবে। অন্যদিকে যে লিপি বাম থেকে ডানে যায়, যেমন বাংলা, সেটার কৌণিক দিক বামে হবে এবং হরফের মোটা-চিকনও সেভাবে হবে।

বাংলা হরফের গঠন আকৃতি আধুনিকায়ন হলেও প্রাচীন পুথির লিপি যাচাই করে দেখা গেছে, এর স্বভাব বরাবর বর্গাকার এবং সমান্তরাল অথবা চৌকোনা স্বভাবের। পুথি লেখায় মাথাকাটা কলম অপেক্ষা গোলায়িত মাথার কলমের ব্যবহার বেশি হয়েছে এবং লিপিকরের দক্ষতা ও সৌন্দর্যবোধের ভিন্নতায় টানা লেখায়ও ক্যালিগ্রাফির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।

মানুষের জীবনটা আয়ুর পরিধিতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তার কীর্তি সময়কে অতিক্রম করে অমরত্ব লাভে সক্ষম। আর এ জন্যই সচেতন মানুষ মাত্রই স্বীয় অমর কীর্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকেন। আমরা অতীত এবং বর্তমান সময়ের পরতে পরতে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই- রাজা, রাজন্যসহ সমাজপতি, সচেতন শিক্ষিত শ্রেণি তাদের কীর্তিকথা বিজয়গাথা, রাজ্যশাসনের নীতিমালা, উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রভৃতি লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

কালের অতল গহ্বরে অনেক কীর্তি হারিয়ে যায়, আবার কোনো উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় অতীত রহস্য।

ভবিষ্যতের জন্য কীর্তির তথ্য জমা রাখার সহজ পন্থা হিসেবে লিপির অবলম্বন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এভাবে লিপির মাধ্যমে অতীত অভিজ্ঞতা চলে আসে বর্তমানের হাতে।


হরফতত্ত্ব (Paleography)

প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার এবং সেসব লিপির আগাপাশতলা বের করার জন্য এক ধরনের জ্ঞান চর্চা করা হয়, এটা হরফতত্ত্ব নামে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্বে যে মটিফ (Motif) সংরক্ষণ করা হয়, তাতে টেরাকোটা ‘তবক’ বা চাকতি লিপি terracotta tablet script), ধাতব ফলকলিপি (metal plates inscriptions), বা শিলা ফলকলিপি (stone inscriptions) প্রধান। এ ছাড়া আরো নানান রকম উপাদান আছে, যা হরফতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত।

এ এক বিচিত্র এবং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য জ্ঞান চর্চা। এমনও ঘটনা আছে একটি শিলালিপির পাঠোদ্ধার (decipher) করতে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। যদিও একটা পাঠ পাওয়া গেল, কিন্তু পরে তা ভুল প্রমাণিত হলো। তবু প্রথম পাঠকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়।


লিপি নিয়ে যারা

কাজ করেন

লিপি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাজের ধরন ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায়। কেউ প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধারে জীবন কাটিয়ে দেন। কেউ নতুন লিপি তৈরির কাজ করেন, যাকে লিপিকার (Calligrapher/Calligraphist) বলা হয়। আবার লিপি নিয়ে শিল্পকলা করেন যিনি, তাকে লিপিশিল্পী (Calligraphy Artist) বলে।

প্রত্নতত্ত্বের সাথে শিলালিপির পাঠোদ্ধার (decipher) বিষয়টি জড়িত। ছাপাখানা, বই হাতে লেখা, প্রচ্ছদ, বই অলঙ্করণ প্রভৃতির সাথে নতুন লিপি বা প্রচলিত লিপির নতুন সংস্করণ করেন লিপিকার।

আর শিল্পকলায় লিপিকে অনুষঙ্গ করে কিংবা লিপি দিয়েই শিল্পকর্ম করেন লিপিশিল্পীরা। আমাদের ঢাকার চারুকলায় প্রাচ্যকলা ও গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে এ বিষয়ে তালিম দেওয়া হয়।

তবে অধিকাংশ ভাষার লিপি দিয়ে এখন আর শিল্পকলার প্রবহমান ধারা লক্ষ করা যায় না। এক্ষেত্রে চীনা ও জাপান বা কোরীয় লিপি চিত্রের অনুষঙ্গ হিসেবে এখনও টিকে আছে। আর আরবি লিপি নিজেই একটি জীবন্ত শিল্পকলা হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ধারা এবং আধুনিক শিল্পকলা হিসেবে প্রবহমান।


বাংলা ভাষা লিখতে বিভিন্ন লিপির ব্যবহার

এ অঞ্চলে মুসলিম ও ইংরেজ আমলে আরবি, ফারসি বা উর্দু হরফে বাংলা লেখা ছাড়াও সিলেটি, নাগরি, কায়থি, উড়িয়া, নেওয়ারি, রোমান ও আসামি লিপিতে বাংলা গ্রন্থ রচনার নজির রয়েছে।

মুসলিম আমলে মুসলিম এবং হিন্দু লেখক নির্বিশেষে আরবি-ফার্সি হরফে বাংলা পুথি লিখেছেন। ঢাবির পুথিশালায় রক্ষিত আরবি হরফে লেখা বাংলা ভাষার তেত্রিশটি পুথির কথা জানা যায়। এর অধিকাংশের লিপিকালের হদিস নেই। তবে গবেষকরা বলছেন, এগুলো ১৮ শতকের আগে লেখা। এগুলো সৈয়দ সুলতানসহ অপরাপর মুসলিম লেখকদের রচিত। বাংলা ভাষার পুথি আরবি হরফে কেন লেখা হলো? ইতিহাসে দেখা যায়, সুলতানি আমলে (১২০৪-১৫৭৬ ঈসায়ি) প্রাপ্ত প্রায় সব শিলালিপি বিশুদ্ধ আরবি ভাষা ও উৎকৃষ্ট আরবি ক্যালিগ্রাফিতে করা হয়েছে। সুতরাং সাধারণের কাছে আরবি ভাষা সহজপাঠ্য ও গ্রহণীয় ছিল। এই তেত্রিশটি পুথির প্রায় সবক’টি ধর্মীয় বিষয়ে লেখা। জনগণের চাহিদা মোতাবেক এবং পাঠের সুবিধার্থে এগুলো আরবি হরফে লেখা হয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা।

আর ৬০ দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামে জুলফিকার আলি আরবি-ফার্সি (উর্দু) লিপিতে একটি বাংলা পত্রিকাও বের করতেন বলে জানা যায়।

প্রাচীনকাল থেকে বলা যায়, ঈসায়ীপূর্ব তিন হাজার বছর থেকে বাংলা লিপি যাত্রা শুরু করেছে। বলা হয়, বাংলা ভূখণ্ডের বাইরের ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপির উৎপত্তি। তবে আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলা ভূখণ্ডের ভেতর থেকেই এ লিপি ‘নাগরী লিপি’ বা ‘ব্রাহ্মী লিপি’ (যা থেকে নাগরী লিপির জন্ম বলে দাবি করা হয়) থেকে জাত নয়; বরং তা স্বাধীনভাবে উদ্ভুত। আরও জানা যায়, ‘বাংলা’ লিপি ব্রাহ্মণদের হাতে তৈরি নয়, এ দেশের-ই প্রাচীন আমলের সাংখ্য-যোগ-তন্ত্রবাদী বা তাদেরও পূর্বপুরুষদের-ই মহান কীর্তি। অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, আরবি, নাগরি ইত্যাদি বর্ণমালার প্রত্যেকটি হচ্ছে, একেকটি ‘দেবাক্ষর’। প্রত্যেকটি আরবি হরফের যেমন এক একজন অধিপতি ফেরেশতা আছে বলে কল্পনা করা হয়েছে; তেমনি প্রত্যেকটি নাগরি বর্ণেও আছে এক একজন অধিপতি দেবতা। একইভাবে ‘বাংলা’-বর্ণেরও যে প্রতিটিরই এক একটি দেবতা বা দেবী আছে, নতুন এ তথ্যটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাই বর্তমান সময় থেকে অতি নিম্নস্তরের ভারতীয় বাঙালি এবং বাংলাদেশি বাঙালিরা (মুসলিম-অমুসলিম-নির্বিশেষে) দাবি করতে পারবে, নাগরি লিপির মতো বাংলা লিপিও ‘দেবাক্ষর’ এবং ‘ধর্মাক্ষর’ও বটে। আর তা ব্রাহ্মণদের নয়; তাদের-ই প্রায় তিন হাজার বছর আগেকার পূর্বপুরুষের অবদান।

আজকের আলোচনা এ পর্যন্ত। সবাইকে বাংলা হরফের ক্যালিগ্রাফি ভুবনে স্বাগতম।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ