বাংলা হরফের শেকড়ের সন্ধান

বাংলা হরফের শেকড়ের সন্ধান

অনুশীলন মোহাম্মদ আবদুর রহীম জুলাই ২০২৩

বাংলা অক্ষর নিয়ে বাঙালদের ঐতিহ্যচিন্তা এ ভাষার “প্রথম পথচলা” থেকে শুরু হয়েছে। শুধু প্রয়োজন বলে কথা নয় হৃদয়ের আকুতি এর সাথে মিশে আছে। প্রাচীন পুথিপত্রে লেখাকে সুন্দর আর অলঙ্কার মণ্ডিত করার প্রয়াস বাঙাল ভূখণ্ডে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে মধ্যযুগে।

ছাপার হরফে বই আসার পরেও প্রচ্ছদ আর ভেতরের ইলাস্ট্রেশনে বাংলা হরফের শিল্পিত ব্যবহার চালু রয়েছে। কিন্তু হরফ দিয়ে শিল্পকলা করার আবেগ আর স্পৃহা একেবারে হাল আমলের। আমাদের চারুকলায় বাঙলা হরফ দিয়ে লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি করার কোন ট্র্যাডিশন দেখা যায় না। বিচ্ছিন্ন দু-একটা কাজ যা আছে তাতে এর প্রতি গভীর অভিনিবেশ প্রায় শূন্যের কোঠায়।

বাংলা ক্যালিগ্রাফির বর্তমান যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দুটো প্রধান চরিত্র রয়েছে। এক. বইপত্রে প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশন, দুই. লিপিকলা।

বইয়ের প্রচ্ছদে শিরোনাম ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে লেখার ক্ষেত্রে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হচ্ছেন অগ্রনায়ক। তার তুলির টানে হরফের শিল্পিত অবয়ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছে। এ ধারায় যারা কাজ করেছেন, তারা প্রায় সবাই চারুকলার।

প্রায় একই রকম হরফের বলিষ্ঠভাব নিয়ে শিল্পী হাশেম খানের তুলির টানে অন্য একটি ধারা দেখা যায়। তবে হাশেম খানের হরফে একটা গ্রামীণ সরল ভাবের সাথে শিশুর সরলতার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ভাবটি অন্যদের মাঝে দেখা যায় না।

আর বাংলাবাজারে ধর্মীয় বইপত্র এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা বইয়ে আরবি হরফের আদলে বাংলাহরফে ক্যালিগ্রাফিরও দেখা মেলে।


হাতে লেখা সাইনবোর্ড ও দেয়াল লিখন :

এখন আর হাতে লেখা সাইনবোর্ড প্রায় দেখা যায় না। দুই দশক আগেও চমৎকার আর্টিস্টিক বাংলা হরফে সাইনবোর্ড লেখা হতো। হরফে আলোছায়া আর উঁচু-নিচু ভাবের সাথে শিল্পিত ছোঁয়া ছিল অসাধারণ। তেমনিভাবে দেয়াল লিখন আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বামপন্থীদের দেয়াল লিখনে যে শিল্পিত রূপ ছিল তা অন্যদের বিমোহিত করত। এ ছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রশিবিরের দেয়াল লিখনে হরফের প্রয়োগ বৈশিষ্ট্য আলাদা হলেও তা দৃষ্টিনন্দন ছিল।

একুশে উদযাপন উপলক্ষ্যে শহীদ মিনারের আশপাশের দেয়াল লিখন এক সময় এত বিচিত্র আর মানসম্পন্ন ছিল যে সৌন্দর্যপিপাসুরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা নয়ন ভরে দেখত। চারুকলার ছাত্ররা বরাবর এই লেখাকে তাদের প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করত। এখন আর সেই মান নেই।

এক সময় দেয়াল পত্রিকা পাড়া-মহল্লায়ও বের করা হতো। এখন শিক্ষাঙ্গন থেকেও তা প্রায় হারিয়ে গেছে। এসব লেখালেখিতে হরফকে সুন্দর করার যে প্রয়াস ছিল, তাতে শিক্ষিত মাত্রই সুন্দর হাতের লেখার একটা গুরুত্ব ছিল। আর এখন অধিকাংশ ছাত্রের হাতের লেখা দেখলে বাংলা হরফের প্রতি ভালোবাসা দূরে থাক, যেন হরফকেই তারা ভুলতে বসেছে।

এই চিত্রের উল্টোদিকও আছে। বাংলা হরফে ক্যালিগ্রাফি করার একটা প্রয়াস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। পেইন্টিংয়ে শিল্পী হাশেম খান, কাইয়ুম চৌধুরী আর ড. আবদুস সাত্তার বাংলা হরফকে অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছেন। চারুকলার সাম্প্রতিক কাজেও তা প্রভাব ফেলেছে।

অন্য দিকে বলা যায়, একাডেমিক শিল্পচর্চার বাইরে কিছু শিল্পী তাদের শিল্পকর্মকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি হিসেবে তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কাজে অভিনিবেশ আর কঠোর সাধনা লক্ষ করা যায়।

এসব বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে ধর্মীয় ভাব প্রাধান্য পেয়েছে টেক্সট ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তাছাড়া দেশ মাতৃকা ভাষার প্রতি কমিটমেন্টও এসব কাজে দেখা যায়। তবে ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পমানে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয় এসব শিল্পী। সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মন্ডল, আরিফুর রহমান, আবদুর রহীমসহ প্রায় শতখানেক শিল্পী বাংলা ক্যালিগ্রাফির একটি নতুন ধারা দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন।


বাংলা টাইপোগ্রাফি :

ছাপার অক্ষর এক সময় সীসার ব্লক আর কাঠের ব্লকে হতো। গত ’৮০ দশকেও সেটা রমরমা ছিল। লেটার হেড বা কোনো শিরোনাম একটু ব্যতিক্রম বা কোনো ইমেজ ছাপাতে হলে জিংক ব্লকের দ্বারস্থ হতে হতো। এরপর টাইপরাইটারে এলো মুনির কি-বোর্ড। তারপর মোস্তাফা জব্বার কম্পিউটারের জন্য মেয়ের নামে সুতন্বি-তন্বি ফন্ট আনেন। এখানে তিনি অনুঘটকের কাজ করেছেন, কারিগরি বা ফন্ট তৈরিতে তার হাত ছিল না। হামিদুল ইসলাম তখন দৈনিক সংগ্রামের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি মোস্তফা জব্বারের অফিসে গিয়ে দিনের পর দিন হাতে ফন্ট বানিয়েছেন। তখন স্ক্যানার আসেনি। সুতরাং মনিটরের স্ক্রিনে আন্দাজের ওপর পাথ করার কাজ করতে হতো। এতে ফন্ট যথার্থ হচ্ছিল না। প্রিন্ট দিলে হাতে আঁকা ফন্টের সাথে মিলে না। ফলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। একদিন শিল্পী হামিদুল ইসলাম বাটার পেপার দেখে নতুন আইডিয়া পেলেন। আবার কাজ শুরু হলো। তিনি বাটার পেপারে ফন্ট এঁকে দেন এবং সেটা মনিটরে কসটেপ দিয়ে লাগিয়ে হরফ পাথ করা হলো। এবার প্রিন্টে মনমতো টাইপ বের হলো। এই অতি পরিশ্রমের মূল্য ছিল মাত্র বিশ হাজার টাকা। এরপর তো প্রযুক্তির কল্যাণে আরো কত ফন্ট বের হলো।

আগেই বলা হয়েছে, বাংলা ফন্টের স্বভাব বর্গাকার বা চারকোনা স্বভাবের। সব হরফ আনুভূমিক সমান মাপের নয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে। এই উপমহাদেশের প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই নিজের লিপি নেই। যেমন- উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত। উর্দু লেখা হয় আরবি হরফে আর হিন্দি-সংস্কৃত লেখা হয় নাগরিতে। সিলেটে মুসলমানদের আবিষ্কৃত একসময় স্থানীয় নাগরি লিপিতে সমৃদ্ধ সাহিত্য ছিল। সেক্ষেত্রে বাংলা (বাঙলা, বাঙালা, বাঙ্গালা) ভাষার নিজস্ব লিপি থাকায়, এর মর্যাদা ও গৌরব অন্যদের থেকে বেশি। বাংলা ফন্ট ক্রমান্বয়ে দৃষ্টি নন্দন করতে এর অবয়বে পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৭৭৮ ঈসায়িতে হ্যালহেডের বাঙ্গালা ব্যাকরণ ছাপার মাধ্যমে বাঙ্গালা হরফে ছাপার প্রযুক্তি হুগলি থেকে শুরু হয়। ছাপার প্রযুক্তির আগে রাঢ় বঙ্গে ও বাংলাদেশে হাতে বই লেখা হতো। সে ক্ষেত্রে রাঢ় বঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশের লেখকদের ফন্ট ও শৈলী উৎকৃষ্ট মানের ছিল।

বাংলা পুথির লিপির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও শৈলী নিয়ে বেশ মজার তথ্য পাওয়া যায়। টানা হাতের লেখায় বিশেষ করে তাল পাতায় লেখা পুথিতে শব্দের পর শব্দে কোনো ফাঁক রাখা হতো না এক শব্দের শেষ হরফের মাত্রা পরের শব্দের সাথে মিলে যেত।

ল ও ন প্রায় একই রকম হতো। ই-কার এ-কারের মতো হতো। ঈ-কারের উড়ানি এবং ঋ-কারের উড়ানি লম্বা এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ শতকের কোনো পুথির লেখার শৈলীর মান ১৮শতকের থেকে উৎকৃষ্ট ছিল। আসলে পুথি লেখক অর্থাৎ পুথির কপি লেখক শিল্প মনোভাবাপন্ন হলে তার লেখা হতো উৎকৃষ্ট।

এখন চারুকলায় বিশেষ করে প্রাচ্যকলায় বাংলায় যে ক্যালিগ্রাফি চিত্রকর্ম করা হচ্ছে, সেগুলো রেখা প্রধান এবং ছবির অনুষঙ্গ ও ভাবের সাথে মিল রেখে করা হয়। তা ছবি হলো কি না, সেটাই মূল কথা। ট্র্যাডিশনাল ক্যালিগ্রাফি চর্চা এখানে গণ্য নয়। তাহলে দেখা যেত কঞ্চি বা বাঁশের কলম দিয়ে বাংলা হরফ লেখা ও ক্যালিগ্রাফি করা হচ্ছে। আর সেটা একটা নির্দিষ্ট নিয়ম কানুনের ব্যাপারও বটে। কারণ আরবি হরফ ডান থেকে বামে লেখা হয়, সে জন্য এর কলমের মাথার স্ট্রোক ডান দিকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ বরাবর থাকে, অন্যদিকে বাংলা বাম দিক থেকে ডান দিকে লেখা হয় বলে এটার কলমের মাথার স্ট্রোক বাম দিকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ বরাবর থাকে।

আজ এ পর্যন্ত আলোচনা রইল। তোমরা ওপরের বয়ান অনুযায়ী বাংলা হরফ লেখা শুরু করে দাও এবং বন্ধুদের চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করো। দেখবে অনেক মজা হবে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ