বাংলাদেশ মানেই স্বপ্ন দেখা

বাংলাদেশ মানেই স্বপ্ন দেখা

প্রচ্ছদ রচনা এপ্রিল ২০১১

প্রথম ম্যাচে পরাজয়, তারপর জয়, আবার পরাজয় এবং জয়। এবারের বিশ্বকাপে প্রথম চারটি ম্যাচে এটাই ছিল বাংলাদেশের পারফরম্যান্স। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কুঁকড়ে উঠার পরপরই নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়েছে বাংলাদেশ। হতাশায় নুইয়ে থাকতে হয় না বেশিক্ষণ, জয়ের ডঙ্কা বাজিয়ে দুর্দান্তভাবেই অস্তিত্বের কথা জানিয়ে দিয়েছে তারা। এরই নাম বাংলাদেশ। ক্রিকেট বিশ্বকাপে বিশেষ কিছু করার অদম্য বাসনা বারবার নতুন মাত্রা পেয়েছে।

এবারের বিশ্বকাপ শুরুই হয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে। সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষ বিশাল রান সংগ্রহ করার কারণেই পারেনি। তবে আয়ারল্যান্ডকে হারাতে পেরেছে বাংলাদেশ। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে মাত্র ৫৮ রানে গুঁড়িয়ে যাওয়ার মতো দল নয় সাকিবরা। ক্রিকেটে যেকোনো দিনই খারাপ দিনে পরিণত হতে পারে। সেদিন ঠিক সেটাই হয়েছিল। টসে জয়ের পর কোনো কিছুই ঠিকমতো হয়নি। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবকিছুই নিখুঁত পরিকল্পনামতো হয়েছিল। ফলে শোচনীয় পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল টাইগারদের। এ নিয়ে  সমালোচনাও কম হয়নি। অনেকেই টাইগারদের ক্যাট বলে টিপ্পনি কেটেছে। ওই সমালোচনার জবাব দিতেও দেরি হয়নি। চট্টগ্রামের ম্যাচটিতেই তারা ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। ওই ম্যাচটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরাগুলোর অন্যতম। মুহূর্তে মুহূর্তে ম্যাচের রঙ পাল্টিয়েছে। ইংল্যান্ডকে ২২৫ রানে আটকিয়ে দেয়ার পর মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ জিতবে। জুনায়েদ ১২ ও রাকিব ০ রানে বিদায় নিলেও তামিম, ইমরুল, সাকিবরা দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। ৩০.৫ ওভারে বাংলাদেশের রান পৌঁছে যায় ৩ উইকেটে ১৫৫। সবাই দারুণ আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপরই আসে ঝড়। সেই ঝড়ে ৫টি উইকেট টপাটপ পড়ে যায়। ৩৯.৪ ওভারে রান দাঁড়ায় ৮ উইকেটে ১৬৬। তখনো অনেক বাকি। প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান আছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তার সঙ্গে যোগ দিলেন শফিউল। টেস্ট ক্রিকেটে তার নামের পাশে একটা ফিফটি থাকলেও অনেক দিন ধরেই রান পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তিনি তো সবকিছু রেখে দিয়েছিলেন এই ম্যাচের জন্য। বাংলাদেশকে দারুণ একটা জয় তুলে দিতে তিনি ছিলেন মরিয়া। তার খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, তার হাতেই স্বপ্ন-চাবি। রিয়াদ শুধু সঙ্গ দেবে। সেই স্বপ্ন-চাবি দিয়ে তিনি সত্যিই জয়ের দরজা খুলে দিলেন। ২৪ বলে ২৪ রান করে ম্যাচটি বের করে আনলেন। তার ছক্কাটিই ছিল পুরো ম্যাচে একমাত্র ওভার বাউন্ডারি। অবিশ্বাস্য! যারা ইতোমধ্যেই অভিমানে মাঠ ছেড়ে গিয়েছিলেন, তারা শুধু আফসোসই করেছেন। কী দৃশ্য তারা মিস করেছেন। অনেক দিন তাদের হতাশায় পুড়তে হবে।

এই ম্যাচে শফিউলের একটি অপ্রাপ্তি হলো ম্যান অব দি ম্যাচের পুরস্কারটি না পাওয়া। এই বিশ্বকাপে এটা তার দুবার না-পাওয়ার বেদনা। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধেও তিনি চারটি উইকেট নিয়ে জয়ের পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি রেখেছিলেন। কিন্তু  সেদিন তার বদলে ম্যান অব দি ম্যাচের পুরস্কারটি দেয়া হয়েছিল তামিম ইকবালকে। আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দেয়া হয় ১০০ বলে ৬০ রান সংগ্রহকারী ইমরুল কায়েসকে। হয়তো আরেকবার জয়ের নায়ক হয়ে তিনি সেই অপ্রাপ্তি ঘোচাবেন।

এবারের বিশ্বকাপে নানা নাটকীয়তা দেখা গেছে। এবারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড সত্যিই সবচেয়ে অনিশ্চিত দলে পরিণত হয়েছে। তারা তিনটি আলোচিত ম্যাচের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভারতের বিরুদ্ধে তারা ৩৩৬ রান করে টাই করেছে। ইংল্যান্ড ৩২৭ রান করেও আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে গেছে, আবার মাত্র ১৭১ রান করেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে ৬ রানে। সত্যিই অনেক রোমাঞ্চ। ক্রিকেট যে চরম অনিশ্চয়তার খেলা, সেটা এই ম্যাচে আবার দেখা গেছে।

এবার এ পর্যন্ত দু’টি হ্যাটট্রিক হয়েছে। উদ্বোধনী জুটিতে শ্রীলঙ্কার উপুল থারাঙ্গা ও তিলকারত্নে দিলশান ২৮২ রান করে বিশ্বকাপ রেকর্ড গড়েছেন। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রান করেছেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস, বেশি উইকেট পেয়েছেন পাকিস্তানের অধিনায়ক শহিদ আফ্রিদি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আপসেটটি হলো আয়ারল্যান্ডের ইংল্যান্ড-বধ। বিশ্বকাপের দ্রুততম সেঞ্চুরি এবং  সর্বাধিক রান টপকে (ইংল্যান্ডের করা ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ৩২৭ রানের জবাবে ৪৯.১ বলে ৭ উইকেটে ৩২৯ রান) জয় ছিনিয়ে আনা বিরাট ব্যাপার। কেভিন ও’ব্রায়েন ৫০ বলে সেঞ্চুরি করে মাত্র ৬৩ বলে ১৩টি চার ও ৬টি ছক্কার সাহায্যে ১১৩ রানের এক অবিশ্বাস্য ইনিংস উপহার দেন। গত বিশ্বকাপে তারা পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে হারিয়েছিল, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে টাই করেছিল। এবার পুরো বিশ্বকাপেই আয়ারল্যান্ড ভালো খেলেছে। আবার কানাডার কাছে কেনিয়ার কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে বাংলাদেশের শোচনীয় পরাজয়ও আলোচিত ঘটনা। নিজস্ব তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ এমন খারাপ করবে, বাংলাদেশের তো কেউ নয়, এমনকি ওয়েস্ট ইন্ডিজেরও কেউ ভাবেনি। ১৮.৫ ওভারে মাত্র ৫৮ রানে অল আউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। তামিম ইকবালের শূন্য দিয়ে শুরু রুবেলের একই অঙ্ক দিয়ে শেষ। মাঝখানে জুনায়েদ সিদ্দিকীর সর্বোচ্চ ২৫ এবং মোহাম্মদ আশরাফুলের ১১ ছিল দুই অঙ্কের স্কোর। মোট চারজন শূন্য রানে ফিরে যান।

ক্রিকেট নানা হিসাবের খেলা। এমনকি ওয়ানডে কিংবা টোয়েন্টি-২০ কোনোটিই শুধু চার আর ছক্কা পেটানোর খেলা নয়। যেকোনো দিন বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠারও প্রস্তুতি থাকতে হয়। এই বিশ্বকাপেও বেশ কয়েকবার দেখা গেছে, প্রথম দুই তিন ওভারের মধ্যে কয়েক রানের মধ্যে একাধিক উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও সম্মানজনক স্কোর হয়েছে এবং ওই দল জয়ও তুলে নিয়েছে। বিপর্যয় হলে দু-একজনকে দায়িত্ব নিয়ে ইনিংস মেরামত করতে হয়। সেটা কেউ করলে আমাদের স্কোর ১৭০ থেকে ১৮০ কিংবা ২০০ও হতে পারতো। সে ক্ষেত্রে এতো লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতো না।

এবারের বিশ্বকাপে (এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত) এটাই সর্বনিম্ন দলীয় স্কোর (বিশ্বকাপের সার্বিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন স্কোরের মালিক কানাডা, সেটা ২০০৩ সালে পার্লে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে, মাত্র ৩৬)। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই এই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ দলীয় ইনিংসটি হয়েছে। অর্থাৎ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দু’টি শোচনীয় দলীয় অবস্থান সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। আর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এটা বাংলাদেশের সর্বনিম্ন স্কোর।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ